সাংবাদিক দম্পতি হত্যা- ৭ সন্দেহভাজন গ্রেপ্তার, এখনো জট খোলেনি

সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যার ঘটনায় সন্দেহভাজন আটজনকে শনাক্ত করে এঁদের সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অপরজন সাগর-রুনির ভাড়া বাসার নিরাপত্তা প্রহরী হুমায়ুন কবীর ওরফে এনামুলকে ধরিয়ে দিতে ১০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।


সাংবাদিক দম্পতি হত্যার প্রায় আট মাস পর গতকাল মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে পাঁচটায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এর তদন্তের বিষয়ে বক্তব্য দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর। এ সময় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু, স্বরাষ্ট্রসচিব সি কিউ কে মুস্তাক আহমেদ, র‌্যাবের মহাপরিচালক মোখলেছুর রহমানসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। র‌্যাব এ মামলার তদন্ত করছে।
গ্রেপ্তার হওয়া সাতজন হলেন: রফিকুল ইসলাম, বকুল মিয়া, মো. সাইদ, মিন্টু, কামরুল হাসান ওরফে অরুণ এবং রাজধানীর একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের প্রশাসনিক কর্মকর্তা তানভীর ও সাগর-রুনির ভাড়া বাসার নিরাপত্তা প্রহরী পলাশ রুদ্র পাল। প্রথম পাঁচজন গত আগস্টে মহাখালীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালের চিকিৎসক নারায়ণ চন্দ্র হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার হন। আর তানভীর সাংবাদিক দম্পতির ‘পারিবারিক বন্ধু’ বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
তবে নিহত সাংবাদিক সাগর সরওয়ারের মা সালেহা মনির তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদ সম্মেলনে সাজানো তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। মেহেরুন রুনির ভাই নওশের আলম প্রথম আলোকে বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য তাঁদের কাছে অস্পষ্ট মনে হয়েছে। তিনি দাবি করেন, তানভীর নামে তাঁদের কোনো পারিবারিক বন্ধু নেই। এমনকি সাগর বা রুনি কখনো তানভীর নামের কোনো বন্ধুর কথা পরিবারের কাউকে বলেননি।
সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, চিকিৎসক নারায়ণ চন্দ্র দত্তের হত্যায় সংশ্লিষ্ট যে পাঁচজনকে সাংবাদিক দম্পতি হত্যায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাঁরা পেশাদার অপরাধী। আর সাগর-রুনির বাড়ির নিরাপত্তা প্রহরী রুদ্র পলাশ ও হুমায়ুন কবীর ওরফে এনামুলকে এ খুনের মামলায় অপরাধী বলে শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে পলাশকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। হুমায়ুনকে এখনো ধরা যায়নি। তবে তাঁর পৈতৃক বাড়ি, আত্মীয়স্বজনসহ লুকাতে পারে সম্ভাব্য সব স্থান শনাক্ত করা হয়েছে। এর বাইরে সাগর-রুনির পারিবারিক বন্ধু তানভীর সন্দেহের তালিকায় আছেন।
চারদলীয় জোট সরকারের সময়ের ‘জজ মিয়ার’ গল্পের মতো সাগর-রুনির মামলা নিয়ে নতুন কোনো নাটক হবে কি না, এ প্রশ্নের জবাবে মহীউদ্দীন খান আলমগীর বলেন, ‘আমরা এখানে কোনো নাটক সাজাতে আসিনি। আমরা এটার সুষ্ঠু তদন্ত করব। জজ মিয়ার কোনো কথা আমি বলি নাই। তবে যেহেতু তার কথা এল, তাই বলছি, জজ মিয়ার মতো কোনো নাটক করে জনগণের মনোভাব ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার কোনো ইচ্ছা এই সরকারের নেই।’
এ ঘটনায় ভাড়াটে খুনি জড়িত ছিল কি না, জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের কাছে যে তথ্য এসেছে তার আলোকে যা বলা যায়, সেটা হচ্ছে দুটো সম্ভাবনাই রয়েছে। এর বাইরে এ সম্পর্কে কিছু বলা যাবে না।’ তিনি বলেন, ‘অপরাধের আলামত আমরা পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করেছি, যুক্তরাষ্ট্রের অত্যাধুনিক পরীক্ষাগারে পাঠিয়েছি, তারা পরীক্ষার মাধ্যমে অপরাধীদের ডিএনএ শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। এর ভিত্তিতে যেসব অপরাধীর নাম বললাম, কিংবা এর বাইরে যদি কোনো ভিন্ন অপরাধী আমাদের তদন্তে উদ্ঘাটিত হয়, তাদের ডিএনএ বিচার বিশ্লেষণ করে আমরা অকাট্যভাবে আদালতে নিয়ে যেতে সামর্থ্য হব।’
তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে মেলেনি অনেক প্রশ্নের উত্তর। সন্দেহভাজন আটজন কীভাবে, কেন এ ঘটনায় জড়িত হলেন এবং তাঁদের কীসের ভিত্তিতে শনাক্ত করা হলো, তা স্পষ্ট করেননি তিনি। সাংবাদিকদের প্রশ্ন ছিল এই হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য কী। মন্ত্রী উত্তর না দিয়েই দ্রুত সংবাদ সম্মেলন শেষ করেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, এ ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া পাঁচজন পেশাদার খুনি। তাঁদের মধ্যে নিহত চিকিৎসক নিতাই চন্দ্র রায়ের গাড়িচালক কামরুলও রয়েছেন। সাংবাদিকদের প্রশ্ন ছিল, পেশাদার খুনিরা কেন সাংবাদিক দম্পতিকে খুন করল? এর সঙ্গে পেশাদার খুনি বা চোরের সম্পর্ক কী? উত্তরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, তদন্তের পরই এসব প্রশ্নের উত্তর মিলবে। সাংবাদিকেরা আরও জানতে চান, চিকিৎসক নিতাই হত্যার সঙ্গে এই হত্যার যোগসূত্র কোথায়? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিষয়টি ‘তদন্তনাধীন’ বলে এড়িয়ে যান।
সাংবাদিকদের প্রশ্ন ছিল, কতজন এই হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছিল? কী কারণে এতজন মিলে তাঁদের হত্যা করল? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘তদন্ত চলছে। তদন্ত করতে দেন।’ এ সময় খুনের সম্ভাব্য কারণ সম্পর্কে জানতে চান সাংবাদিকেরা। মন্ত্রী বলেন, ‘তদন্তের পরই সব জানা যাবে। যিনি তদন্ত করছেন তাঁর জায়গায় নিজেকে কল্পনা করুন।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, সাংবাদিক দম্পতি হত্যার রহস্য বের করতে র‌্যাব অত্যন্ত আন্তরিকতা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে তদন্ত কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য তদন্তের স্বার্থে গতানুগতিক তদন্ত পদ্ধতির পাশাপাশি অত্যাধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। তিনি সাগর-রুনির ছয় বছরের ছেলে মেঘের প্রতি সহমর্মিতার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ জানান।
এর আগে গত ২৫ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর সাংবাদিকদের বলেছিলেন, সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের রহস্য ১০ অক্টোবরের মধ্যে উদ্ঘাটন করা সম্ভব হবে।
খুন ও তদন্ত: গত ১১ ফেব্রুয়ারি সকালে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া ফ্ল্যাট থেকে মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার ও এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনির ক্ষত-বিক্ষত লাশ উদ্ধার করা হয়। ওই দিন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেপ্তার করা হবে বলে জানিয়েছিলেন। এরপর পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকার ‘প্রণিধানযোগ্য’ অগ্রগতির কথা বলেছিলেন।
শুরু থেকেই মামলাটির তদন্ত করেছিল মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। লাশ উদ্ধারের পর পরই ডিবি দুই নিরাপত্তাকর্মী হুমায়ুন কবীর ও পলাশ রুদ্র এবং কথিত বন্ধু তানভীরকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করে। পরে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়া কয়েকজন পেশাদার গ্রিল কাটা চোরকেও তখন সন্দেহভাজন হিসেবে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল।
ডিবির কাছ থেকে ছাড়া পাওয়ার পর থেকে হুমায়ুনকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে তাঁর মুঠোফোনটি গত ১৫ জুলাই ডিবি সহকারী কমিশনার মো. সোলায়মানের ভাইয়ের কাছ থেকে উদ্ধার করে র‌্যাব।
এর আগে তদন্তের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি না হওয়ায় বিষয়টি হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। গত ১৮ এপ্রিল হাইকোর্টে মামলার তদন্তকারী সংস্থা ডিবি তদন্তে ব্যর্থতার কথা স্বীকার করে নেয়। তারপর আদালতের নির্দেশে মামলার তদন্তের দায়িত্ব পায় র‌্যাব। এরপর ২৬ এপ্রিল ভিসেরা আলামতের জন্য দুজনের লাশ আজিমপুর কবরস্থান থেকে তোলা হয়। ভিসেরা পরীক্ষায় তাঁদের শরীরে বিষক্রিয়ার কোনো আলামত মেলেনি।
ডিএনএ পরীক্ষা: র‌্যাব গত জুনের শুরুর দিকে সাগর ও রুনিকে হত্যায় ব্যবহূত একটি ছুরি, একটি ছুরির বাঁট, সাগরের মোজা, একটি কম্বল, সাগরের পরনের প্যান্ট, রুনির পরনের প্যান্ট ও অন্যান্য কাপড় থেকে নমুনা সংগ্রহ করে ডিএনএ (ডি-অক্সিরাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড) পরীক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের একটি পরীক্ষাগারে পাঠায়। গত ১৭ জুলাই দ্বিতীয় দফায় যে কাপড় দিয়ে সাগরের হাত ও পা বাঁধা হয়েছিল, সেই কাপড় ও রুনির টি-শার্ট পাঠানো হয়।
এ ছাড়া গত আগস্টে চিকিৎসক নায়ারণ হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া পাঁচজনের ডিএনএ নমুনা মেলানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়। এরই মধ্যে র‌্যাব গণমাধ্যমকে জানায়, রুনির টি-শার্ট থেকে একজন ব্যক্তির পূর্ণাঙ্গ ডিএনএ বৃত্তান্ত পাওয়া গেছে।

No comments

Powered by Blogger.