স্মৃতিতে শ্রদ্ধায় by শওকত মাহমুদ

একজন সাংবাদিক-লেখক মাত্রই আদি সাম্যবাদী সমাজের লোক। কিংবদন্তি সাংবাদিক আতাউস সামাদের জীবনলিপি আমাদের এমন উপসংহারেই ন্যস্ত করে। দীর্ঘ ৫৫ বছরের সাংবাদিকতা সাধনা ও দেশভাবনায় অবিচল অভিনিবেশের ইতি ঘটিয়ে তার ইন্তেকাল ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১২ রাত ৯টা ২৫-এ (ইন্নালিল্লাহি ... রাজিউন)।


সফল রিপোর্টার, সম্পাদক, কলামিস্ট এবং গণমাধ্যম ব্যবস্থাপক হিসেবে শুধু নয়_ গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে অক্লান্ত যোদ্ধা আতাউস সামাদের উন্নত শির তাকে বাংলাদেশের অগ্রগণ্য নাগরিকে পরিণত করে। শেষ মুহূর্তে তার অসুস্থতা এবং মৃত্যু নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে সৃষ্ট ভাবাবেগ ছিল লক্ষণীয়। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এমন মানুষের জন্যই উচ্চারণ করেছিলেন_ 'দেশ মানুষের সৃষ্টি। দেশ মৃন্ময় নয়। মানুষ যদি প্রকাশমান হয় তবেই দেশ প্রকাশিত... তাই দেশ নিজেরই সত্তা প্রমাণের খাতিরে অহরহ তাকিয়ে আছে তাদের জন্য, যারা কোনো সাধনায় সার্থক। তারা না থাকলেও গাছপালা, জীবজন্তু জন্মায়, বৃষ্টি পড়ে, নদী চলে; কিন্তু দেশ আচ্ছন্ন থাকে মরুবালুতলে ভূমির মতো। এ কারণেই দেশ যার মধ্যে আপন ভাষাবান প্রকাশ অনুভব করে তাকে সর্বজন সমক্ষে নিজের বলে চিহ্নিত করার উপল রচনা করতে চায়। যেদিন তাই করে, সেদিন কোনো মানুষকে আনন্দের সঙ্গে সে অঙ্গীকার করে, সেদিনই মাটির কোল থেকে দেশের কোলে সেই মানুষের জন্ম।'
আজকের এই নাগরিক শোক দেশের কোলশূন্য হওয়ারই বেদনা। শুভচিন্তা, জনকল্যাণবোধ বহমান ছিল তার শিরায় শিরায়।
কিশোরগঞ্জের সতের দরিয়া গ্রামে তার জন্ম, ১৯৩৭ সালের ১৬ নভেম্বর। বাবার নাম আবদুস সামাদ ও মাতা সায়েরা বানু। বাবার সরকারি চাকরির সুবাদে দেশের নানা স্থানে থেকেছেন, মানুষের সঙ্গে নিবিড় আন্তরিকতায় মিশেছেন। পড়াশোনা করেছেন জলপাইগুড়ি, রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল ও ঢাকায়। ১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল ছাত্র সংসদের প্রচার সম্পাদক ছিলেন।
স্ত্রী কামরুন্নাহার রেণু। একমাত্র ছেলে আসেকুস সামাদ (সন্তু), মেয়ে স্বাতী ও শান্তাকে নিয়ে তার পরিবার বাংলাদেশ আলোকিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আদর্শস্থানীয় পরিবার। ভাই আতিকুস সামাদ বিবিসিতে কর্মরত। দুলাভাই বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষ আইনজীবী মরহুম অ্যাডভোকেট সিরাজুল হক, ভাগ্নে আরেক স্বনামধন্য অ্যাডভোকেট আনিসুল হক, বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা শহীদ লে. আশফাকুস সামাদ, ইশতিয়াক আজিজ উলফাত। মৃত্যু পর্যন্ত যতক্ষণ জাগ্রত, ততক্ষণ পরিবার এবং বাংলাদেশের মানুষ নিয়ে ভাবিত ছিলেন; এক ধরনের অভিভাবকত্ব তিনি অর্জন করে ফেলেছিলেন। এই অর্জন ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। মনীষার শাণিত ব্যাপ্তিতে দেশ ও দশ সম্পর্কে নখাগ্র পর্যন্ত সচেতন ছিলেন। কবি জীবনানন্দের ওই পঙ্ক্তি_ 'নিখিল আমার ভাই, কীটের বুকেতে যেই ব্যথা জাগে, আমি সে-বেদনা পাই' আতাউস সামাদ সম্পর্কে নির্দি্বধায় প্রযোজ্য।
