হলমার্ক কেলেঙ্কারি-তানভীর-তুষারের জামিন নামঞ্জুর জেরা অব্যাহত

হলমার্ক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তানভীর মাহমুদ ও মহাব্যবস্থাপক তুষার আহমেদের জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত রয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কর্মকর্তারা গতকাল মঙ্গলবার তাঁদের দুজনকে টানা চার ঘণ্টা জেরা করেন।


বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে তানভীর তদন্ত কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন সোনালী ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের সময় নানা অনিয়মে সহায়তাকারীদের তথ্য।
এদিকে গতকাল আদালতে তানভীর ও তুষারের জামিন আবেদন করা হলে, তা নামঞ্জুর করেন আদালত। ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট এম এ সালাম শুনানি শেষে এ আদেশ দেন।
এদিকে দুদকের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান গতকাল সন্ধ্যায় সাংবাদিকদের বলেন, হলমার্ক গ্রুপের আর্থিক অনিয়মে জড়িত অন্য আসামিরা আদালতে আত্মসমর্পণ করতে পারেন। অভিযুক্তরা তা না করলে গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা হোটেল শাখা থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকা জালিয়াতির ঘটনায় কারা, কিভাবে সহায়তা করেছেন- সে ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য দিয়েছেন তানভীর মাহমুদ। তবে তদন্তের স্বার্থে বিস্তারিত কিছু জানাননি তাঁরা।
গতকাল দুপুর ১টায় তানভীর ও তুষারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রমনা মডেল থানা থেকে সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে নিয়ে আসা হয়। সেখানে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। হলমার্ক বিষয়ে দুদকের তদন্ত টিমের প্রধান মীর জয়নুল আবেদিন শিবলীর নেতৃত্বে কর্মকর্তারা তাঁদের জেরা করেন। জিজ্ঞাসাবাদে তানভীর ও তুষার অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন বলে কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন দুদকের উপপরিচালক মীর জয়নুল আবেদিন শিবলী। তবে নতুন কী তথ্য পাওয়া গেছে- সে বিষয়ে কিছুই বলতে রাজি হননি দুদকের এ কর্মকর্তা। এর আগে সোমবার তাঁদের প্রথম দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের গতকাল ছিল প্রথম দিন।
তানভীর ও তুষারকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের কৌশল সম্পর্কে আজ দুর্নীতি দমন কমিশন নতুন করে কিছু সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন দুদকের তদন্তসংশ্লিষ্ট এক মহাপরিচালক। তিনি গতকাল রাতে কালের কণ্ঠকে জানান, দুদকের চেয়ারম্যান আজ এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ডেকেছেন।
আমাদের আদালত প্রতিবেদক জানিয়েছেন, অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে রমনা থানায় দায়ের করা পৃথক আটটি মামলায় গতকাল ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের বিশেষ অনুমতি নিয়ে আদালতে তানভীর ও তুষারের জামিন আবেদনের শুনানি করা হয়। পরে আদালত আবেদন নামঞ্জুর করেন। জামিনের আবেদন নাকচ হওয়া আটটি মামলায় তাঁদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। এ মামলাগুলোতে পর্যায়ক্রমে রিমান্ডের আবেদন করা হবে বলে জানিয়েছেন দুদকের স্পেশাল পিপি মোশাররফ হোসেন কাজল।
সোমবার একই অভিযোগে দুদকের দায়ের করা অন্য তিন মামলার প্রতিটিতে তানভীর মাহমুদ ও তুষার আহমেদের আট দিন করে ২৪ দিন রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। এর বাইরে অস্ত্র মামলায় তানভীরকে আরো পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।
হলমার্কের সব ইউনিটে প্রশাসক নিয়োগের দাবি শ্রমিকদের : এদিকে হলমার্ক গ্রুপের সব ইউনিটে প্রয়োজনে সরকারের পক্ষ থেকে প্রশাসক নিয়োগ করে হলেও কারখানাগুলো চালু রাখার দাবি জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন ইউনিটের শ্রমিকরা। তাঁরা সোনালী ব্যাংকের টাকা আদায়ের পাশাপাশি শ্রমিকদের চাকরির নিশ্চয়তা চান। গতকাল দুপুরে রাজধানীর তোপখানা রোডে গার্মেন্ট শ্রমিকদের সংগঠন জাগো বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক ফেডারেশন আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে হলমার্কের শ্রমিকরা সরকারের কাছে এ দাবি জানান।
