শরীয়তপুর-চাঁদপুর ঘাটে ট্রাকজট, গরুর মৃত্যু- ঢাকা-চট্টগ্রাম ও টাঙ্গাইল সড়কে যানজট-ভোগান্তি

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে গতকাল রোববার সকাল থেকে প্রায় ৬৮ কিলোমিটার এলাকায় যানজটের সৃষ্টি হয়। ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের ২৫ কিলোমিটার এলাকায় থেমে থেমে যানজট লেগে থাকে।


ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যানজটের অন্যতম প্রধান কারণ সংস্কারকাজের জন্য শনিবার রাত ১০টা থেকে গতকাল সকাল ছয়টা পর্যন্ত মেঘনা-গোমতী ও মেঘনা সেতু দিয়ে যানবাহন চলতে না পারা। এ ছাড়া পবিত্র ঈদুল আজহা ও শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে ঘরমুখী যাত্রী ও কোরবানির পশু বহনকারী যানবাহনের চাপ দেখা যায় দুটি মহাসড়কেই।
শরীয়তপুর-চাঁদপুর নৌপথে ফেরি-স্বল্পতার কারণে শরীয়তপুরের নরসিংহপুর ঘাট ও চাঁদপুরের হরিণা ঘাটে হাজারের বেশি ট্রাক আটকা পড়েছে। পারাপার হতে না পেরে গতকাল বিকেলে নরসিংহপুর ঘাটে ট্রাকে থাকা চারটি গরুর মৃত্যু হয়েছে।
দিনভর যানজটে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়েছেন ঘরমুখী যাত্রীরা। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন পণ্য ও গরুবাহী ট্রাকের ব্যবসায়ীরা।
ঢাকা-চট্টগ্রাম: মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর সেতু থেকে মেঘনা সেতু পর্যন্ত প্রায় ১৫ কিলোমিটার, কুমিল্লার দাউদকান্দির ইলিয়টগঞ্জ থেকে আলেখাঁরচর বিশ্বরোড এলাকা পর্যন্ত ৩৫ কিলোমিটার এবং চান্দিনার গোমতা থেকে বুড়িচংয়ের কোরপাই এলাকায় ১৮ কিলোমিটার পর্যন্ত যানজট দেখা যায়।
মহাসড়ক পুলিশের ময়নামতি ক্রসিং ফাঁড়ির উপপরিদর্শক (এসআই) সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘মেঘনা ও গোমতী সেতুতে তিন মাস আগে সংস্কার করা স্থানগুলোর সংযোগ-নাট খুলে যায়। এ জন্য শনিবার রাত থেকে আজ (গতকাল রোববার) ভোর পর্যন্ত সেতু বন্ধ রেখে পুনঃসংস্কারের কারণে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে। এ কারণে যানজটের সৃষ্টি হয়। অপর দিকে পশুবাহী ট্রাক চলাচলের কারণে যানবাহনের চাপ অনেক বেড়েছে।’
এলোপাতাড়ি যানবাহন চালানোয় যানজট দীর্ঘস্থায়ী হয় বলে জানান ইলিয়টগঞ্জ মহাসড়ক পুলিশের সার্জেন্ট আনোয়ার হোসেন।
মহাসড়ক ঘুরে দেখা গেছে, কিছু বাসচালকের কারণে যানজট তীব্র হচ্ছে। চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা হানিফ পরিবহনের চালক আবদুল আউয়াল বলেন, ‘কুমিল্লার কিছু চালক সারিবদ্ধ বাস না চালিয়ে সবাইকে অতিক্রম করে যাওয়ায় চেষ্টা করে এক জায়গায় থেমে যায়। এতে যানজট আরও তীব্র হয়।’
একই কথা বলেন রংপুর থেকে ছেড়ে আসা গরুবাহী ট্রাকের চালক গোলাম মোস্তফা। গতকাল দুপুরে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘যানজটে আটকা পড়লে আমরা ট্রাক থেকে নেমে হাঁটাহাঁটি করতে পারি। কিন্তু আমাদের গরুগুলো শনিবার রাত নয়টা থেকে একটানা ট্রাকে দাঁড়িয়ে আছে।’
ময়নামতি হাইওয়ে ক্রসিং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মসিউর রহমান বলেন, ‘যানজটে শুধু যাত্রী-চালকেরাই নয়, আমরাও অতিষ্ঠ হয়ে গেছি। একদিকে যানজট কমালে আবারও যানজট সৃষ্টি হয়।’
দুর্ভোগ: কুমিল্লা থেকে ঢাকাগামী তিসা পরিবহনের যাত্রী ব্যাংক কর্মচারী মো. আমান উল্লাহ্ বলেন, ‘ভোর সাড়ে পাঁচটায় বাসে উঠেছি। এখন প্রায় দুইটা বাজে। এখনো চান্দিনা উপজেলার মাধাইয়া বাজারে আছি।’
কুমিল্লার তিতাস উপজেলার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম জানান, সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে কুমিল্লা থেকে দাউদকান্দির গৌরীপুর পর্যন্ত যেতে সময় লাগে এক ঘণ্টা। কিন্তু গতকাল সকালে সাড়ে তিন ঘণ্টা সময় লাগে।