সাংবাদিকতার শুরু ১৯৫৭ থেকে। সর্বশেষ দায়িত্ব আমার দেশ-এর উপদেষ্টা সম্পাদকের। আমার দেশ-এর আবির্ভাব আতাউস সামাদের অভিভাবকত্বে। মূলত আমার দেশ-এর তিনবার জন্ম তাঁর হাতে। ১/১১'র দুঃসহ সময়ে এর ব্যবস্থাপনা সংকটে আমার দেশ-এর উদ্ধার এবং মাহমুদুর রহমানকে সংশ্লিষ্ট করার সাফল্যও তাঁর। এরপর আমরা দেখেছি, সরকারের রোষানলে পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ এবং মাহমুদুর রহমান গ্রেফতার হলে তিনি পুরোভাগে থেকে সেই অবিস্মরণীয় আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। একইভাবে টিবি চ্যানেল এনটিভির বিপদকালে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তারূপে দায়িত্ব নিয়ে ঝড়ঝঞ্ঝা থেকে টিবি চ্যানেলটি রক্ষা করেন তিনি।
প্রবাদপ্রতিম সাংবাদিক আতাউস সামাদ তাঁর কর্মজীবনে পাকিস্তানের সান পত্রিকার তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান ব্যুরো চিফ, পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক (১৯৬৯-৭২), পাকিস্তান অবজারভার (অধুনালুপ্ত বাংলাদেশ অবজারভার)-এর চিফ রিপোর্টার (১৯৬৫-৬৯), ভারতের রাজধানী নয়াদিলি্লতে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার বিশেষ সংবাদদাতা (১৯৭২-৭৬) এবং বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের বাংলাদেশ সংবাদদাতা (১৯৮২-৯৪) ছিলেন। আশির দশকে স্বৈরশাসক এরশাদের সামরিক শাসনের সময় তাঁর দুঃসাহসী সাংবাদিকতা বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় এক নতুন মাত্রা যোগ করে। সে সময় বিবিসি ও আতাউস সামাদ সমার্থক হয়ে উঠেছিল তাঁর প্রাণবন্ত, নির্ভীক ও সঠিক রিপোর্টিংয়ের জন্য। এ জন্য সামরিক সরকার তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করে এবং বিবিসির কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার নিখুঁত ও প্রাঞ্জল রিপোর্টিং, মওলানা ভাসানীর কাছে শেখ মুজিবুর রহমানের গোপন বার্তা বহন, সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে গণঅভ্যুত্থানকে স্বাধীনতার সংগ্রামে রূপান্তরে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর রক্তচক্ষু এড়িয়ে সাহসকিতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন এবং মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে সমন্বয় সাধন জাতীয় কর্তব্যের প্রতি তার সুনির্দিষ্ট দায়িত্ববোধ এবং অবিচল অঙ্গীকারেরই প্রমাণ। ডেডলাইনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তথ্য যাচাইপূর্বক প্রতিবেদন রচনা এবং তা প্রকাশ-প্রচারের জন্য আতাউস সামাদ সুচিহ্নিত ছিলেন। তাঁর দেওয়া তথ্য আইয়ুব খান, মোনায়েম খান বা এরশাদের মতো স্বৈরশাসকরা কখনও চ্যালেঞ্জ করতে পারেনি। নির্বাচিত সরকারগুলো তটস্থ থেকেছে আতাউস সামাদের সাংবাদিকতায়। রক্তচক্ষু বা প্রভাবে কখনও তার কলম স্তব্ধ হয়নি। ১৯৯২ সালে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে গৌরবময় অবদান ও কীর্তির স্বীকৃতিস্বরূপ তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া তার হাতে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মান একুশে পদক তুলে দেন। এর আগে তিনি বেগম জেবুন্নেসা ও কাজী মাহবুবউল্লাহ জনকল্যাণ ট্রাস্ট পুরস্কারে ভূষিত হন। স্বৈরাচারবিরোধী নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে ভূমিকার জন্য বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন তাকে সম্মাননা জানায়। বস্তুত স্কুপ নিউজ বের করা অথবা সঠিক তথ্যে প্রতিবেদন সাজানোর জটিল, দুরূহ কাজে আতাউস সামাদ ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
