শিল্পী সংগ্রামী অজিত রায় by ফকির আলমগীর

দেখতে দেখতে একটি বছর চলে গেল, শিল্পী সংগ্রামী অজিত রায় আর আমাদের মাঝে নেই। গেল বছর ৪ সেপ্টেম্বর রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে আজীবন লড়াকু সৈনিক অজিত রায় মরণব্যাধি ক্যান্সারের সঙ্গে যুদ্ধ করে মাত্র ৭৩ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। অসম সাহসী অজিত রায়ের কণ্ঠ থেমে গেলেও থেমে যায়নি রেশ।


আলো-অন্ধকার পৃথিবীর মুগ্ধতা আর অগণিত মানুষের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও দুঃখবোধের অশ্রুকে নিজের বিশালতার মাঝে ধারণ করে, স্বাধীন বর্ণবিহারে শৃঙ্খলভাঙা সুরের অন্বেষণে চলে গেছেন কিংবদন্তি শিল্পী অজিত রায়। জীবনে সবসময় সুন্দরকে আলিঙ্গন করে দরাজকণ্ঠে গণমানুষের গান করেছেন তিনি। মহীরুহসম এ দেশপ্রেমিক শিল্পীর কত না পরিচয়_ গণগঙ্গীত, রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী, সুরকার, শিক্ষক, সংগঠক, সঙ্গীত পরিচালক, অভিনেতা, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠযোদ্ধা আরও কত কি। আমার দৃষ্টিতে অজাতশত্রু, অসমসাহসী, নিরহঙ্কারী, বিনয়ী অজিদদা কেবল দেশপ্রেমিকই নন, তিনি ছিলেন মানুষের বন্ধু এবং উদারমনা মানুষ। পাকিস্তানের দুঃশাসনবিরোধী রাজনৈতিক সংগ্রামের নিরন্তর অভিযাত্রায় অজিত দা ছিলেন অবিরাম শিল্পী সংগ্রামী। সেই ষাটের দশক থেকে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তাকে পেয়েছি আন্দোলন সংগ্রামের পুরোভাগে। মুক্তিযোদ্ধা এ শিল্পী ছিলেন প্রকৃত অর্থে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী বলিষ্ঠপ্রাণ লড়াকু সৈনিক। সাম্রাজ্যবাদ, সন্ত্রাসবাদ, যুদ্ধবাজদের বিরুদ্ধে অজিত রায় ছিলেন আদর্শিক এক গণগায়ক। ষাটের দশকের মধ্যভাগে ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠীর মাধ্যমে সঙ্গীত বলয়ে প্রবেশ করেই আমার যে কয়জন গণসঙ্গীত ব্যক্তিত্বের সানি্নধ্যে আসার সুযোগ হয়েছে অজিত রায় তাদের অন্যতম। সে থেকেই তার ব্যক্তিত্ব আমার কাছে অনুসরণীয় হয়ে ওঠে। গণসঙ্গীত, রবীন্দ্রসঙ্গীত কিংবা অনন্য এক সঙ্গীত পরিচালকের চেয়েও তার অসাধারণ ব্যক্তিত্ব আর গুরুগম্ভীর আবার কখনও বজ্রকণ্ঠে স্বদেশের গান আমাকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করে। বিশেষ করে ষাটের দশকের শেষদিকে জহির রায়হানের 'জীবন থেকে নেওয়া' ছবিতে অজিত দাসহ কয়েকজন শিল্পী সমবেত কণ্ঠে আমাদের জাতীয় সঙ্গীত গেয়েছিলেন। তাদের গাওয়া জাতীয় সঙ্গীত সত্তর সালেই প্রতিটি বাঙালির মনে স্বাধীনতার বীজমন্ত্র বুনে দিয়েছিল। এ ছাড়া বিভিন্ন ছায়াছবিতে তার গাওয়া 'কেন চোখের জলে ভিজিয়ে দিলেম না', 'ও আমার দেশের মাটি', 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি', 'কারার ঐ লৌহ কপাট' কিংবা 'জাগো অনশন বন্দি ওঠরে যত জগতের লাঞ্ছিত ভাগ্যহত' গানগুলো পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্তির এক আবহ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল। ভাবতে ভালো লাগছে ষাটের দশকে বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে এ মহীরুহসম শিল্পীর সঙ্গে গণসঙ্গীত পরিবেশন করার সুযোগ ঘটে। বিশেষ করে গণশিল্পী নিজামুল হক ও কামাল লোহানীর স্নেহধন্য অজিত রায়ের সঙ্গে সাধন ঘোষ, মনু ভাইসহ ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠী এবং গণশিল্পীগোষ্ঠীর শিল্পীর সঙ্গে বিভিন্ন সমাবেশে গান করেছি। অজিতদার সঙ্গে কণ্ঠ দিয়েছি নিজামুল হকের 'কোথায় যেন দেখেছি' ছায়াছবিতে। এ ছাড়া স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে তার একজন সহশিল্পী হওয়ার দুর্লভ সৌভাগ্য আমাকে আজও অনুপ্রাণিত করে। অজিত রায় ষাটের দশকের আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং সর্বোপরি '৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগ দিয়ে পুরো বাঙালির উৎস হয়ে ওঠেন তিনি।
