নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা বৃদ্ধি-একটি সময়োপযোগী প্রস্তাব

নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হবে তা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। এ নিয়ে রাজনীতির ময়দান দীর্ঘদিন ধরে উত্তপ্ত রয়েছে। নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসবে এ উত্তাপ ততই বাড়বে। তবে দলীয় বা নির্দলীয়- যে পদ্ধতিতেই সংসদ নির্বাচন হোক না কেন, একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন ছাড়া কোনো পদ্ধতিতেই সর্বজনগ্রাহ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়।


সুতরাং নির্বাচনকালে সব মন্ত্রণালয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণের অধিকার চেয়ে নির্বাচন কমিশন যে প্রস্তাব আনতে যাচ্ছে তা শুধু কমিশনের চাওয়াই নয়, এর মধ্যে রয়েছে দেশের আপামর জনসাধারণের দাবিরও যৌক্তিক প্রতিফলন। সেই সঙ্গে আরো কয়েকটি ক্ষেত্রে আইন ও বিধি সংশোধনের যে প্রস্তাব নির্বাচন কমিশন দিতে যাচ্ছে সেগুলোও যুক্তিযুক্ত ও বাস্তবসম্মত। জানা গেছে, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন করে সংসদ ভেঙে যাওয়ার পর নতুন সংসদ গঠিত না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ চেয়ে সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠাতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন। প্রস্তাবে নির্বাচনের সময় রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ কমিশনকে যথাযথ সহায়তা না করলে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্তদের বিরুদ্ধে তিন বছরের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া আরো কয়েকটি অত্যন্ত বাস্তবসম্মত পরিবর্তনের প্রস্তাব রয়েছে। প্রার্থীদের নির্বাচনী ব্যয় ১৫ লাখ থেকে বাড়িয়ে ২৫ লাখ টাকা করা, নির্বাচনে প্রার্থীর জামানত ১০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০ হাজার টাকা করা, রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ব্যয়সীমা বৃদ্ধি করা, নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের শাস্তির পরিমাণ বাড়িয়ে সাত বছর করা, মনোনয়ন পেতে তিন বছর দলের সদস্য থাকা বাধ্যতামূলক করাসহ আরো কয়েকটি সংশোধনের কথা বলা হবে। উল্লেখ্য, বিগত কমিশনের নির্বাচনকালে চারটি মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রণের প্রস্তাব ফেরত পাঠালে বিতর্কের সূচনা হয়।
নির্বাচন কমিশন সময়োপযোগী ও যথোপযুক্ত কাজটি করতে যাচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশন বেশ কিছু নির্বাচনী সংস্কার প্রস্তাব সরকারের কাছে পাঠায়। কিন্তু সে প্রস্তাবগুলো গৃহীত হয়নি। তবে এবারের বাস্তবতা ভিন্ন। উচ্চ আদালত ত্রয়োদশ সংশোধনীকে অসাংবিধানিক বলে বাতিল করে দেওয়ায় এবং পঞ্চদশ সংশোধনী প্রণীত হওয়ায় দেশে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আর নেই। এ নিয়ে রাজনৈতিক মাঠ উত্তপ্ত হয়ে আছে। এখন যদি নির্বাচন কমিশনের সংস্কার প্রস্তাব সরকার ফিরিয়ে দেয়, তাহলে তা দেশ-বিদেশে সরকারের সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের সদিচ্ছা সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণার জন্ম দেবে। সুতরাং এই মোক্ষম সময়ে নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাবিত নির্বাচনী সংস্কারগুলো প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সংবিধান ও আইন সংশোধনের মাধ্যমে বলবৎ করা প্রয়োজন। এটা করা গেলে নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী হবে এবং ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক সংসদ নির্বাচন উপহার পাবে।
অতীতে সরকারের নির্বাহী বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করলেও ক্ষমতাসীন দলের চাওয়া-পাওয়ার দিকে তাদের খেয়াল রাখতে দেখা গেছে। ফলে নির্বাচনে পক্ষপাতের অভিযোগ উঠেছে। যথেষ্ট আইনি ব্যবস্থার অভাবে নির্বাচন কমিশন তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারেনি। নির্বাচন কমিশনের নতুন প্রস্তাবগুলো সরকার গ্রহণ করলে নির্বাচনে সরকারি কর্মকর্তাদের পক্ষপাতের সমস্যা অনেকটাই দূর হয়ে যাবে। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাসহ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের ওপর স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের নির্বাচনকালীন নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হলে দেশকে অবশ্যই একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দেওয়া সম্ভব। অন্যদিকে দেশের নির্বাচনী ব্যয়সংক্রান্ত যে প্রস্তাবগুলো রাখা হয়েছে তাও যথেষ্ট সুচিন্তিত। দেশে গত কয়েক বছরে মুদ্রাস্ফীতি হয়েছে দ্বিগুণের বেশি। এমন অবস্থায় নির্বাচনী ব্যয় আগের মতো থাকা কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। তা ছাড়া এ ব্যয়সীমা কেউ না মানায় একে যৌক্তিক পর্যায়ে নির্ধারণ ও তা কঠোরভাবে অনুসরণে সব দল ও প্রার্থীকে বাধ্য করা প্রয়োজন। এতে নির্বাচন কমিশনের শক্তিমত্তা প্রমাণিত হবে।

No comments

Powered by Blogger.