গোঁ ধরে ডাবল গাড়ি! by আশরাফুল হক রাজীব

পোশাক-আশাকের ভিত্তিতে নয়, মানুষকে সম্মান করতে হবে তার কর্মের নিরিখে; কিংবা উল্টোভাবে বললে কর্ম ও ব্যক্তিত্বের জোরেই মানুষ আদায় করবে মর্যাদা- শেখ সাদীর গল্পের এই শিক্ষা মনে হয় এ দেশে কোনো কাজে লাগেনি। তাই বিলাসবহুল গাড়ি কেনার এক বছরের মাথায় বিভাগীয় কমিশনারদের জন্য তার চেয়ে বেশি দামি গাড়ি কেনা হচ্ছে।


বিভাগীয় কমিশনাররা গোঁ ধরেছিলেন, গত বছর একই ব্র্যান্ডের গাড়ি দেওয়া হয়েছে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের। ডিসিরাও একই রকম গাড়ি হাঁকান। এতে তাঁদের মান-মর্যাদা থাকে কিভাবে? সরকার তাঁদের যুক্তি মেনে নিয়েছে। পাশাপাশি মন্ত্রীদের জন্যও নতুন ১৪টি সিডান গাড়ি কেনা হচ্ছে।
তবে প্রশাসনে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের মত, কেবল 'মান-মর্যাদাই' নয়, একটি মহল এ ধরনের কেনাকাটায় উৎসাহী। কারণ যত ক্রয় তত কমিশন, তত লাভ এবং লাভালাভের পরিক্রমা চলে দীর্ঘদিন।
সরকারি সংস্থা প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড সূত্রে জানা গেছে, গত বছর বিভাগীয় কমিশনারদের জন্য জাপানি মিতসুবিশি কম্পানির পাজেরো ব্র্যান্ডের সাতটি গাড়ি কেনা হয়। ২৩৫০ সিসির প্রতিটি গাড়ির দাম ছিল ৫২ লাখ টাকা (রেজিস্ট্রেশন খরচ ছাড়া)। এক বছরের ব্যবধানে তাঁদের জন্য আবারও সাতটি গাড়ি কেনা হচ্ছে। পাজেরো স্পোর্টস কার মডেলের ২৫৭৭ সিসির প্রতিটি গাড়ির মূল্য ধরা হয়েছে ৭৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এর সঙ্গে রেজিস্ট্রেশন বাবদ ব্যয় তো রয়েছেই।
জানা গেছে, মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের দামি গাড়ি দেওয়ায় বিভাগীয় কমিশনাররা অপেক্ষাকৃত কম দামি গাড়ি ব্যবহার করতে আপত্তি জানান। বিভাগীয় কমিশনারদের যে গাড়ি দেওয়া হয়েছে, গত বছর একই ব্র্যান্ডের গাড়ি দেওয়া হয় ইউএনওদের। বিভাগীয় কমিশনারদের চেয়ে ইউএনওদের গাড়ি যদি বেশি দামি হয় তাহলে কমিশনারদের আর মান থাকে না; তাই এক বছর ধরেই কমিশনাররা আরো দামি গাড়ি দাবি করে আসছিলেন। সর্বশেষ গত মাসের বিভাগীয় কমিশনারদের সমন্বয় সভায়ও তাঁরা তাঁদের দাবির কথা মনে করিয়ে দেন। তখনই জানানো হয়, চলতি অর্থবছরে তাঁদের জন্য উন্নতমানের জিপ গাড়ি কেনার জন্য অর্থ বরাদ্দ পাওয়া গেছে। গত ১২ আগস্ট জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় বলা হয়, গাড়ি কেনার কার্যক্রম চলছে। প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজের মাধ্যমে এসব গাড়ি কেনা হবে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আবদুস সোবহান সিকদার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বিভাগীয় কমিশনারদের জন্য গাড়ি কেনা হচ্ছে। তবে গত বছর তাঁদের জন্য কোনো গাড়ি কেনা হয়েছিল কি না, তা এই মুর্হূতে আমি বলতে পারছি না। আর মন্ত্রীদের গাড়ি সংকট রয়েছে। তাঁদের জন্য গাড়ি কেনার সিদ্ধান্তটি পুরনো।'
