আরেক আলোকে-দুর্নীতি বন্ধ করতেই হবে by ইনাম আহমদ চৌধুরী

বলতে দ্বিধা নেই, বাংলাদেশ আজ দুর্নীতির রাহুগ্রাসগ্রস্ত। রাষ্ট্র জীবনের এমন কোনো এলাকা নেই, যেখানে দুর্নীতি নেই_ রাষ্ট্র ব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে তা অনুপ্রবেশ করেছে। বস্তুতপক্ষে দুর্নীতি কাকে বলে, তা কত প্রকার ও কী কী, দুর্নীতিগ্রস্ত হলে তা থেকে কী করে পার পাওয়া যায়, কিংবা অন্যের ঘাড়ে দায়দায়িত্ব-দোষ চাপিয়ে দেওয়া যায়_ এসব শেখার ও জানার জন্য সারা পৃথিবীর মধ্যে বর্তমানে প্রকৃষ্ট স্থান হচ্ছে বাংলাদেশ।


এই একটি বিষয়ে যদি নোবেল পুরস্কারের ব্যবস্থা থাকত তবে বাংলাদেশের দাবি বা স্থান কেউ অস্বীকার করতে পারত না। আর ব্যক্তি পর্যায়ে এলে অবশ্য বিভিন্ন মন্ত্রী, উপদেষ্টা, রাজনৈতিক হোমরাচোমরা ব্যক্তিবর্গ এবং দলীয় নেতাদের মধ্যে বিশেষ প্রতিযোগিতা হতো। দুর্নীতি হতে পারে রাষ্ট্রীয়, রাজনৈতিক, সামাজিক ও ব্যক্তিগত। তা হতে পারে আর্থিক, বুদ্ধিবৃত্তিক বা নীতিগত। বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলে সব ধরনের দুর্নীতিরই নিরঙ্কুশ প্রকাশ এবং বিস্তৃতি দেখা যায়। খবরের কাগজ খুললে হররোজ চোখে পড়ে কোনো না কোনো সরকারি দুর্নীতির খবর। কত রকম!
সমষ্টিগতভাবে সরকারি আনুকূল্যে, পৃষ্ঠপোষকতায় বা প্রত্যক্ষ মদদে শেয়ারবাজারে মহাকেলেঙ্কারি ঘটতে দেখলাম আমরা। অবশ্য গত আওয়ামী শাসনেও শেয়ারবাজারে একই শনি ভর করেছিল। এসব ব্যাপারে রাঘববোয়ালদের ভূমিকা এবং তাদের কুকর্মের বিবরণ তদন্ত রিপোর্টেও বেরিয়েছে। কিন্তু বোধগম্য কারণেই এ সম্পর্কে প্রতিকারমূলক কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। সত্যিই এটি একটি অত্যাশ্চর্য ব্যাপার।
ইদানীং হলমার্ক ও ডেসটিনি গ্রুপের এবং এতদ্সঙ্গে সোনালীসহ অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের অবিশ্বাস্য দুর্নীতির খবর আমরা পাচ্ছি। ব্যাংক থেকে কোনো বিশ্বাসযোগ্য ডকুমেন্ট ছাড়াই হাজার হাজার কোটি টাকা উধাও হয়ে গেছে! ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার পাঁয়তারা অবশ্য হচ্ছে। কিন্তু যাদের আনুকূল্যে, সহযোগিতায় এবং সম্ভবত নির্দেশে তারা এসব কাণ্ড করেছে, অর্থাৎ সেই পরিচালনা পর্ষদের ব্যাপারে বিশেষ কোনো পদক্ষেপের কথা শোনা যাচ্ছে না। কেননা তারা একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের নেতা বা নেতার আত্মীয়; নিদেনপক্ষে অনুগ্রহপুষ্ট। খোদ পরিচালনা পর্ষদ গঠনেও কি দুর্নীতি করা হয়নি? সব রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ গঠনেই যোগ্যতা ও মেধার বদলে দল ও স্বজনপ্রীতি প্রাধান্য পেয়েছে। কেবল ব্যাংক নয়; শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ যে প্রতিষ্ঠানেই সরকার মনোনীত পরিচালনা পর্ষদ গঠনের সুযোগ রয়েছে, সেখানেই এটা ঘটেছে।
এমনকি ডেসটিনির মতো বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানেও দেখা যাচ্ছে সর্বোচ্চ পদের অধিকারী ব্যক্তিটি সরকারের বিশেষ সমর্থক ও অনুগ্রহপুষ্ট। তিনি সেক্টরস কমান্ডারস ফোরামেরও কো-চেয়ারম্যান। এখন আর্থিক কেলেঙ্কারির দায়ে আত্মগোপনে রয়েছেন। এ লজ্জা কোথায় রাখা যায়!
