চট্টগ্রাম বন্দর- নিজের লোক নিতে মহিউদ্দিনের চাপ by কামরুল হাসান

চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ পাহারার জন্য প্রতিদিন লোক লাগে ১৫০ জন। এ কাজের জন্য এখন আছেন ৬০০ জন। কিন্তু আরও ৬৫০ জনকে নিয়োগ দিতে বন্দর কর্তৃপক্ষকে চাপ দেওয়া হচ্ছে। বন্দর সূত্র জানায়, নতুন ৬৫০ জনের মধ্যে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী একাই চেয়েছেন ৬০০ লোকের চাকরি।


আর চট্টগ্রাম-১২ আসনের আওয়ামী লীগের সাংসদ আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু দিয়েছেন ৩০ জনের তালিকা।
এ নিয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষ বেশ চাপে আছে। তবে বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল নিজাম উদ্দিন আহমেদ বলছেন, তালিকা দিলেই তো আর চাকরি হবে না। তালিকা যে কেউ দিতে পারেন। কিন্তু চাকরি দেওয়া হবে যোগ্যতার ভিত্তিতে।
চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ইজারা দেওয়া নিয়ে দলীয় সাংসদ এম আবদুল লতিফের সঙ্গে মহিউদ্দিন চৌধুরীর দ্বন্দ্ব সম্প্রতি চরম আকার ধারণ করে। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে মারামারির ঘটনাও ঘটে। ওই সময় আবদুল লতিফের পক্ষ নেন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের আরেক সাংসদ শামসুল আলম ও নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। তবে চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতাদের কেউ প্রকাশ্যে মহিউদ্দিনের পক্ষে নেই। সাবেক মেয়র নিজের তালিকা অনুযায়ী লোক নিতে কৌশলে চাপ সৃষ্টি করতে বন্দর এলাকায় শ্রমিক সমাবেশও করেন।
মহিউদ্দিন চৌধুরী কিছুদিন আগে প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপকালে বন্দরের চেয়ারম্যানকে ৬০০ শ্রমিকের তালিকা দেওয়ার কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘এরা চাকরি পাওয়ার জন্য মামলা করেছিল, মামলায় জিতেছে। কিন্তু বন্দর কর্তৃপক্ষ চাকরি দিচ্ছে না। তাই আমি তালিকা সংযুক্ত করে বন্দরের চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়েছি।’ তালিকার সবাই দলীয়। এতে অনেক সাজাপ্রাপ্ত আসামি আছে—এমন প্রশ্নের জবাবে সাবেক মেয়র বলেন, ‘তালিকার কেউ দাগি আসামি নয়, এরা আমার দলের কেউ নয়, শুধুই শ্রমিক।’
মহিউদ্দিনের দেওয়া তালিকায় চট্টগ্রাম বন্দর মেরিন কন্ট্রাক্টর পাহারাদার কল্যাণ সমিতির সভাপতি ও পাঠানটুলী ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মনোয়ার হোসেন ওরফে রানা ও মনির হোসেনের নাম রয়েছে। মনির হোসেন বন্দর থেকে পণ্য চুরির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামি।
জানতে চাইলে মনির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে মামলাটি ছিল ষড়যন্ত্র। জাহাজমালিকের সঙ্গে ঝামেলার কারণে এ মামলা দেওয়া হয়।
মহিউদ্দিনের তালিকায় নিজের নাম থাকার কথা স্বীকার করে মনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আগের ৬৫০ জন আছে, এখন আবার ৬০০ লোক কী করে নেওয়া হবে, বুঝতে পারছি না।’ তিনি নগর আওয়ামী লীগের উত্তর পাঠানটুলী ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক বলে জানান।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, মহিউদ্দিন চৌধুরীর সম্প্রতি আন্দোলনের নেপথ্যের অনেকগুলো কারণের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, ৬০০ লোকের নিয়োগ নিয়ে তদবির। তালিকা নিয়েও রয়েছে নানা কথা।
