একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, বিপন্ন মানবতা ॥ বাঙালীর দুর্দশার ইতিহাস- গীনসবার্গের কবিতা সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড by সাজেদ রহমান

‘লক্ষ শিশু দেখছে আকাশ অন্ধকার/উদর স্ফীত, বিস্ফোরিত চোখের ধার/ যশোর রোডে-বিষণ্ণ সব বাঁশের ঘর/ ধুঁকছে শুধু, কঠিন মাঠির নিরুত্তর।’ আমেরিকার কবি এ্যালেন গীনসবার্গ ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কলকাতা থেকে যশোর সীমান্তে আসেন এবং কয়েকটি শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন।


তার পর লেখেন এই বিখ্যাত কবিতা ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। তাঁর কবিতায় তখনকার প্রকৃত অবস্থা তিনি বর্ণনা করেছেন।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একটি অবহেলিত দিগন্ত কী অপূর্ব প্রেমময়তায় একজন আমেরিকান কবির কবিতায় উঠে এসেছে। একাত্তরের শরণার্থীদের দুঃখদুর্দশা, তাদের ওপর বর্বর পাকসেনাদের অত্যাচার এবং ভারতের শরণার্থী শিবিরগুলোতে তাদের প্রাত্যহিক দিন যাপনের গ্লানির চিত্র এমন বিশ্বস্ততার সঙ্গে, বিদেশী কবি হয়ে, মাত্র একদিনের দেখার অভিজ্ঞতা থেকে কীভাবে আঁকতে পারেন তা অনেকে ভেবে পান না।
মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের স্বঘোষিত প্রবক্তা, আমেরিকার সেই সময়ের ভূমিকাকে গীনসবার্গ তাঁর ওই কবিতায় যে ভাবে ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ করেছেন, তাতে এই দেশের মানুষ তাকে এখনও শ্রদ্ধা করেন। শুধু তাই নয়, ১৯৭১ সালে সারা ভারতবর্ষেই গীনসবার্গের দীর্ঘ কবিতাটি পোস্টারের মতো বিরাটাকৃতির কাগজে ছেপে বিক্রি করা হয়েছিল। কবিতার বিক্রয়লব্ধ টাকা বাংলাদেশের শরণার্থীদের ফান্ডে জমা দেয়া হয়েছিল।
আর ভারতের বিখ্য্যাত শিল্পী মৌসুমী ভৌমিক যশোর রোড নিয়ে গান করেছেন। যশোর রোড নিয়ে আরও ইতিহাস আছে। যশোরের বকচরের জমিদার কালী পোদ্দার যশোর থেকে পশ্চিমবঙ্গের গঙ্গা নদীর ঘাট পর্যন্ত ৮০ কিলোমিটার সড়কে লাগিয়েছিলেন রেইনট্রি গাছ। সেগুলো এখনও ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। জানা যায়, জমিদার কালী পোদ্দার ছিলেন কৃপণ প্রকৃতির মানুষ। তার মা গঙ্গা স্নানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন। কিন্তু বজরার মাঝি তার মাকে নেয়নি। শুধু তাই নয়, মাঝি কালী পোদ্দারের মাকে বলেন, তুমাকে নিলে এক পয়সাও পাওয়া যাবে না। সেখান থেকে ফিরে এই কথা কালী পোদ্দারকে জানান তার মা। এরপর কালী পোদ্দার যশোর থেকে গঙ্গা তীরবর্তী গাছ লাগানো এবং রাস্তা নির্মাণ শুরু করেন ১৮৪০ সালে। হাজার হাজার শ্রমিক রাত-দিন কাজ করে ১৮৪২ সালে সড়ক নির্মাণের কাজ শেষ করেন। সে সময় সড়ক নির্মাণে ২ লাখ ৫৮ হাজার কড়ি ব্যয় হয়েছিল। সেই বৃক্ষগুলো যশোর-বেনাপোল রোডকে এখনও ছায়া দিচ্ছে। অনেক গাছ মরে গেছে। অনেক গাছ চুরি হয়ে গেছে। এই গাছের ছায়ায় ১৯৭১ সালে লাখ লাখ শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছিল ভারতের অংশে। সেই শরণার্থী শিবির ঘুরে এ্যালেন গিনসবার্গ দীর্ঘ কবিতা লিখেছিলেন। নাম ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’।
প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাস এলে অনেকে গীনসবার্গের সেই কবিতার কথা মনে করেন। মনে করেন এ্যালেন গীনসবার্গের কথা। বিশাল গাছের নিচে দিয়ে ছায়ায় যাবার সময় অনেকে নস্টালজিয়ায় ভোগেন। স্বাধীনতার পর এই রোড দিয়ে কলকাতা থেকে যশোরে আসেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম।

No comments

Powered by Blogger.