সোনালী ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের ব্যক্তিবর্গ অবশ্য আত্মগোপনে যাননি। বুক ফুলিয়ে নিজেদের সাফাই গাইছেন। কিন্তু পরিচালনা পর্ষদের সংশ্লিষ্টতা না থাকলে ব্যাংক কর্মকর্তারা গ্রহণযোগ্য ডকুমেন্ট ছাড়া যে বিরাট ঋণ দেওয়ার সাহস পাবেন না, তা বলাই বাহুল্য। এত বড় ঋণ যে পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন ও বিবেচনা ছাড়া দেওয়া যায় না, সেটা সবাই বোঝেন।
দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, কেবল অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে নয়; বিশ্ববাসীর কাছেও বাংলাদেশ আজ যেভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে পরিচিত হচ্ছে, তা অতীতে হয়নি। আমরা দেখলাম, পদ্মা সেতু প্রকল্প ইস্যুতে বিশ্বব্যাংক তাদের স্বাক্ষরিত ঋণ চুক্তি পর্যন্ত বাতিল করে দিয়েছে। আরব আমিরাতের মতো অভিবাসীবান্ধব দেশ বাংলাদেশিদের জন্য সর্বপ্রকার ভিসা প্রদান বন্ধ করেছে_ এটাও নজিরবিহীন ঘটনা। তাদের অভিযোগ পরিষ্কার_ বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের সহায়তায় জালিয়াতি করে হাজার হাজার মানুষ তাদের দেশে ঢুকছে। তাদের বক্তব্য, যথাযথ ক্ষেত্রে ভিসা দিতে তারা তো অপারগ নয়। বিশ্বের উন্নয়নকামী অনেক দেশ থেকে হাজার হাজার কর্মী সেখানে যাচ্ছে। এমন একটি বৈধ প্রক্রিয়া সম্পর্কে জালিয়াতির প্রয়োজন হলো কেন, আমিরাত কর্তৃপক্ষ বুঝতে পারছে না।
কেবল আরব আমিরাত নয়, আরও কয়েকটি দেশ থেকে এ ধরনের জালিয়াতির অভিযোগ আসছে। এমন অভিযোগও পাওয়া গেছে, মন্ত্রী পর্যায়ের লোক মিথ্যা তথ্য দিয়ে কারও কারও জন্য ভিসা প্রদানের অনুরোধ জানিয়েছিলেন, যা পরে ধরা পড়েছে। বস্তুত মন্ত্রী-উপদেষ্টাদের বিভিন্ন রকম ব্যক্তিগত দুর্নীতির কথা বলে শেষ করা যাবে না। বরং প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির প্রতি আরও খানিকটা আলোকপাত করা যাক।
গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে সরকারের নানা পদক্ষেপ ইতিমধ্যেই দেশে-বিদেশে সমালোচিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির মালিকানার ৯৭ ভাগ ছিল দরিদ্র মহিলাদের। এখন সেটাকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যাওয়ার যে প্রচেষ্টা চলছে নিউইয়র্ক টাইমসের ভাষায় তা হচ্ছে দুর্নীতিমূলক পদক্ষেপ। খোদ সরকারি অফিসগুলোতে ৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকার দুর্নীতি ও অনিয়ম সম্প্রতি নিরীক্ষাতেই ধরা পড়েছে। বিগত কালে কখনও এটা হয়নি। শিক্ষাঙ্গনে ভর্তিবাণিজ্য ও প্রশ্নপত্র ফাঁস এসব কথা বাদই দিলাম। ৩৩তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষাও দুর্নীতির কারণেই স্থগিত করা হলো!
সাম্প্রতিককালে বস্তাভর্তি টাকার দুর্নীতি এবং নদী চুরির দুর্র্নীতি বাস্তবিকই ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। সাবেক রেলমন্ত্রী যেভাবে বমাল ধরা পড়লেন তা কোথাও ঘটেছে বলে আমার জানা নেই। আশ্চর্যের কথা, এটাকেও সরকার ও সমাজ সহ্য করে যাচ্ছে। আরও দুঃখের বিষয়, দুদকের পক্ষ থেকে আগেভাগেই বলা হলো, তিনি দুর্নীতিগ্রস্ত নন। অথচ এমন কোনো ব্যক্তি নেই, যারা ঘটনাগুলো থেকে অবহিত যে কেউ সেটা বিশ্বাস করবে না। ড্রাইভার আজম খান প্রকাশ্যে গাড়িভর্তি ঘুষের টাকার সাক্ষ্য দেওয়া সত্ত্বেও দুদক বলল, তারা গাড়িচালকের