রাজনৈতিক সমঝোতা হবেই : মজিনা-ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপ পরিদর্শন

গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া থেকে বাংলাদেশের বিচ্যুত হওয়ার শঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান ডাব্লিউ মজিনা বলেছেন, 'এ দেশ অবশ্যই গণতান্ত্রিক, আরো গণতান্ত্রিক হবে এবং হতেই হবে।' গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতার জন্য আগামী নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে মজিনা বলেন, দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে শিগগিরই সমঝোতা হবে, হবেই হবে। জোর আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, বিশ্ব দ্রুত বদলাচ্ছে।


চীন থেকে বিনিয়োগ অন্যত্র সরে যাচ্ছে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক সমঝোতা হলে ওই বিনিয়োগগুলো এ দেশেই আসবে।
গতকাল সোমবার ঢাকার বারিধারায় বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় বসুন্ধরা গ্রুপের ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপ লিমিটেড পরিদর্শনের সময় এ গ্রুপের দৈনিক কালের কণ্ঠ, বাংলাদেশ প্রতিদিন, ডেইলি সান ও বাংলানিউজটোয়েন্টিফোরডটকমের সম্পাদক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত এসব কথা বলেন। বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ককে 'চমৎকার' আখ্যায়িত করলেও গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে উদ্বেগের কথা জানান তিনি। বাংলাদেশকে বিপুল সম্ভাবনার দেশ হিসেবে তুলে ধরে এর উন্নয়নে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের জোরালো সহযোগিতার বিবরণ দেন তিনি।
মতবিনিময় অনুষ্ঠানে বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান গণতন্ত্র চর্চায় সংবাদমাধ্যমের গুরুত্ব তুলে ধরে জনগণের পক্ষে কথা বলতে এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান বিকাশে সহায়তা দিতে ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের সংকল্পের কথা জানান।
অনুষ্ঠানের শুরুতে ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপ লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন কালের কণ্ঠ, বাংলাদেশ প্রতিদিন, ডেইলি সান ও বাংলানিউজটোয়েন্টিফোরডটকম এবং বসুন্ধরা গ্রুপ সম্পর্কে রাষ্ট্রদূতকে অবহিত করেন। তাঁর কাছ থেকে সম্পূর্ণ দেশি ও নিজস্ব বসুন্ধরা পেপার মিলে উৎপাদিত কাগজে এবং বিশ্বমানের ছাপাখানায় ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের সংবাদপত্রগুলো ছাপা হওয়ার কথা শুনে রাষ্ট্রদূত উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। এ সময় বসুন্ধরা গ্রুপের প্রধান উপদেষ্টা মাহাবুব মোর্শেদ হাসান উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে কালের কণ্ঠ সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন, বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম, ডেইলি সানের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক আমির হোসেন, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোরডটকমের এডিটর ইন চিফ আলমগীর হোসেন নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের পক্ষে রাষ্ট্রদূত মজিনাকে ক্রেস্ট উপহার দেন।
অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন বসুন্ধরা গ্রুপের মিডিয়া উপদেষ্টা আবু তৈয়ব। মতবিনিময় শেষে রাষ্ট্রদূত মজিনা কালের কণ্ঠ, বাংলাদেশ প্রতিদিন, ডেইলি সান ও বাংলানিউজের বার্তাকক্ষসহ বিভাগগুলো ঘুরে দেখেন। গতকাল দুপুর ১২টায় রাষ্ট্রদূত মজিনা ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপ কমপ্লেক্সে এলে তাঁকে অভ্যর্থনা জানান কালের কণ্ঠ, বাংলাদেশ প্রতিদিন, ডেইলি সান ও বাংলানিউজের সম্পাদকরা। এরপর সম্মেলন কক্ষে তিনি মতবিনিময় করেন। অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রদূত মজিনা ও বসুন্ধরা গ্রুপ চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহানের সংক্ষিপ্ত জীবনবৃত্তান্ত তুলে ধরেন গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর হোমল্যান্ড সিকিউরিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট, বসুন্ধরা গ্রুপের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা গোলাম মেহরাজ।
মতবিনিময় অনুষ্ঠানে বসুন্ধরা গ্রুপ চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান ডাব্লিউ মজিনাকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, আজ যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত দেশের বৃহত্তম গণমাধ্যম গ্রুপের সম্পাদক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ে এসেছেন। বাংলাদেশে রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব শুরুর পর থেকেই ড্যান ডাব্লিউ মজিনা বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বাড়াতে ধৈর্যের সঙ্গে কূটনৈতিক প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি নিজেকে বাংলাদেশের সত্যিকারের বন্ধু হিসেবে প্রমাণ করেছেন। তাঁর উদ্যোগ বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক আরো জোরদারে সহায়ক হবে বলে আশা করে বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান বলেন, 'উন্নয়নশীল দেশে গণতন্ত্রচর্চায় মুক্ত ও কার্যকর সংবাদমাধ্যমের গুরুত্ব আমরা অনুধাবন করতে পারি। ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপ প্রতিষ্ঠার অন্যতম লক্ষ্য ছিল অবাধ, সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদমাধ্যমের প্লাটফর্ম তৈরি করা।'
বসুন্ধরা চেয়ারম্যান বলেন, 'জনগণের পক্ষে কথা বলতে এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান বিকাশে সহায়তা দিতে আমরা সংকল্পবদ্ধ।'
ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন তাঁর বক্তব্যে বলেন, এর আগে যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে তিনি সে দেশের কংগ্রেসের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি কমিটির চেয়ারম্যান পিটার কিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশের সন্ত্রাস দমনে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সহযোগিতা কামনা করেছিলেন। তাঁর মাধ্যমে তিনি এ বিষয়ে আশ্বাস পেয়েছিলেন এবং যুক্তরাষ্ট্র সরকার এখন সেটা পূরণ করছে। তিনি আরো বলেন, পরে কংগ্রেসম্যান পিটার কিং এই সহযোগিতা আরো জোরদারের জন্য হোমল্যান্ড সিকিউরিটির উপদেষ্টা হিসেবে শেখ আবদুল হাইকে নিয়োগ দেন। তিনিও সরকারের বিভিন্ন এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করে এ দেশে সন্ত্রাস দমন কার্যক্রম জোরদারের চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
রাষ্ট্রদূত ড্যান ডাব্লিউ মজিনা স্বাগত বক্তব্যে বলেন, 'বাংলাদেশ সত্যিই আশীর্বাদপুষ্ট। এটি আমি জানি, কারণ চার বছর আগে আমি এখানে ছিলাম। আমি এ দেশের অনেক এলাকায় ঘুরে এটি জেনেছি। রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে আমি ৬৪টি জেলার সবগুলোই সফর করব। আমি দেখেছি, ঈশ্বর কিভাবে এ দেশকে আশীর্বাদ করেছেন। ঈশ্বর এ দেশে অনেক উর্বর মাটি দিয়েছেন, এমন এক আবহাওয়া দিয়েছেন যেখানে বছরে তিন বার ফসল ফলানো যায়। এ দেশে পর্যাপ্ত পানি, প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা দিয়েছেন ঈশ্বর। সর্বোপরি ঈশ্বর এ দেশকে বিশ্বের সবচেয়ে অসাধারণ মানুষের ভূখণ্ড বানিয়েছেন।'