২০১০-১১ অর্থবছরের শেষ দিকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, বরিশাল ও নবগঠিত রংপুর বিভাগের কমিশনারদের জন্য সাতটি গাড়ি কেনা হয়। একই মানের আরো তিনটি অতিরিক্ত গাড়ি কেনা হয়। একই বছরে ভিশন-২০২১ বাস্তবায়নে পদায়নকৃত কর্মকর্তা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকদের (এডিসি) জন্য ৭৬টি, জেলায় যাওয়া ভিআইপিদের প্রটোকলের জন্য ৬৪টি পাজেরো জিপ কেনা হয়। সব জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের জন্য একটি করে মোট ৬৪টি মাইক্রোবাসও কেনা হয় ওই বছর। এসব গাড়ি কেনা হয় সরকারি পরিবহন পুলের মাধ্যমে। এ ছাড়া স্থানীয় সরকার বিভাগ উপজেলা চেয়ারম্যানদের জন্য ২১১টি গাড়ি কেনে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং সাবেক মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এম হাফিজউদ্দিন খান কালের কণ্ঠকে বলেন, দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় বিভাগীয় কমিশনার কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদ নয়। তাঁদের চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন ইউএনও এবং ডিসি-এডিসিরা। সরকারের কিছু লোককে পদায়ন করার জন্য এসব পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। আগে এসব পদে যুগ্ম সচিবদের নিয়োগ দেওয়া হতো। এখন অতিরিক্ত সচিবদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। তাঁদের কাজের কোনো পরিবর্তন নেই। কিন্তু সুযোগ-সুবিধার পরিবর্তন হচ্ছে। এক বছরের ব্যবধানে নতুন ব্র্যান্ডের গাড়ি কেনার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। যে দেশে ছাত্রছাত্রীরা বেঞ্চের অভাবে মাটিতে বসে লেখাপড়া করে, সেই দেশে কর্মকর্তাদের জন্য এক বছরের ব্যবধানে কোনোভাবেই নতুন গাড়ি কেনা হতে পারে না। যে দেশে এখনো ৩১ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে সেই দেশে এভাবে গাড়িবিলাস হতে পারে না। এটা বন্ধ করা উচিত। সব সরকারের সময়ই গাড়ি নিয়ে অনাচার হয়েছে। এখনো হচ্ছে। সরকারকে ভুল বুঝিয়ে কর্মকর্তারা এসব গাড়ি কেনান। এতে অনেক রাজনীতিবিদও জড়িত থাকেন। কারণ গাড়ি কেনা মানেই হচ্ছে কমিশনের খেলা। এখানেই শেষ নয়। এ গাড়িকে কেন্দ্র করে বছরের পর বছর দুর্নীতি হবে। গাড়ি পরিচালনা, রক্ষণাবেক্ষণ, গাড়িচালক নিয়োগ, জ্বালানি থেকে টাকা চুরি- সব ক্ষেত্রে এ দুর্নীতি চলতে থাকবে। এসব কমিশন কোথায় যায়, কার কাছে যায়, তা প্রকাশ করে এ সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া উচিত।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও সাবেক সংস্থাপন সচিব এ এম এম শওকত আলী বলেন, 'আমরাও বিভাগীয় কমিশনার ছিলাম। এ ধরনের মানসিকতা আমাদের ছিল না। এখানে শুধু বিভাগীয় কমিশনারদের দোষ দেওয়া ঠিক হবে না। গাড়ি কেনার ক্ষেত্রে অন্য কারো ইন্ধনও থাকতে পারে। কারণ যত ক্রয় তত কমিশন। গাড়ি কিনে দুর্নীতি শুরু করা হয়, যা বিভিন্ন উপায়ে চলতে থাকে সেই গাড়ি বিক্রি না করা পর্যন্ত।'
জানা গেছে, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় আরো ১৪টি গাড়ি কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বলা হচ্ছে, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী এবং সমমানের ব্যক্তিদের ব্যবহার উপযোগী গাড়ির সংখ্যা কম থাকায় এসব গাড়ি কেনা হচ্ছে। রেজিস্ট্রেশনসহ মন্ত্রীদের প্রতিটি গাড়ির জন্য ব্যয় হবে ৪৫ লাখ টাকা। এর আগে ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় মন্ত্রীদের জন্য গাড়ি কেনা হয়। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৩ সালেও মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও সমমানের ব্যক্তিদের জন্য গাড়ি কেনা হয়। তবে সরকারি ব্যবস্থাপনায় এসব গাড়ির আয়ুষ্কাল হয় খুব কম।
