সরেজমিন: ফরিদপুর- ফরিদপুরে মন্ত্রীর ভাই-ই সব! by তানভীর সোহেল

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান-মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের কাছে কেউ কোনো কাজে গেলে তিনি মোহতেশাম হোসেনের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। স্থানীয় প্রশাসনও চলে তাঁর কথায়। কোনো কিছুই তাঁর অগোচরে হয় না, এমন কথা প্রচলিত আছে স্থানীয় মানুষের মধ্যে।


তিনি মন্ত্রীর ভাই। পুরো নাম খন্দকার মোহতেশাম হোসেন ওরফে বাবর। এলাকায় সবাই তাঁকে ‘বাবর ভাই’ বলে ডাকেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগে মুরগির খামার ও ডিমের ব্যবসা করায় তিনি ‘ডিম বাবর’ নামে পরিচিতি পান।
২০০৮-এর নির্বাচনের মাস খানেক আগে থেকে ভাইয়ের নির্বাচনের পক্ষে কাজ করেন মোহতেশাম হোসেন। এর আগে ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের দুটি নির্বাচনে তিনি কাজ করেছেন ভাইয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফের পক্ষে।
মন্ত্রীর প্রশ্রয়ে ও সমর্থনে ভাই মোহতেশাম এখন ফরিদপুরের রাজনৈতিক-সামাজিক সব কাজের সঙ্গে যুক্ত। টেন্ডার, চাঁদাবাজি, নিয়োগ-বাণিজ্য, দখল সবকিছুতেই তাঁর নাম জড়িয়ে আছে। বিএনপির রাজনীতি করার কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে পৌরসভা নির্বাচনে প্রার্থী করেননি। তাতে কী! মন্ত্রীর ভাইয়ের প্রভাবের কারণে তিনি হয়ে উঠেছেন ফরিদপুর আওয়ামী লীগের প্রধান ব্যক্তি। শহরের ঝিলটুলীতে অবস্থিত তাঁর বাড়ি থেকেই পরিচালিত হয় সব কর্মকাণ্ড। এমনকি আওয়ামী লীগের কার্যক্রমও চলে সেখান থেকে। স্থানীয় রাজনীতিবিদদের অনেকেই বাড়িটিকে বলেন ‘হাওয়া ভবন’।
মোহতেশাম মূলত দুটি কাজ করেন। এক, বিভিন্ন দল থেকে এনে অথবা তাঁর আজ্ঞাবহদের দিয়ে আওয়ামী লীগকে ‘নতুন’ করে গড়ছেন। দুই, ফরিদপুরের প্রশাসন, টেন্ডার ও জমি দখল নিয়ন্ত্রণ। নিজের তেমন কোনো ব্যবসা না থাকলেও গত চার বছরে তিনি বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। মোটরসাইকেল ছেড়ে এখন একাধিক দামি গাড়িতে চড়ছেন। ছেলেমেয়েদের দেশের বাইরে রেখে পড়াশোনা করাচ্ছেন। মোহতেশামের নানা কাজের সঙ্গীদের মধ্যে প্রধান ব্যক্তিটি হলেন মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ জেলা কমিটির ত্রাণবিষয়ক সম্পাদক মোকাররম হোসেন ওরফে বাবু। আরও আছেন শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক খাইরুদ্দিন মিরাজ, পৌরসভার চেয়ারম্যান ও সদ্য আওয়ামী লীগে যোগদানকারী শেখ মাহতাব হোসেন ওরফে মেথু। প্রশাসন ও পুলিশের কিছু কর্মকর্তাও তাঁদের সঙ্গে আছেন।
মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এঁদের ব্যাপারে নানা কানাঘুষা তিনি শুনেছেন। তবে খোঁজ নিয়ে এর কোনো সত্যতা পাননি। মন্ত্রী নিজের সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) সত্যজিৎ মুখার্জির কাছে এ সম্পর্কে জানতে চান। এপিএস না-সূচক জবাব দিলে মন্ত্রী বলেন, এর কোনো সত্যতা নেই।
সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, টেন্ডার থেকে কমিশন নেওয়া ছাড়াও পাসপোর্ট কার্যালয়, থানা ও মাদক বিক্রি করে এমন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে চাঁদা নেওয়ার কাজেও যুক্ত তাঁরা। স্থানীয় ঠিকাদারেরা জানান, টেন্ডারের ক্ষেত্রে এখন লটারিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। যিনিই কাজ পান, ওই প্রভাবশালীদের নির্ধারিত হারে কমিশন দিতে হয়। আর বিল তোলার সময় মোট বিলের ০.৫০ শতাংশ নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়ে রেখে আসতে হয়।
জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন প্রকৌশলী প্রথম আলোকে বলেন, দরপত্র থেকে বিভিন্ন পক্ষের কমিশনের কারণে রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঠিকাদারের তেমন সমস্যা হয় না। কেননা, ঠিকাদারেরা সরকারের প্রাক্কলিত ব্যয় থেকে ৩০ শতাংশ কম দিয়ে কাজ পেতে পারেন। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, তাঁরা ৫ বা ১০ ভাগ কম দিয়ে কাজ পাচ্ছেন। সেখান থেকে ১৫ ভাগ দিলে তাঁদের ক্ষতি হচ্ছে না। ওই প্রকৌশলী বলেন, শহরের প্রধান সড়কটি চার লেন করা হচ্ছে। চারটি ভাগে এই কাজ হচ্ছে। এখান থেকে আওয়ামী লীগের চার নেতা ৭০ লাখ টাকা নিয়েছেন। ৫০ মেগাওয়াট পাওয়ার স্টেশন নির্মাণের জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ৬০ লাখ টাকা নেওয়া হয়েছে। মেরিন একাডেমির কাছ থেকে দুই কোটি টাকা নেওয়ার অভিযোগ আছে মোহতেশামের বিরুদ্ধে। পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেছেন, আওয়ামী লীগের এই নেতারা পাসপোর্ট কার্যালয় থেকে মাসে এক লাখ টাকা করে নিচ্ছেন।
মন্ত্রী বলেন, ঠিকাদারেরা সমিতি করে কমিশন রাখছেন নিজেদের তহবিলে। এর সঙ্গে আওয়ামী লীগ জড়িত নয়। ঠিকাদারেরা নিজেরাই কমিশন রাখলে কী করার আছে। নিয়োগ-বদলি বাণিজ্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এলাকার লোকজনের জন্য তিনি চাকরির তদবির করেন। কিন্তু কোনো অর্থ নেন না। তবে তাঁর কাছে পৌঁছানোর আগে যদি কেউ টাকা নিয়ে থাকেন, সে ক্ষেত্রে তাঁর কিছু করার নেই।
কোতোয়ালি থানার একজন কর্মকর্তা বলেন, এ সরকারের আমলে থানাকে দালালমুক্ত করা হয়েছে। তবে গুরুত্বপূর্ণ বা রাজনৈতিক মামলার ক্ষেত্রে কোন মামলা নেওয়া হবে, আর কোনটি নেওয়া হবে না, তা নির্ভর করে বাবর ভাই অথবা তাঁদের লোকের মতামতের ওপর।
মোহতেশাম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। আওয়ামী লীগের কিছু নেতার স্বার্থ পূরণ না হওয়ায় তাঁরা এ ধরনের কথা বলছেন। তিনি বলেন, তাঁর বাড়িতে আওয়ামী লীগের নেতারা আসেন। এটা অন্যায় না। বাড়িতে বসে দলের কাজ পরিচালিত হচ্ছে, অন্য কাজও হয়। তাই বলে একে ‘হাওয়া ভবন’ বলা যাবে না। নিজেদের লোক দিয়ে কমিটি গঠন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ কারও স্থায়ী ঠিকানা হতে পারে না। আরও নেতা-কর্মী এসে দলকে শক্তিশালী করছেন। কিছুটা সচেতনভাবেই কোনো কোনো নেতাকে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। যাঁদের দিয়ে কাজ হবে, তাঁদের আনা হচ্ছে।
মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘বাবর ও বাবুকে নিয়ে প্রমাণ ছাড়া কিছু কথা তাঁর কানে এসেছে। প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেব।’