যানজটের কবলে যোগাযোগমন্ত্রী: কাঁচপুর সেতুর নিচের সার্ভিস রোড উদ্বোধন করতে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল বেলা ১১টার দিকে সেখানে যান। পরে তিনি সোনারগাঁ উপজেলার মোগড়াপাড়ায় একটি ফুটওভারব্রিজের উদ্বোধন করতে রওনা হন। মন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে গতকাল সকাল থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন ছিল। কিন্তু পথে মহাসড়কের দড়িকান্দি এলাকায় যানজটের কবলে পড়ে মন্ত্রী ও তাঁর গাড়িবহর। সেখান থেকে তিন কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করতে যোগযোগমন্ত্রীর সময় লাগে ৪৫ মিনিট।
মহাসড়কে যানজটের ব্যাপারে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি মহাসড়ক যানজটমুক্ত রাখার। এ জন্য স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’
ঢাকা-টাঙ্গাইল: মহাসড়কের গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার সূত্রাপুর, কালিয়াকৈর, চন্দ্রা, সফিপুর ও কোনাবাড়িতে ১৫ কিলোমিটার এবং চন্দ্রা-নবীনগর সড়কের চক্রবর্তী পর্যন্ত ১০ কিলোমিটারব্যাপী সকাল থেকে থেমে থেমে যানজট সৃষ্টি হয়। সড়কের বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা গেছে, যত্রতত্র যানবাহন, বিভিন্ন স্থানে সড়কের পাশ দখল করে দোকানপাট এবং মূল সড়ক দিয়েই লোকজন চলাচল করায় এ যানজটের সৃষ্টি হয়। আটকে পড়া যানবাহনের মধ্যে উত্তরবঙ্গ থেকে ঢাকাগামী কোরবানির পশুবাহী অনেক ট্রাক ছিল। যানজট নিরসনের গতকাল থেকে স্বল্প পরিসরে পুলিশ মোতায়েন করা হয়। তাদের চেষ্টায় বেলা তিনটার পর থেকে জট কিছুটা কমতে থাকে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে গোড়াই হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক ছানোয়ার হোসেন বলেন, মহাসড়কে পশুবাহী ট্রাকের গতি কম থাকায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে।
শরীয়তপুর-চাঁদপুর নৌপথে ফেরি স্বল্পতা: এই নৌপথ দিয়ে প্রতিদিন চট্টগ্রাম বিভাগের সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার পণ্য ও যাত্রীবাহী দুই শতাধিক যানবাহন চলাচল করে। গত ২২ সেপ্টেম্বর কেতকি নামের একটি ফেরি প্রত্যাহার করে মাওয়া ঘাটে নেওয়া হয়। বর্তমানে দুটি ছোট ফেরি দিয়ে ৬৫ থেকে ৭০টি যানবাহন পারাপার হচ্ছে। ফেরি স্বল্পতায় ও কোরবানির পশু বহনকারী ট্রাকের সংখ্যা বাড়ায় শরীয়তপুরের নরসিংহপুর ঘাট থেকে খায়ের পট্টি এলাকা পর্যন্ত দুই কিলোমিটার সড়কের দুই পাশে হাজারের বেশি ট্রাক আটকা পড়েছে। অন্যদিকে চাঁদপুরের হরিণা ঘাটে পারাপারের জন্য অপেক্ষা করছে চার শতাধিক ট্রাক।
সাতক্ষীরার গবাদিপশু ব্যবসায়ী সাখাওয়াত হোসেন ছয়টি ট্রাকে করে গরু নিয়ে চট্টগ্রাম যাচ্ছেন। গতকাল তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিন দিন ধরে নরসিংহপুর ঘাটে অপেক্ষা করায় গরুগুলো অসুস্থ হয়ে পড়েছে। বিকেলে চারটি গরু মারা গেছে। ট্রাকগুলো দ্রুত পার করতে না পারলে গরুগুলোকে বাঁচানো যাবে না।’
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সংস্থার (বিআইডব্লিউটিসি) হরিণা-নরসিংহপুর ঘাটের ব্যবস্থাপক ইমরান খান জানান, যানবাহনের চাপ বাড়ায় আরেকটি ফেরি চাওয়া হয়েছে।
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন মাসুদ রানা, গাজীপুর; মনিরুজ্জামান, সোনারগাঁ (নারায়ণগঞ্জ); মো. আবদুর রহমান ঢালী, দাউদকান্দি (কুমিল্লা); এ বি এম আতিকুর রহমান, দেবীদ্বার (কুমিল্লা) ও সত্যজিৎ ঘোষ, শরীয়তপুর প্রতিনিধি]

No comments

Powered by Blogger.