একই রক্তের একই দেশের by মোছাব্বের হোসেন

ধানমন্ডি এলাকায় সকালবেলা অনেকে নিয়মিত শরীরচর্চা করেন। প্রধমে আট-দশজন ছিলেন সেই দলে। তারপর এক এক করে দলের লোক বাড়তে থাকে। সেই দলে আছেন তরুণ কর্মকর্তা, অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, হিন্দু-মুসলমান-নির্বিশেষে খুবই আন্তরিক তাঁরা।


মুক্ত চিন্তাধারার সেসব মানুষ শরীরচর্চা শেষে সুধা সদনের পাশে একটি স্থানে বসতেন। একসময় শরীরচর্চার পাশাপাশি ‘সুরধ্বনি’ নামের একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনও গড়ে তোলেন। সেই দলের কয়েকজন হিন্দুধর্মাবলম্বী সবাইকে বলেন, ধানমন্ডি এলাকায় দুর্গাপূজার আয়োজন করলে কেমন হয়? অনেকে সেই কথায় সায় দেন। সবার সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। ২০০৭ সালের কথা। তখন পূজার ১৮ দিন বাকি। ‘আমরা দারুণ একটি চ্যালেঞ্জ নিলাম, যেভাবেই হোক ধানমন্ডি এলাকায় পূজা হতেই হবে। একটা চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। দফায় দফায় বৈঠক করতে লাগলাম।’ সেদিনের কথা বলছিলেন সেই দলের অন্যতম একজন উদ্যোক্তা। সেদিন তাঁর সঙ্গে আরও অনেকেই ছিলেন।
উদ্যোক্তাদের কয়েকজন ধানমন্ডি এলাকায় পূজা আয়োজন করার কথাটি বললে অনেকে তাঁদের উপহাস করতে থাকেন। হাতে মাত্র অল্প কয়েক দিন বাকি। এত কম সময়ে পূজার আয়োজন অসম্ভব, অনেকে এমন ধারণাও করতে থাকেন। কিন্তু তাঁরা থেমে থাকেননি। সমমনা লোকজনদের সংগঠিত করে অল্প সময়ে কলাবাগান ক্রীড়াচক্রের মাঠে পূজার আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। কলাবাগান মাঠ কর্তৃপক্ষকে পূজার কথা বলতেই তাঁরাও সানন্দে রাজি। মজার
এই মাঠে পূজার আয়োজন করার কথা শুনে এই সময় কলাবাগান মাঠের খেলোয়াড়েরা বললেন, এটা তো আমাদের জন্য এক বড় পাওয়া। আমরাও স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে পূজার আয়োজনে অংশ নেব।
এই আয়োজনের একজন সক্রিয় শুভানুধ্যায়ী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা চিকিৎসক খালেদা বেগম বলেন, ‘পুরান ঢাকা থেকে নতুন ঢাকায় বড় পরিসরে পূজার এটিই প্রথম উদ্যোগ। সেদিন হিন্দু-মুসলমান কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কলাবাগান মাঠে অল্প সময়ের মধ্যে দুর্গাপূজার আয়োজন করেছিল। ১১ লাখ টাকা খরচ করে সেই আয়োজনে। যার অধিকাংশ টাকা বিভিন্ন মুসলমান বন্ধু দিয়েছিলেন। সেই থেকে শুরু হলো কলাবাগান মাঠে দুর্গোৎসব পর্ব।’ ২০০৭ সাল থেকে কলাবাগান ক্রীড়াচক্রের মাঠে নিয়মিত পূজা উদ্যাপিত হচ্ছে। এ খবর সে সময় কলকাতার শীর্ষ দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায়ও উঠেছিল।
কলাবাগান মাঠে পূজার আয়োজন শুরু করার দিনের কথা বলতে গিয়ে ধানমন্ডি সর্বজনীন পূজা উদ্যাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক সম্রাট সরকার বললেন, ধানমন্ডিতে সবার সহযোগিতা ছাড়া কোনোভাবেই পূজা শুরু করা সম্ভব ছিল না। তিনি বলেন, ‘এই পূজা শুরু করার সময় আমাদের মুসলমান বন্ধুরাই সর্বপ্রথম সাহস ও উৎসাহ জুগিয়েছেন। আর্থিকভাবে সহযোগিতা করেছেন। সম্প্রদায়বোধ কোনো সমস্যা হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘সারা জীবন পুরান ঢাকায় পূজা করে আসছি। কিন্তু নতুন ঢাকায় ধানমন্ডিতে পূজা শুরু করার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। যে মাঠে ঈদের জামাত হয়, সেই মাঠেই পূজা হয়, বাঙালিদের সম্প্রীতির বড় উদাহরণ এর চেয়ে আর কী হতে পারে।’ তাই ধানমন্ডি পূজা কমিটি থেকে প্রকাশিত স্মরণিকার নামও দেওয়া হয়েছে সম্প্রীতি। যেখানে হিন্দু সম্প্রদায়ের পাশাপাশি বিভিন্ন ধর্মের ব্যক্তিবর্গের বাণী ছাপা থাকে।
