তৃণমূলের অভিযোগের কাঠগড়ায় বিএনপির বড় নেতারা by শফিক সাফি

দলের ডাকসাইটে বড় বড় নেতাদের নিয়ে ক্ষোভ, দুঃখ আর অভিযোগের অন্ত নেই তৃণমূলের নেতাদের মনে। মতবিনিময় সভায় কথা বলার সুযোগ পেয়ে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সামনে অভিযোগের ঝাঁপি খুলে দেন বিএনপির তৃণমূলের নেতারা।


বিভিন্ন জেলার স্থানীয় নেতারা জানান, বড় নেতাদের অনেকেই এলাকায় তাঁদের প্রিয়ভাজনদের নিয়ে 'পকেট কমিটি' গঠন করছেন। সমস্যার সমাধান না করে জিইয়ে রাখছেন কোন্দল। কেউ কেউ এলাকায়ও যান না। কলকাঠি নাড়েন ঢাকায় বসে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাঁদের নামের ওপরই বসানো থাকে বড় নেতার তকমা। আলাদাভাবে হলেও মতবিনিময় সভাগুলোতে দেশের বিভিন্ন জেলার তৃণমূলের নেতারা এসব কথাই খোলামেলা তুলে ধরেন চেয়ারপারসনের সামনে। এ ছাড়া বিএনপির সমমনা পেশাজীবী সংগঠনগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় সভাতেও নেতারা তুলে ধরছেন তাঁদের ক্ষোভ ও বঞ্চনার কথা।
গত ৯ সেপ্টেম্বর গাজীপুর জেলার তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে বসেছিলেন খালেদা জিয়া। বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, তৃণমূল নেতারা জেলার শীর্ষ চার নেতার বিরুদ্ধে সরাসরি নালিশ করেন। তাঁরা বলেন, আ স ম হান্নান শাহ, অধ্যাপক এম এ মান্নান, হাসানউদ্দিন সরকার এবং ফজলুল হক মিলনের মধ্যকার দ্বন্দ্বের কারণে জেলায় বিএনপির কার্যক্রমে স্থবিরতা বিরাজ করছে। এই নেতারা একে অপরের নির্বাচনী এলাকার কমিটি গঠন নিয়ে হস্তক্ষেপ করেন। সবারই উদ্দেশ্য 'পকেট কমিটি' গঠন। এসব অভিযোগের জবাবে খালেদা জিয়া বলেন, কেউ দলের শৃঙ্খলার বাইরে কাজ করতে পারবেন না। তিনি চার নেতাকে নিয়ে একসঙ্গে বসে কোন্দল নিরসন করবেন বলেও আশ্বস্ত করেন। গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে ওই বৈঠকে উল্লিখিত চার নেতার মধ্যে জেলা সভাপতি হওয়ার সুবাদে উপস্থিত ছিলেন ফজলুল হক মিলন।
বিভিন্ন জেলার তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি সভা করেছেন খালেদা জিয়া। গত ৮ সেপ্টেম্বর থেকে এই কর্মসূচি শুরু হয়। তৃণমূল পর্যায়ে নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করতে খালেদা জিয়া ১২টি সাংগঠনিক জেলার সঙ্গে বৈঠক করছেন। গাজীপুর জেলার সঙ্গে বৈঠকে সব থানা ও পৌরসভার পাঁচজন করে সদস্যকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। পরে তিনি আমন্ত্রণ জানান মুন্সীগঞ্জ, টাঙ্গাইল, জামালপুর, লালমনিরহাট, বগুড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ঠাকুরগাঁও জেলার নেতাদের। এসব বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এমন একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আমন্ত্রিত প্রতিটি জেলার নেতাদের কাছে ফরম দেওয়া হয়েছে রিপোর্ট সংগ্রহের জন্য, যাতে ওই জেলার সব ধরনের সমস্যা, আন্দোলনে ভূমিকা, আগামী নির্বাচনে প্রার্থীসহ বিভিন্ন বিষয় উল্লেখ থাকবে।
এসব বৈঠক সম্পর্কে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কালের কণ্ঠকে বলেন, সারা দেশে আন্দোলন তীব্র করতে এবং নতুন কর্মসূচির বিষয়ে পরামর্শ করতেই জেলা নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন চেয়ারপারসন।