সরকারি পরিবহন পুলের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, একটি সিন্ডিকেট নতুন গাড়ি অকেজো করে দেয়। তারা খুচরা যন্ত্রাংশ খুলে বিক্রি করে দেয়। অনেক সময় নতুন যন্ত্রাংশ পাওয়া যায় না। তাই জোড়াতালি দিয়ে চালাতে গিয়ে একসময় তা অকেজো হয়ে পড়ে। একজন মন্ত্রীর গাড়িচালক বলেছেন, কম দামের গাড়ি কেনা হয় বেশি দামে। এ জন্যও অনেক গাড়ির গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ চালুর আগেই অকেজো থাকে। ২০০৩ সালে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের ব্যবহারের জন্য ২৩টি গাড়ি কেনা হয়েছিল। এসব গাড়ি পাঁচ বছরের মধ্যেই ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে।
রিকন্ডিশন্ড গাড়ি বিক্রেতাদের সংগঠন বারভিডার সাবেক সভাপতি আবদুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'দেড় হাজার সিসির একটি নতুন গাড়ি স্বাভাবিক নিয়মেই ১০ থেকে ১২ বছর ভিআইপিদের চালানোর উপযোগী থাকার কথা। আমরা পাঁচ বছরের পুরনো গাড়ি আমদানি করি। এসব গাড়ি চলে ২০ বছরেরও বেশি সময়। অথচ সরকারি মালিকানাধীন ব্র্যান্ড নিউ গাড়ি পাঁচ বছরেই অকেজো হয়ে যায়। সরকারি গাড়ির এ প্রক্রিয়া বড় বেশি বিলাসিতা। এ ধরনের অপচয় আর কতকাল চলবে?'
প্রাধিকার অনুযায়ী মন্ত্রিসভার একজন সদস্য দাপ্তরিক কাজে ব্যবহারের জন্য একটি সিডান গাড়ি পেয়ে থাকেন, যা সরকারি যানবাহন অধিদপ্তর বা পরিবহন পুল থেকে সরবরাহ করা হয়। প্রতিটি গাড়ির জন্য দিনে ২০ লিটার তেল বা সমপরিমাণ টাকা বরাদ্দ করা হয়। এ ছাড়া দাপ্তরিক কাজে বাইরে গেলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অধীন কোনো প্রতিষ্ঠানের একটি জিপ গাড়ি ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। দ্য মিনিস্টার্স, মিনিস্টার্স অব স্টেট অ্যান্ড ডেপুটি মিনিস্টার্স (রেম্যুনারেশন অ্যান্ড প্রিভিলেজেস) অ্যাক্ট ১৯৭৩-এর ৬(এ) ধারা অনুযায়ী মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা কোনোভাবেই ঢাকায় বিলাসবহুল জিপ গাড়ি ব্যবহার করতে পারেন না। একই আইনের ৬(বি) ধারা অনুযায়ী ঢাকার বাইরে গেলে তাঁদের মন্ত্রণালয়ের অধীন অধিদপ্তর, পরিদপ্তর বা সংস্থা থেকে একটি জিপ গাড়ি নিতে পারেন। কিন্তু অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ ছাড়া এ নিয়ম অনুসরণকারী মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী খুঁজে পাওয়া কঠিন। সরকারি পরিবহন পুল থেকে যে গাড়ি সরবরাহ করা হয় তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মন্ত্রী নিজে ব্যবহার না করে তাঁর পরিবারের সদস্যরা ব্যবহার করেন। একটি মাত্র গাড়ি প্রাপ্য হলেও তাঁরা একাধিক গাড়ি ব্যবহার করেন। এ কারণে সরকারের জ্বালানি ব্যয় বাড়ে।
যাঁদের কাজ আইন তৈরি করা বা বেআইনি কাজ রোধ করা, তাঁরাই যদি আইন ভঙ্গ করেন তাহলে দেশের মানুষ কার কাছে যাবে- এ মন্তব্য পরিবহন পুলের এক কর্মকর্তার। তিনি বলেন, সাধারণভাবে সচিবসহ অন্য কর্মকর্তারা পুলের গাড়ির পাশাপাশি প্রকল্পের বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহার করেন। তাই প্রকল্পের ব্যয়ও বাড়ানো হয়। অনেক সময় কর্তাব্যক্তিদের খুশি করার জন্যও প্রকল্প থেকে গাড়ি সরবরাহ করা হয়। উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের এ ধরনের অনৈতিক সুবিধাকে পুঁজি করে অধস্তনরা দুর্নীতিতে লিপ্ত হন। এভাবে দুর্নীতি বিস্তার লাভ করে।

No comments

Powered by Blogger.