মজিনা বলেন, রাষ্ট্রদূত হিসেবে রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের কাছে পরিচয়পত্র পেশ করার সময় তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন যে এ দেশের জনগণ অনেক কর্মঠ, প্রগতিশীল, সৃষ্টিশীল, উদার, উৎসাহী ও প্রাণোচ্ছল। রাষ্ট্রদূত বলেন, গত আট-নয় মাস ধরে বাংলাদেশে রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি বাংলাদেশের জনগণের এ বৈশিষ্ট্যের কারণ খুঁজেছেন। তিনি সেই প্রশ্নের উত্তর পেয়েছেন। তিনি বলেন, 'আমি এবং আমার স্ত্রী বাংলাদেশে আসতে পেরে অনেক খুশি। এর কারণ, আমরা বাংলাদেশেই আসতে চেয়েছিলাম।' রাষ্ট্রদূত বলেন, বাংলাদেশের জনগণের কারণেই তিনি ও তাঁর স্ত্রী এ দেশে আসতে চেয়েছিলেন। মজিনা বলেন, 'আমি এ জনগণকে বলি ব্যতিক্রমী। আমি সুনিশ্চিত যে ১৫ কোটি জনগণ এ দেশকে সত্যিকারের সোনার বাংলা, মধ্যম আয়ের দেশ, এশিয়ার পরবর্তী বাঘ হিসেবে গড়ার প্রচেষ্টায় সফল হবেই।'
মজিনা আরো বলেন, 'আপনারা অনেকে শুনেছেন, আমি এ দেশকে আগামীর রয়েল বেঙ্গল টাইগার হিসেবে আখ্যায়িত করেছি। কারণ আমি এটি দেখেছি। এ দেশের তৈরি পোশাক কারখানা পরিদর্শনকালে আমি এটি দেখেছি। এ দেশকে বিশ্বে তৈরি পোশাক পণ্যের সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে চিন্তা করার সময় আমি এর ভবিষ্যৎ দেখেছি।' তিনি বলেন, 'বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোনো দেশের পক্ষে এটি সম্ভব নয়। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি হাউসহোল্ড টেক্সটাইল পণ্য রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে এ দেশকে চিন্তা করার সময় আমি ওই সম্ভাবনা দেখেছি। সম্প্রতি এ দেশের ওষুধ কারখানা পরিদর্শনের সময়ও আমি এ সম্ভাবনা দেখেছি। চট্টগ্রামে জাহাজ নির্মাণ শিল্প-কারখানা পরিদর্শনের সময়ও আমি এ সম্ভাবনা দেখেছি। পাট শিল্প-কারখানা পরিদর্শনকালেও আমি এ সম্ভাবনা দেখেছি।' রাজশাহী সফরকালে তিনি রেশম নিয়ে গবেষণা দেখেছেন। রাষ্ট্রদূত বলেন, 'আমি ভাবি, বাংলাদেশ ৫০ টন রেশম উৎপাদন করছে এবং ব্যবহার করছে ৩০০ টন। অথচ এ দেশেরই হাজার হাজার টন রেশম উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে।'
রাষ্ট্রদূত আরো বলেন, এ দেশে চীনের মতো অনেক পণ্য তৈরি হচ্ছে। তিনি এ দেশের চামড়াজাত পণ্যেরও প্রশংসা করেন। এ দেশে চলমান কৃষি বিপ্লব প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, 'এ দেশের ভবিষ্যৎ এত উজ্জ্বল হবে- এ কথা হয়তো একসময় বলা হতো না। কিন্তু আজ আমরা জানি, ওই ধারণা ঠিক নয়। বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। একদিন এ দেশ খাদ্য রপ্তানি শুরু করবে।'
রাষ্ট্রদূত বলেন, তিনি এ দেশে শিক্ষা বিপ্লবের সম্ভাবনা দেখতে পান। এ দেশের ৭০-৮০ লাখ অভিবাসী শ্রমিকের কেউ দক্ষ, কেউ আধা দক্ষ কেউ বা আবার অদক্ষ। কিন্তু তাঁরাই মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া সর্বোপরি বাংলাদেশ গড়েছেন।
বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক : রাষ্ট্রদূত মজিনা বরাবরই বলেন, বাংলাদেশে ফিরে আসা তাঁর জন্য ছিল স্বপ্ন। এই স্বপ্নের বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁর নিজ দেশ যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান সম্পর্ক মূল্যায়ন করতে বলা হলে তিনি বলেন, 'গত নভেম্বর মাসে বাংলাদেশে এসেই আমি বলেছিলাম, আমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। আমি আরো বলেছিলাম, আমি আমাদের দুই দেশের সম্পর্ককে আরো গভীর ও জোরালো করার ম্যান্ডেট নিয়ে এসেছি। কয়েক দিন পরই বলেছিলাম, আমি সেই দিনের অপেক্ষায় আছি, যেদিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশ সফরে আসবেন। আমি আরো বলেছিলাম, আমি সেই দিনের অপেক্ষায় আছি, যেদিন বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অংশীদার সংলাপের ঘোষণা স্বাক্ষর হবে।' রাষ্ট্রদূত বলেন, 'আপনারা জানেন, এ সবই হয়েছে। আর এটিই আমার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেওয়া।'
রাষ্ট্রদূত আরো বলেন, 'আমি বিশ্বাস করি, যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের অভিন্ন অনেক মূল্যবোধ রয়েছে। আমাদের অনেক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এক। আর উভয় দেশের স্বার্থে একসঙ্গে কাজ করে আমরা অনেক সাফল্য অর্জন করতে পারি।'
রাষ্ট্রদূত বলেন, 'জঙ্গি ও সন্ত্রাস দমন, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শান্তি উন্নয়ন, স্থিতিশীলতা রক্ষায় দুই দেশ একসঙ্গে কাজ করতে পারে। আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশ বৃহত্তম অংশগ্রহণকারী দেশ। আমরা এতে সহযোগিতা দিই।'
মজিনা বলেন, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধিতেও দুই দেশ কাজ করছে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের একক বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশি পণ্যের বৃহত্তম বাজার। তিনি আরো বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে বৃহত্তম বিনিয়োগকারী দেশ। আমরা রেমিট্যান্সের তৃতীয় বৃহত্তম উৎস। তবে এ ক্ষেত্রে আমি আরো অনেক কিছু করতে চাই। আমাদের অংশীদার এজেন্ডা ও মূল্যবোধ রয়েছে। এগুলো হলো গণতন্ত্র, মানবাধিকারের প্রতি সম্মান দেখানো। আর যুক্তরাষ্ট্র অবশ্যই মানবিক স্বার্থ জোরদারে বাংলাদেশের সঙ্গে অংশীদার হতে চায়।'
রাষ্ট্রদূত বলেন, 'আমরা বাংলাদেশে ৫৪৭টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণ করেছি। আমরা আরো ১৬০টি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করছি।'
রাষ্ট্রদূত মজিনা জানান, গত নভেম্বর মাসে বাংলাদেশে আসার পর থেকে দুই দেশের সম্পর্কে যে অগ্রগতি হয়েছে, তাতে তিনি সন্তুষ্ট। তবে তিনি মনে করেন, এটি কেবলই শুরু।
নির্বাচন নিয়ে সমঝোতা : বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়া নিয়ে শঙ্কা এবং প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সম্পর্কোন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাষ্ট্রদূত মজিনা বলেন, 'বাংলাদেশ অবশ্যই গণতান্ত্রিক হবে এবং হতে হবে। বাংলাদেশে অন্য ধরনের সরকারের অভিজ্ঞতা রয়েছে। তবে সেগুলো তেমন সফল হয়নি। আমি বাংলাদেশকে যতই জানছি এবং বাংলাদেশের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা পাচ্ছি, আমি ততই নিশ্চিত যে এ দেশ কেবল গণতান্ত্রিকই হতে পারে।' রাষ্ট্রদূত বলেন, 'গণতন্ত্র পেতে হলে গণতন্ত্রের অংশ হিসেবে একটি অর্থবহ নির্বাচন ব্যবস্থা থাকতে হয়, যেখানে জনগণ তাদের পছন্দ জানাতে পারে। অর্থবহ নির্বাচন ব্যবস্থা পেতে হলে বড় অংশীদারগুলোর অংশগ্রহণ প্রয়োজন। এ জন্য তাদের মধ্যে সমঝোতা প্রয়োজন।'