১২টি সাংগঠনিক জেলা ছাড়াও খালেদা জিয়া বৈঠক করছেন পেশাজীবীদের সঙ্গে। ৮ সেপ্টেম্বর প্রথম বৈঠক করেন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে। ৯ সেপ্টেম্বর গাজীপুর জেলা, ১০ সেপ্টেম্বর প্রকৌশলী, ১১ সেপ্টেম্বর মুন্সীগঞ্জ জেলা, ১২ সেপ্টেম্বর চিকিৎসক, ১৩ সেপ্টেম্বর টাঙ্গাইল জেলা এবং ১৫ সেপ্টেম্বর সাংবাদিক, লেখক ও সাহিত্যিক, ১৬ সেপ্টেম্বর জামালপুর, ১৭ সেপ্টেম্বর কৃষিবিদ, ১৮ সেপ্টেম্বর ডিপ্লোমা কৃষিবিদদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন তিনি। মতবিনিময়ের পর ২৩ সেপ্টেম্বর দিনাজপুরে জনসভা করেন খালেদা জিয়া।
এ ছাড়া ২৪ সেপ্টেম্বর আইনজীবী, ২৬ সেপ্টেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ২৭ সেপ্টেম্বর সিরাজগঞ্জ জেলার নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় এবং ২৯ সেপ্টেম্বর রাজবাড়ী জনসভা করার কথা ছিল খালেদা জিয়ার। কিন্তু গত ২৩ সেপ্টেম্বর রবিবার নিউ ইয়র্কে মারা যান খালেদা জিয়ার ছোট ভাই সাঈদ এস্কান্দার। দিনাজপুরের জনসভা শেষে ঢাকায় ফেরার পথে তিনি এই খবর পান। এরপর সেপ্টেম্বরের বাকি কর্মসূচিগুলো স্থগিত করা হয়। এসব কর্মসূচির নতুন তারিখ এখনো নির্ধারণ করা হয়নি। তবে গত ১ অক্টোবর লালমনিরহাট, ২ অক্টোবর বগুড়া, ৩ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ৪ অক্টোবর ঠাকুরগাঁওয়ের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন খালেদা জিয়া। গত ৬ অক্টোবর বক্তব্য দেন হবিগঞ্জের নিউ ফিল্ড মাঠে আয়োজিত জনসভায়। অন্যদিকে বরিশালের ৯ অক্টোবর অনুষ্ঠেয় জনসভা পরিবর্তন করে ১৪ নভেম্বর নির্ধারণ করা হয়েছে।
মুন্সীগঞ্জ জেলা নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে খালেদা জিয়া স্থানীয় পর্যায়ের কোন্দল নিরসন এবং জেলা কমিটিসহ থানা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের সমস্যা সমাধানে মহাসচিব কাজ করবেন বলে জানান। ওই বৈঠকে উপস্থিত এক নেতা কালের কণ্ঠকে বলেন, তৃণমূল নেতারা বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটি গঠন নিয়ে স্বেচ্ছাচারিতা ও অনিয়মের অভিযোগ তুলে ধরেন চেয়ারপারসনের কাছে। সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত জেলা সভাপতি আবদুল হাইসহ কয়েকজন সিনিয়র নেতার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করেন তাঁরা।
তৃণমূল নেতাদের অভিযোগ, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন এবং এম শামসুল ইসলামের মতো অভিজ্ঞ নেতাদের মতামতকেও গুরুত্ব দেন না জেলা সভাপতি। তিনি অরাজনৈতিক ব্যক্তি মিজানুর রহমান সিনহার পরামর্শে চলেন। খালেদা জিয়া তাঁদের বক্তব্য শুনে সমস্যা সমাধানে মহাসচিবকে দায়িত্ব দেন। খালেদা জিয়া বলেন, 'সামনে কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। তাই নিজেদের মধ্যে বিভেদ থাকলে চলবে না। এক হয়ে কাজ করতে হবে। দলকে শক্তিশালী করতে হবে। বৈঠকে মুন্সীগঞ্জ জেলা সভাপতি আবদুল হাই, সাধারণ সম্পাদক আলী আজগর রিপন মল্লিকসহ স্থানীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