নিজের কিছু নেই!: মাত্র চার বছর আগেও বিয়ে করে কীভাবে সংসার চালাবেন এমন চিন্তা পেয়ে বসেছিল মোকাররম হোসেনকে (বাবু)। যে কারণে বিয়ে করতে ভয় পাচ্ছিলেন বলে প্রথম আলোকে বলেন তিনি। অথচ এ কথা বলার কয়েক মিনিট আগেই তিনি এসে নামলেন নিজের কেনা কালো রঙের এলিয়ন গাড়িতে চড়ে। হাতে লাইসেন্স করা পিস্তল।
দলীয় লোকজন জানান, এ সরকারের আমলে মোকাররমের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। দৃশ্যমান সম্পদের মধ্যে দুটি বাস ও ঢাকায় তিনটি ফ্ল্যাট রয়েছে। ফরিদপুরে ছয়তলা ভিত্তি দিয়ে বাড়ি তৈরির কাজ শুরু হয়েছে।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের দুই নেতা নুর মোহম্মদ ও শওকত হোসেন জাহিদের ওপর হামলার প্রধান আসামি ছিলেন মোকাররম হোসেন। নুর মোহম্মদ হলেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি। পুলিশ অবশ্য তিন মাসের মধ্যেই অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি বলে দুটি মামলারই চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মোকাররম হোসেন বলেন, ঢাকায় একটি ফ্ল্যাটে তিনি তাঁর অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে ছিলেন। সেখানে রেখে চিকিৎসা করিয়েছেন। ওই ফ্ল্যাটটি তাঁর স্ত্রীর বড় ভাইয়ের। তিনি বিদেশে থাকেন। এটি ৫৫ লাখ টাকায় কেনা হয়েছে। ফরিদপুরে তাঁর স্ত্রীর ভাই দক্ষিণ ঝিলটুলীতে ৮০ লাখ টাকা দিয়ে জমি কিনেছেন। আরও বললেন, তাঁর হাতে থাকা লাখ টাকা দামের ফোন ও ৮০ হাজার টাকার ঘড়িও স্ত্রীর ভাই দিয়েছেন। স্ত্রীর ব্যাংক হিসাবে সেই ভাই মাঝেমধ্যে ডলার পাঠান। এসব কারণে স্ত্রীর চিকিৎসা এবং তিনি গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের খরচ চালাতে পারেন বলে জানান। নিজে যে বাড়ির কাজ শুরু করছেন এবং বাস কিনেছেন, সেগুলো তাঁর বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে করেছেন বলে তিনি দাবি করেন। মোকাররম বলেন, তিনি বাবার কাছ থেকে মোট এক কোটি ৩০ লাখ টাকা পেয়েছেন।
সাংবাদিক পিটিয়ে মন্ত্রীর সুনজরে মিরাজ: খাইরুদ্দিন মিরাজ ফরিদপুর ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। সম্প্রতি প্রথম আলোর সাংবাদিকের ওপর হামলা করে মন্ত্রী ও মন্ত্রীর ভাইয়ের সুনজরে আসেন তিনি। মিরাজ আবার মোকাররমের বেয়াই।
মন্ত্রীর দাবি, মিরাজ নিজ যোগ্যতায় দলে গুরুত্বপূর্ণ পদে এসেছেন। কোনো সাংবাদিককে তিনি মারেননি। হাত ধরে জানতে চেয়েছিলেন কেন এ ধরনের সংবাদ লেখা হয়েছে। মন্ত্রী বলেন, ‘আমি এলাকায় অত্যন্ত জনপ্রিয় নেতা। আমার বিরুদ্ধে সংবাদ হলে কর্মীরা রাগ হতেই পারেন।’
মিরাজের বিরুদ্ধে জমি দখলের অভিযোগও আছে। মাইক্রো স্ট্যান্ডের পাশে একটি মাদ্রাসার সাত শতাংশ জমি দখল ও অধ্যক্ষকে মারধর এবং রঘুনন্দনপুরে ও গোয়ালচামট করিম মিয়ার পাম্পের পাশে দুটি জায়গা দখলের অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। জমি দখল করে টাকার বিনিময়ে সংশ্লিষ্ট পক্ষকে বুঝিয়ে দেন তিনি। এ ছাড়া টেন্ডার নিয়ে সমঝোতা ও বিষ্ণুর মদের দোকান থেকে মাসিক ভিত্তিতে চাঁদা নেওয়ার অভিযোগও আছে।

No comments

Powered by Blogger.