মতো সাক্ষীর বক্তব্য বিবেচনায় আনতে চায় না। এটি অসম্ভব উক্তি। অথচ এ ধরনের বিবরণ থেকেই যে কোনো অপরাধ অনুসন্ধান সহজতর হতে পারে। সাবেক রেলমন্ত্রীও বললেন, আজম এতদিন কোথায় ছিলেন? কেন এতদিন কথা বলেননি? এটা কোনো প্রশ্ন হলো! বেচারা হয়তো প্রাণভয়ে পালিয়ে ছিলেন। ইলিয়াস আলীর গুম হওয়া ড্রাইভারের কোনো খবর আমরা এখনও জানি না। এই ড্রাইভারের গুম-খুনের ভয় থাকতে পারে না? অবশ্য আজম খান সাহসের সঙ্গে মিডিয়ার কাছে বিস্তারিত বলেছেন_ কীভাবে ওই টাকা মন্ত্রীর বাড়ি যাচ্ছিল, কীভাবে আগেও গেছে।
নেতার এসব গুণকীর্তি দেখেশুনে তার নির্বাচনী এলাকার লোকও লজ্জা পেয়েছে এবং ধিক্কার দিচ্ছে। অথচ তিনি নিজেকে 'নিষ্পাপ' দাবি করছেন। আমাদের মনে আছে, আরেকজন মন্ত্রী নিজেকে 'হলিম্যান' বা পুণ্যাত্মা দাবি করেছিলেন। এসব নিষ্পাপ ও পুণ্যাত্মার সমন্বয়ে গঠিত মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে, বিশ্বব্যাংক কমিটি কাজ শুরু করলেই তার প্রমাণ মিলবে। বিশ্বব্যাংক তিনজন বিশ্বখ্যাত ব্যক্তিকে পদ্মা সেতু দুর্নীতি তদন্তে নিয়োগ করেছে। এতেই বোঝা যাচ্ছে বিষয়টি তারা কতটা সিরিয়াসলি নিয়েছে।
ইতিমধ্যে সবাই জানেন, বিশেষজ্ঞ দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন গ্যাব্রিয়েল মারিনো ওকাম্পো। তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সাবেক আইনজীবী। আর্জেন্টিনার সাবেক সামরিক শাসকের গণহত্যা মামলার সফল আইনজীবী হিসেবে বিখ্যাত। তিনি আইসিসির পক্ষে কানাডা, কেনিয়া, সুদানে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মামলার শুনানিতে অংশ নেন। আরেকজন সদস্য হলেন হংকংয়ের দুর্নীতি বিষয়ক স্বাধীন কমিশনের কমিশনার। তৃতীয় সদস্য ব্রিটেনের কেবল সিনিয়র আইনজীবীই নন, আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন। এই বিশেষজ্ঞ দল অবশ্যই আমাদের দুদকের ওপর খবরদারি করবে। জাতি হিসেবে এটা আমাদের জন্য চরম লজ্জাজনক। কিন্তু উপায় নেই! নিজেদের স্বভাব দোষে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
একই সঙ্গে এটাও বলা দরকার, দুর্নীতি সম্পর্কে আমাদের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সচেতনতা এখন সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেদনার সঙ্গে লক্ষ্য করছি, দুর্নীতির অভিযোগ তুলে একটি দেশ আমাদের জন্য ভিসা বন্ধ করে দিচ্ছে। দুর্নীতির অভিযোগে বৃহত্তম অর্থকরী প্রতিষ্ঠান অর্থ দিতে অস্বস্তি বোধ করছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ না পেলে একে একে পৃথিবীর সব দ্বার বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ক্ষমতাসীনরা কি এর ভয়াবহতা বুঝতে পারেন? আসলে সবারই বোধগম্য হওয়া উচিত। সবারই এগিয়ে আসা উচিত দুর্নীতি মোকাবেলা করতে। তা না হলে জাতীয় অগ্রগতি রুদ্ধ হবে। সেটা কারও জন্যই মঙ্গলকর হবে না।

ইনাম আহমদ চৌধুরী : সাবেক সচিব ও কলাম লেখক

সংশোধনী
মঙ্গলবার সমকালে প্রকাশিত আমার কলামে সাবেক রেলমন্ত্রীর এপিএসের গাড়ি থেকে উদ্ধার হওয়া টাকা পরে কমার্শিয়াল ব্যাংকে তার নিজের অ্যাকাউন্টে জমা দেওয়া হয় বলে উল্লেখ করেছি। প্রকৃতপক্ষে ওই টাকা মার্কেন্টাইল ব্যাংকে জমা দেওয়া হয়েছিল।
বদরুদ্দীন উমর

No comments

Powered by Blogger.