জানা যায়, টাঙ্গাইলের তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে খালেদা জিয়ার সামনেই পরস্পরকে দোষারোপ করে বক্তব্য দেওয়ার ঘটনা ঘটে। বৈঠকে জেলা সভাপতি আহমেদ আজম খান, সাধারণ সম্পাদক শামসুল আলম তোফাসহ বিভিন্ন থানার ২৪টি ইউনিটের নেতারা অংশ নেন। অভিযোগ করা হয়, কেন্দ্রের নেতারা বিভিন্ন পর্যায়ে পকেট কমিটি গঠনেই মনোযোগ দেন। আন্দোলনে কোনো মনোযোগ নেই।
জামালপুর জেলা বিএনপি ও বিভিন্ন ইউনিট নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে নানা অভিযোগ শুনে খালেদা জিয়া বলেন, 'শুধু আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করলে হবে না, নিজেদের মধ্যে ভেদাভেদ ভুলে সেই কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হব।'
লালমনিরহাট জেলা বিএনপির নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে খালেদা জিয়া সজাগ ও সতর্ক থেকে সরকারের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান।
বগুড়ার নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের সময় জেলার নেতারা চেয়ারপারসনের কাছে কঠোর কর্মসূচি দাবি করলে তিনি বলেন, দলকে সাংগঠনিকভাবে প্রস্তুত রেখে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে। জেলা নেতাদের মধ্যে ছিলেন বগুড়া জেলা বিএনপির সভাপতি ভিপি সাইফুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদিন চান, সাবেক সংসদ সদস্য হেলালুজ্জামান তালুকদার লালু প্রমুখ।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ঠাকুরগাঁও জেলা বিএনপি নেতাদেরও একই পরামর্শ দেন খালেদা জিয়া। সভায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নেতাদের মধ্যে জেলা বিএনপি সভাপতি অ্যাডভোকেট হারুন অর রশিদ, সাধারণ সম্পাদক জহিরুল হোসেন খোকন প্রমুখ এবং ঠাকুরগাঁও জেলা নেতাদের দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব ও জেলা বিএনপির সভাপতি মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, সাধারণ সম্পাদক তৈমুর রহমান, সিনিয়র সহসভাপতি শাহেদ কামাল চৌধুরীসহ ১৪টি ইউনিটের ৪৫ জন নেতা উপস্থিত ছিলেন। একইভাবে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, সাংবাদিক, লেখক ও সাহিত্যিক, কৃষিবিদ, ডিপ্লোমা কৃষিবিদদের সঙ্গে বৈঠকের সময়ও সমমনা পেশাজীবী নেতাদের কাছ থেকেও নানা অভিযোগ এসেছে। তাঁরা বলেছেন, পেশাজীবী নেতারা কেউ এলাকায় যান না। ঢাকায় বসে নিজের পদ-পদবি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। বিশেষ করে চিকিৎসকরা সপ্তাহে অন্তত এক দিন নিজের এলাকায় গিয়ে রোগী দেখতে পারেন। তাতে জনসংযোগের পাশাপাশি আন্দোলনের ক্ষেত্রে লাভ হয়। কিন্তু তাঁরা তা না করে ঢাকায় নেতৃত্ব নিয়ে প্রকাশ্যে হাঙ্গামা করেন।
অভিযোগ লেখা হচ্ছে :
আমন্ত্রিত সাংগঠনিক জেলার নেতাদের কাছ থেকে কোন্দলসহ বিভিন্ন বিষয়ে পাওয়া অভিযোগ লিখে রাখছেন খালেদা জিয়া। এসব নোট ফাইল আকারে দলের মহাসচিবসহ দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের কাছে যাবে। সেখান থেকে সার-সংক্ষেপ তৈরি করে আরেকটি ফাইল বানানো হবে, যা আগামী নির্বাচনে কাজে লাগবে বলে মনে করা হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.