শ্রমজীবীদের প্রিয়জন by প্রনীত রঞ্জন দেবনাথ

বৃহত্তর সিলেট তথা বাংলাদেশের বামপন্থি প্রগতিশীল আন্দোলনের এক অতি পরিচিত নাম কমরেড মফিজ আলী। শ্রমজীবী মানুষ যারা সর্বদা থাকেন অবহেলিত, শোষিত, নিষ্পেষিত তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে যাওয়া মানুষটির নাম মফিজ আলী। ১০ অক্টোবর তার চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী।


ভাষা আন্দোলন ছাড়াও তিনি চা শ্রমিক নেতা, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, বিশিষ্ট লেখক, প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ছিলেন। দুর্ঘটনাজনিত কারণে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের ফলে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৮১ বছর বয়সে ২০০৮ সালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার ধূপাটিলা গ্রামের একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে ১৯২৭ সালের ১০ ডিসেম্বর মফিজ আলী জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আজফর আলী ও মাতা নূরজাহান বিবির বড় ছেলে মফিজ আলী ছাত্রজীবন থেকেই প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। মৌলভীবাজার সরকারি হাই স্কুল থেকে ১৯৪৯ সালে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৫০-এর দশকে শুরু হয় তার কলেজ জীবন। মদনমোহন কলেজ থেকে আইএ পাস করার পর এমসি কলেজে ভর্তি হন। ছাত্র ইউনিয়নের কার্যকলাপের জন্য এমসি কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ সুলেমান চৌধুরী কলেজ থেকে বহিষ্কার করায় ডিগ্রি পরীক্ষা দেওয়া সম্ভব হয়নি।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন তার মনে রাজনৈতিক চেতনার সৃষ্টি করেছিল। ভাষা আন্দোলনের সেই সংগ্রামী দিনগুলোতে মফিজ আলী সিলেট এমসি কলেজের ছাত্রাবস্থায় কলেজে আন্দোলনের ফাঁকে তিনি এলাকায় ছুটে আসেন। কমলগঞ্জে সভা-সমাবেশ করা তখন ছিল অসম সাহসের ব্যাপার। ক্ষমতাসীন সরকারের রক্তচক্ষুতে আঙুল দিয়ে তখনকার সময়ে ভাষা আন্দোলনের জন্য সাহসী নেতৃত্ব প্রদান করেন তিনি। তবে তিনি সকল ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ভাষার অধিকারের জন্য আন্দোলন করেছিলেন। পরে সিলেটে কলেজ জীবনে তিনি ছাত্র ইউনিয়নে যোগদান করেন। ছাত্র ইউনিয়নের জেলা কমিটিতে মফিজ আলী প্রথমে সহ-সম্পাদক এবং পরে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
পূর্ব পাকিস্তানে ৯২ (ক) ধারা জারির পর তাকে গ্রেফতার করে সিলেট জেলে প্রেরণ করা হয়। ৬ মাস পর মুক্তি পান। মওলানা ভাসানীর গঠিত কৃষক সমিতির শুরু থেকেই তিনি এই সংগঠনে যুক্ত ছিলেন। বৃহত্তর সিলেট জেলা কমিটির প্রথমে সহ-সম্পাদক এবং পরবর্তীকালে সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৬০ সালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। রাজনৈতিক কারণে ১৯৬০ সালে তাকে গ্রেফতার করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রেরণ করার দুই বছর পর মুক্তি দেওয়া হয়। ১৯৬৩ সালে তিনি শ্রীমঙ্গলে বালিশিরা কৃষক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ১৯৫৪, ৬০, ৬৪, ৬৫, ৬৭, ৬৯, ৭২ সালে রাজনৈতিক কারণে পাকিস্তান নিরাপত্তা আইন ও বিভিন্ন মামলায় তিনি দীর্ঘ ৬ বছর কারাবরণ করেছেন।
চা শ্রমিকদের দুঃখ-দুর্দশা দেখে তিনি ১৯৬৪ সালে চা শ্রমিক নেতাকর্মীদের নিয়ে 'পূর্ব পাকিস্তান চা শ্রমিক সংঘ' নামে একটি শ্রমিক ইউনিয়ন দাঁড় করান। নিজের লোভ-লালসার ঊধর্ে্ব থেকে দেশের শ্রমিক কৃষক মেহনতি মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য তিনি আপসহীন রাজনীতি করেছেন। তিনি যে নিজেকে উৎসর্গ করে গেছেন নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের মুক্তির জন্য তা পথ দেখাবে পথের মানুষদের। তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।

No comments

Powered by Blogger.