ধানমন্ডির পূজা কমিটির সভাপতি গৌরাঙ্গ লাল ভৌমিক বলেন, ‘এখানকার পূজায় অন্য ধর্মের লোকজনই বেশি আসে। পূজার এই পাঁচ দিনে আমাদের দূরত্ব বোঝা যায় না।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের সবচেয়ে বড় পরিচয় আমরা বাঙালি। পরে আমাদের ধর্ম। এখানে পূজার সময় এই কথাই বেশি মনে হয়।’
এ বছরও অনেক বর্ণিল আয়োজন করা হয়েছে কলাবাগান মাঠের পূজামণ্ডপে। মন্দিরের আদলে সাজানো হয়েছে এই মণ্ডপ।
একই রকম পূজার আয়োজন করা হয় বনানী মাঠে। কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউতে এই মাঠটিতে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের পদচারণ। প্রত্যুষে তাঁরা একসঙ্গে শরীরচর্চা করেন। ২০০৭ সালে ধানমন্ডিতে পূজা শুরু হওয়ার পর এখানেও পূজার আয়োজন করার পরিকল্পনা করা হয়। স্থানীয় হিন্দু-মুসলমানরা সভা করে এখানে পূজা করার সিদ্ধান্ত নেন।
গুলশান-বনানী সর্বজনীন পূজা পরিষদের সভাপতি কানুতোষ মজুমদার বলছিলেন গুলশান-বনানী এলাকায় পূজামণ্ডপ তৈরির কথা।
২০০৮ সাল থেকে বনানী মাঠে পূজা উদ্যাপিত হয়ে আসছে। কানুতোষ মজুমদার বলেন, ‘শুরুতেই হিন্দুদের পাশাপাশি অনেক মুসলমান বন্ধু আমাদের সঙ্গে এসে যোগ দেয়। আমরা যে বাঙালি, সেটাই আবার প্রমাণিত হয় এই পূজা আয়োজনের মধ্য দিয়ে। এটি সবার একটি মেলবন্ধন। জাত-বর্ণ-ধর্মনির্বিশেষে সবাই এই পূজা দেখতে আসেন। আমরা সবাইকেই আমন্ত্রণ জানাই এখানে।’
বনানী মাঠের পূজা আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত আছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এ এস এম শাহজাহান। স্মৃতি টেনে তিনি বলেন, ‘ছোটবেলায় তো আমরা দেখে এসেছি, পূজায় হিন্দু-মুসলমানসহ বিভিন্ন ধর্মের লোকেরা একসঙ্গে উৎসবে আসেন। আমরাও সেখানে যেতাম। অন্য রকম আনন্দ পেতাম।’ ছোটবেলার স্মৃতির কথা বলতে বলতে বনানী মাঠের পূজার আয়োজনে নিজের যুক্ত থাকার কথা বলেন। সবাই মিলে এখানে পূজা করার কথা বললে তিনি এতে সমর্থন দেন। তিনি বলেন, ‘খোলা মন নিয়ে পূজার আয়োজনে অংশ নিই। আমাদের মধ্যে কোনো সাম্প্রদায়িকতা নেই। পূজা হিন্দুর কিন্তু উৎসব তো সবার। এখানে সবাই একত্র হলে আমরা নিজেদের শক্তিশালী মনে করি। সবার লক্ষ্য এক হয়ে যায়। এই উৎসবগুলো তো শুধু আমাদের আনন্দই দেয় না। এর বাইরে মন, প্রাণ, আত্মাকে উন্নত করে। উৎসবের মূল সফলতা এখানেই।’
ধানমন্ডি ও বনানীতে পূজা আয়োজন শুরুর পরে এরই ধারাবাহিকতায় উত্তরায় শুরু হয়েছে পূজার আয়োজন। ২০০৯ সাল থেকে এখানে পূজা উদ্যাপিত হয়ে আসছে। তবে এখানে এখনো সুনির্দিষ্ট কোনো স্থান নির্ধারিত হয়নি। এ বছর উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টর মাঠে এ আয়োজন হচ্ছে। উত্তরা থানা পূজা কমিটির সহসভাপতি কার্তিক সেন বলেন, ‘আমাদের আয়োজনে মুসলমানেরাও অংশ নেন। আমরা তাঁদের নিমন্ত্রণ করি। এই এলাকায় পূজা শুরুর ক্ষেত্রে তাঁদের ভূমিকা অনেক। মূলত তাঁদের জন্যই এখানে পূজার আয়োজন করা সম্ভব হয়েছে।’
পুরান ঢাকার পর ২০০৭ সাল থেকে অসাম্প্রদায়িক মানসিকতা নিয়ে যেভাবে পূজা উদ্যাপিত হচ্ছে, তাতে করে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে একইভাবে একদিন এই উৎসব ছড়িয়ে পড়বে বলে মনে করেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষেরা।
বেশ কয়েক বছর আগে লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধা থানার সীমান্ত পার্শ্ববর্তী এক গ্রামে গিয়ে দেখেছিলাম মাদ্রাসার মাঠে পূজার মণ্ডপ। সেখানকার এক মুসলমান দোকানদার বলেছিলেন, ‘এখানে হিন্দু বা মুসলমান কোনো ভেদাভেদ নেই। আমরা তো সবাই একই রক্তের, একই দেশের।’ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে হিন্দু-মুসলমানদের ঐক্য বন্ধনে পূজার আয়োজন করার খবরগুলো যেন সেই কথাগুলোকে মনে করিয়ে দেয়।

No comments

Powered by Blogger.