সংসদীয় পদ্ধতিতে বিএনপি যে যাচ্ছে, এই খবরটি বেগম খালেদা জিয়াকে উদ্ধৃত করে তিনিই বিবিসির মাধ্যমে দেশবাসীকে প্রথম শুনিয়েছিলেন। কোনো নিউজ সম্পর্কে সুনিশ্চিত হওয়ার জন্য সর্বদা তিনি ব্যগ্র থাকতেন। কষ্ট স্বীকার করতেন অবলীলায়। তার মৃত্যু হওয়ার আগেই কোনো কোনো টিভির স্ক্রলে মৃত্যু সংবাদ প্রচার হওয়া এক ট্র্যাজেডিরই নামান্তর।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে দক্ষতা, নিষ্ঠা ও পরম মমতায় ছাত্রছাত্রীদের রিপোর্টিং শিখিয়েছেন। তার পাণ্ডিত্যমুগ্ধ ও প্রীতিধন্য শিক্ষার্থীরা আজ গণমাধ্যমের নানা শাখায় সুপ্রতিষ্ঠিত। নব্বই দশকের শেষদিকে শিক্ষক-জীবনের ইতি ঘটাতে তিনি দুঃখ পেয়েছিলেন। তবে সাংবাদিকদের স্বনিয়োজিত গাইড হিসেবে কখনও থেমে থাকেননি। রিপোর্টে ভুল হলে সামাদ স্যারের ফোন আসতই। সাপ্তাহিক যায়যায়দিন পত্রিকায় তার একালের বয়ান শীর্ষক কলাম বিষয়বৈচিত্র্যে বিশ্লেষণের সূক্ষ্মতায় ও বর্ণনার সাবলীলতায় দ্রুত পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করে। এই নামে তার একটি গ্রন্থও আছে। নিজের নিভৃত চৈতন্যের জগতে যে স্বপ্নভঙ্গের বোধ আতাউস সামাদের মনে সক্রিয় ছিল, 'একালের বয়ান' গ্রন্থের ১৫ পৃষ্ঠায় তিনি তা জানাতে দ্বিধা করেননি_ 'অতীত ভোলা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছি নতুন দুষ্কর্মের বন্যায়। অতীতের কালিমার মধ্যে থেকে যাচ্ছি আমরা। আলো আর আসে না। সূর্যের জন্য এত পথ হাঁটলাম, আমার জীবনেই তো বত্রিশটি বছর, তবু আলোর মুখ দেখলাম না। কেন যে এমন হলো গোপনে মাথা কুটেও তার উত্তর পাই না। বাইরে সাহসী ভাব দেখাই। কারণ গোটা জাতি এতদিন সংগ্রাম করেও তার ফসল ঘরে তুলতে পারেনি_ এ কথা বলতেও তো লজ্জা লাগে।' তার সেই নৈরাশ্যকে আমরা জীবনের শেষভাগের কলামগুলোতে তীব্র ক্ষোভে পরিণত হতে দেখেছি। দুঃশাসন, মানবাধিকারের যথেচ্ছ লঙ্ঘন, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, দুর্নীতির মচ্ছব, সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডসহ সাংবাদিক পীড়ন ও সংবাদপত্র দলনের সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর বিশ্লেষণে আতাউস সামাদের কলামগুলো ছিল সরব বর্ণমালার জ্বলন্ত প্রতিবাদ।
বাংলাদেশে সাংবাদিকতার স্বর্ণসম্পদ আতাউস সামাদকে আমরা আর তোপখানা-পল্টনে পাব না। প্রিয় প্রতিষ্ঠান জাতীয় প্রেস ক্লাবের মুক্ত সাংবাদিকতার আন্দোলনে পাব না। মানুষ শব্দটির সন্ধিবিচ্ছেদ যদি হয় মান+হুশ তবে তিনি যথার্থ উদাহরণ। মানবিক চেতনায় প্রখর এই মানুষটি জানিয়ে গেছেন সাংবাদিক হতে হলে মানুষ হতে হয়। তার জীবনাবসানে বাংলাদেশের আবালবৃদ্ধবনিতা শোকে স্তব্ধ। আজকের এই নাগরিক শোকসভায় আসুন না কবি হেলাল হাফিজের 'কে' কবিতার পঙ্ক্তিগুলো স্মরণে আনি_
বেরিয়ে যে আসে সে তো এভাবেই আসে,
দুর্বিনীত ধ্রুপদী টংকার তুলে
লণ্ডভণ্ড করে চলে আসে মৌলিক ভ্রমণে।
পথে প্রচলিত রীতিনীতি কিছুই মানে না
তুমি এক সে রকম উত্থানের অনুপম কাহিনী হয়েছ।
গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবের উদ্যোগে আয়োজিত নাগরিক শোকসভায় পঠিত

শওকত মাহমুদ :জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি
 

No comments

Powered by Blogger.