বন্দর ভবন এবং জেটি এলাকা ঘুরে শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া গেছে উদ্বেগজনক তথ্য। এই পদের একটি পরিচয়পত্র (বন্দরের দেওয়া) পাওয়ার জন্য জনপ্রতি ৫০ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকা নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। শ্রমিকদের একটি চক্র বিভিন্ন লোকের কাছ থেকে টাকা আদায় করছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমরা তালিকায় নাম তোলার জন্য কোনো টাকা নিইনি। কে নিয়েছে, জানি না।’
তালিকার ব্যাপারে জানতে চাইলে আখতারুজ্জামান চৌধুরীর পক্ষে তাঁর সহকারী একান্ত সচিব বোরহান উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘সুপারিশ করা সবই দলীয় লোক। এদের বাড়ি সাংসদের এলাকায়। দলের লোকের বাইরের কারও জন্য সাংসদ সুপারিশ করেননি।’
বন্দর সূত্র জানায়, মহিউদ্দিন চৌধুরীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা গত ৩০ সেপ্টেম্বর তাঁর তালিকাটি বন্দরের চেয়ারম্যানের দপ্তরে পৌঁছে দেন। তালিকার সঙ্গে ব্যক্তিগত প্যাডে একটি চিঠিও দিয়েছেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। চিঠিতে তিনি বলেন, ‘বন্দরের চাহিদা মোতাবেক জাহাজ পাহারাদার পদে নিয়োগের জন্য ৬০০ লোকের তালিকা দেওয়া হলো। ৬০০ লোকের মধ্যে ২০০ লোকের প্রশিক্ষণ ফি বাবদ দুই লাখ ৪০ হাজার টাকাও বন্দরের তহবিলে জমা দেওয়া হয়েছে।’
আখতারুজ্জামান চৌধুরী গত ২৪ সেপ্টেম্বর এক দিনে দুটি চিঠি দিয়েছেন। একটিতে তিনি ‘লস্কর’ পদে ২০ জনকে নিয়োগ দেওয়ার সুপারিশ করেন। আরেকটি চিঠিতে নিম্নমান সহকারী, অপারেটর, খালাসি ও নিরাপত্তাকর্মী পদে ১০ জনকে নিয়োগ দিতে বলেন।
বন্দরের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম বন্দরের জেটি ও বহির্নোঙরে প্রতিদিন গড়ে ৪০-৫০টি জাহাজ অবস্থান করে। এসব জাহাজের মালামাল সার্বক্ষণিক দেখতে প্রতিটিতে তিনজন করে পাহারাদার লাগে। আগে এসব জাহাজের জন্য পাহারাদার নিযুক্ত করত শিপিং এজেন্টদের নিয়োজিত ঠিকাদার। কিন্তু একপর্যায়ে দেখা গেল, এসব পাহারাদারও জাহাজে চুরির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন। এ কারণে ২০০৪ সালে এ প্রথা বাতিল করে বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজেদের তত্ত্বাবধানে পাহারাদার নিযুক্তির ব্যবস্থা করে। ২০০৯ সাল থেকে এ প্রক্রিয়া শুরু হয়। পরের বছর ৬৫০ জন পাহারাদার নিয়োগ করা হয়।
পাহারাদারেরা জানান, বর্তমানে পাহারাদার হিসেবে ৬৫০ লোক কাজ করেন। প্রতি ২৪ ঘণ্টার জন্য ৬০০ টাকা মজুরিতে তাঁরা কাজ করেন। তাঁরা জানান, প্রতিদিন যে জাহাজ আসে, তাতে গড়ে ১০০-১৫০ জনের বেশি পাহারাদারের প্রয়োজন পড়ে না। ৫০০ লোক প্রতিদিন বসেই থাকেন। এর পরও নতুন করে আরও ৬০০ লোককে নেওয়া হলে সেটা বন্দরের জন্য বোঝা হয়ে যাবে। আর কাজ ছাড়া তাঁরা বসে থাকলে জাহাজে চুরিসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারেন।

No comments

Powered by Blogger.