রুচিবান এ কণ্ঠযোদ্ধা সত্য, সুন্দর এবং সুরের মধ্য দিয়ে এক নির্মোহ শিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। কোনো অভিযোগ-অভিমান ছিল না এ শিল্পীর। লোভ-লালসার কাছে নিজেকে কখনও বিক্রি করেননি। সব কিছু থেকে বঞ্চিত থেকেও সুখে থেকেছেন চিরদিন। সত্যিকার অর্থেই তিনি দেশকে, বাংলা ভাষাকে, বাংলার মানুষকে ভালোবেসেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, মাইকেল, সুকান্ত, জীবনানন্দ দাশ, কবি শামসুর রাহমানসহ অনেক কবির কালজয়ী কবিতায় সুর করে তার অকৃত্রিম ভালোবাসার প্রমাণ রেখেছিলেন।
আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, অজিতদা গণসঙ্গীত, রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুল সঙ্গীত, দেশের গান ছাড়াও মিষ্টি আধুনিক গানের সুরকার ছিলেন যেমন_ সুখ তুমি কী, ঐ চকচকে কালো চুলের চেয়ে, স্মৃতি বড় জ্বালা ইত্যাদি। খ্যাতিমান কণ্ঠশিল্পী রুনা লায়লাসহ অনেকে তার আধুনিক গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। এ ছাড়া 'একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতা' দেশের গানটি সাবিনা ইয়াসমীনের কণ্ঠে ব্যাপক সাড়া ফেলে। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস তার কণ্ঠে 'ও আমার দেশের মাটি', 'আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে', 'জাগো অনশন বন্দি ওঠরে যত', 'বিচারপতি তোমার বিচার', 'স্বাধীন স্বাধীন দিকে দিকে', 'বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি', 'বিজয় নিশান উড়ছে ঐ', গানগুলো পুরো জাতিকে উদ্দীপ্ত করেছিল। তার সুরারোপিত 'চাঁদ তুমি ফিরে যাও/আজি সপ্ত সাগর ওঠে/শৃঙ্খলভাঙা সুর বাজে/স্বাধীন স্বাধীন দিকে দিকে_ গানগুলো ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।
ষাটের দশকের গণজাগরণ, মহান মুক্তিযুদ্ধের কণ্ঠসৈনিক, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব অজিত রায়ের শূন্যতা কিছুতেই পূরণ হওয়ার নয়। কেবল গণসঙ্গীত নয়, দেশাত্মবোধক, রবীন্দ্র, নজরুল, সুকান্ত ও দ্বিজেন্দ্র সঙ্গীত গেয়েও তিনি জনগণকে উদ্দীপ্ত করেছিলেন। আজ বেশি করে মনে পড়ছে এ দেশের গণতন্ত্র ও স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সবসময়ই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোতে অজিত রায় কিংবা রথুদা ছিলেন অপরিহার্য। তিনি আজ আর আমাদের মাঝে নেই। তবু তার প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়নি। একথাটি আমরা বেশি করে উপলব্ধি করতে পারলাম। গেল বছর দেশব্যাপী 'গণসঙ্গীত সমন্বয় পরিষদ' আয়োজিত গণসঙ্গীত উৎসব আয়োজনে। বরেণ্য গণসঙ্গীত শিল্পী অজিত রায় আমাদের উৎসাহিত করেছিলেন অসুস্থ অবস্থায় কুমিল্লায় অনুষ্ঠিত সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগীয় উৎসবে যোগ দিয়ে। গেল বছর এপ্রিলে অনুষ্ঠিত গণসঙ্গীত উৎসবেও তিনি ছিলেন। আজ আর তিনি আমাদের মধ্যে নেই; কিন্তু রয়ে গেছে তার অবদান। দৃশ্যত এ মানবপ্রেমিক, সুর সাধক বিনয়ী, অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে চিরদ্রোহী শিল্পী জীবনের শেষ খেয়ায় যাত্রী হয়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন। কিন্তু রেখে গেছেন তার অমর সৃষ্টি, কালজয়ী সুর এবং দেশপ্রেম, প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম তার দরাজ গলার গণসঙ্গীতে উদ্দীপ্ত হবে। ইথারে ইথারে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হবে তার অবিনাশী সুর 'বঙ্গবীর', চির উন্নত মমশীর।
 

No comments

Powered by Blogger.