সংবাদ সম্মেলনে, হলমার্ক গ্রুপের প্রতিষ্ঠান জিসান গার্মেন্টের কোয়ালিটি কন্ট্রোলার আইয়ুব হোসেন বলেন, 'আমরা শ্রমিক, আমাদের কোনো দোষ নেই। ঋণের ক্ষেত্রে অনিয়ম হলে সরকার দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিক। কিন্তু প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলে আমাদের রুটি-রুজিতে আঘাত আসবে।'
আইয়ুব জানান, বর্তমানে হলমার্ক গ্রুপের কোনো ইউনিটে কাজ নেই। বায়াররা কাজ দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন এবং আগের সব অর্ডার বাতিল করে দিয়েছেন।
সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন শ্রমিক নেতা মো. মোস্তফা, অন্তর রহমান, মো. মাসুদ, শামীম আহমেদ প্রমুখ।
সোনালী ব্যাংকের আট কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ : সোনালী ব্যাংক আগারগাঁও শাখায় ১৪১ কোটি টাকা জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গতকাল সোনালী ব্যাংকের আট কর্মকর্তাকে দুদক জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। দুদকের জ্যেষ্ঠ উপপরিচালক বেনজীর আহমেদ গতকাল দুদক কার্যালয়ে তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন।
তাঁরা হলেন সোনালী ব্যাংকের আগারগাঁও শাখার কর্মকর্তা চৌধুরী আলী আকবর, নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোখলেছ, নির্বাহী কর্মকর্তা আবুল কালাম, জ্যেষ্ঠ নির্বাহী কর্মকর্তা এস ওবায়দুর রহমান, জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আরিফ, হাসান আলভি, সাবেক দুই ব্যবস্থাপক সাঈদুর আলম ও মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম।
দুদকের কর্মকর্তারা জানান, ব্যাংকের আগারগাঁও শাখা থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করা ১৪১ কোটি টাকার কতটুকু হলমার্ক এবং কতটুকু অন্যান্য প্রতিষ্ঠান নিয়েছে, তা খতিয়ে দেখার জন্য কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
আরো চার প্রতিষ্ঠানকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে দুদক : সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখা থেকে ঋণ কেলেঙ্কারির অভিযোগে আরো চার প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নোটিশ দিয়েছে দুদক।
প্রতিষ্ঠানগুলো হলো নকশি নিট, টি অ্যান্ড ব্রাদার্স, প্যারাগন গ্রুপ ও খান জাহান আলী সোয়েটার্স লিমিটেড। দুদকের জনসংযোগ বিভাগের কর্মকর্তা ও উপপরিচালক প্রণব কুমার ভট্টাচার্য কালের কণ্ঠকে জানান, আগামী রবিবার এ চার প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান, পরিচালক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। সোমবার বিকেলে নোটিশ পাঠানো হয়েছে বলে তিনি জানান।
ভাতিজা, স্ত্রীর অ্যাকাউন্টে ১০০ কোটি টাকা সরিয়েছেন তানভীর : সোনালী ব্যাংক থেকে আত্মসাৎ করা দুই হাজার ৬৬৮ কোটি টাকার মধ্যে প্রায় ১০০ কোটি টাকা স্ত্রী জেসমিন ইসলাম এবং এক ভাতিজাসহ কয়েকজন নিকটাত্মীয়ের ব্যাংক হিসাবে জমা করেছেন তানভীর মাহমুদ। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদে হলমার্ক গ্রুপের এমডি গতকাল এ তথ্য দেন। নগদ অর্থ ও উপঢৌকন দিয়ে ব্যাংক কর্মকর্তাদের হাত করে তিনি ঋণ জালিয়াতির কাজটি করেছেন বলে তদন্ত কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন।
দুদকের নির্ভরযোগ্য একটি সূত্রে জানা যায়, প্রথম দিকেই তানভীর এবং তাঁর ভায়রা তুষার আহমেদের কাছ থেকে জানতে চাওয়া হয়, জালিয়াতি করে টাকা নিতে ব্যাংকের কোন কোন কর্মকর্তা সহায়তা করেন তাঁদের। জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে তানভীর ব্যাংকের বিভিন্ন স্তরের ২০ জনের অধিক কর্মকর্তার নাম বলেন। সহায়তার বিনিময়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ ও বিভিন্ন ধরনের উপহার দিয়েছিলেন বলেও তিনি দাবি করেন। ব্যাংক কর্মকর্তাদের টাকা দেওয়ার কোনো দালিলিক প্রমাণ আছে কি না, জানতে চাইলে তানভীর বলেন- 'এমন পরিস্থিতি হবে জানতে পারলে ঠিকই প্রমাণ রাখতাম।'
আত্মসাৎ করা টাকা কোথায় সরানো হয়েছে- দুদক কর্মকর্তাদের এমন প্রশ্নের জবাবে তানভীর বলেন, তাঁর এক ভাতিজা, স্ত্রী জেসমিন ইসলাম ও কয়েকজন নিকটাত্মীয়ের ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবে প্রায় শত কোটি টাকা তিনি জমা রেখেছেন।

No comments

Powered by Blogger.