মজিনা বলেন, 'আমার কূটনৈতিক প্রতিবেদক বন্ধুদের নিশ্চয়ই মনে আছে, আমি আশা করি, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো আজ বিকেলেই আলোচনায় বসবে। তারা গঠনমূলক আলোচনা করবে। তারা পরস্পরকে চেনে। তারা অনেকে একই পরিবারের। আবার একই পরিবারে অনেকে বিয়েও করেছেন। এখানে কোনো রহস্য নেই। সবাই সবাইকে চেনেন।' রাষ্ট্রদূত বলেন, 'আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, এ দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা হবেই। তবে সেটি কখন তা আমি জানি না।' এরপর রাষ্ট্রদূত রসিকতা করে বলেন, 'এখন ১টা বাজে। আমার উপায়ে আলোচনা হলে ৩টার মধ্যে সমঝোতা হবে বলে আমি আশাবাদী।'
রাষ্ট্রদূত বলেন, 'এই সমঝোতা হওয়া খুবই জরুরি। আর আমি এর কারণ বলছি- বিশ্ব বদলাচ্ছে। আর তা অত্যন্ত দ্রুত। অনেক তৈরি পোশাক কারখানা চীন থেকে সরে যাচ্ছে। আজই পত্রিকায় বাংলাদেশ থেকে এক বিলিয়ন ডলার পণ্য রপ্তানির সম্ভাবনার খবর দেখে আমি হেসেছি। এটি ৫০ বিলিয়ন ডলার হতে পারে বলে আমি মনে করি।'
রাষ্ট্রদূত বলেন, 'আমি মনে করি, আজ বিকেলেই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা হওয়া উচিত। কারণ চীন থেকে যেসব বিনিয়োগকারী নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছে তারা অন্যত্র গন্তব্য খুঁজছে। বাংলাদেশই হতে পারে তাদের গন্তব্য।'
গ্রামীণ ব্যাংক ইস্যু : গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিদায় এবং পরে ব্যাংকের অধ্যাদেশ সংশোধন ইস্যুতে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে টানাপড়েন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাষ্ট্রদূত বলেন, 'একটা বিষয় স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক চমৎকার। গত ৫ মে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ও দীপু মনির বৈঠকে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আলাদাভাবে সাক্ষাতে ঠিক এ কথাই হয়েছে। সম্পর্ক চমৎকার। চমৎকার মানে চমৎকার। শূন্য কূটনৈতিক কৌশলে চমৎকার নয়। অভিধানে চমৎকার বলতে যা বোঝায় ঠিক সেই অর্থেই চমৎকার।'
রাষ্ট্রদূত বলেন, 'আমরা অনেক খাতে পরস্পরকে সহযোগিতা করি। সন্ত্রাসবাদ, সামরিক খাতে সহযোগিতা বেশ জোরালো। আমরা সমুদ্র এলাকা রক্ষায় বাংলাদেশকে সহযোগিতা করছি। সমুদ্র এলাকার নিরাপত্তা জোরদার, দস্যুতা রোধ, মানব ও মাদক পাচার প্রতিরোধ, অস্ত্র চোরাচালান ঠেকানো, সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, সমুদ্রসম্পদ রক্ষা, মাছ শিকারসহ আরো অনেক খাতে আমাদের সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে।'
রাষ্ট্রদূত আরো বলেন, 'স্বাস্থ্য খাতে আমরা দুই দেশ একসঙ্গে কাজ করছি মা ও শিশু মৃত্যুহার কমানোর লক্ষ্য নিয়ে। মা ও পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যু কমানো- সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার এ দুটি লক্ষ্যই বাংলাদেশ পূরণ করবে। এটি চমৎকার। আর এ ক্ষেত্রে আমাদের অংশীদারত্ব অব্যাহত রয়েছে।'
রাষ্ট্রদূত মজিনা বলেন, বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা জোরদারেও যুক্তরাষ্ট্র সহযোগিতা দিচ্ছে। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, জীবন-জীবিকার মানোন্নয়ন, শিশুদের পুষ্টিমানের উন্নয়নেও যুক্তরাষ্ট্র কাজ করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশকে সক্ষম করে তুলতে যুক্তরাষ্ট্র সহযোগিতা দিচ্ছে।
মজিনা বলেন, 'বন্ধুদের অনেক ইস্যু থাকে। আমাদের ও কানাডীয়দের মধ্যে ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে মাছ শিকার ইস্যু ছিল। আমরা এখন সমাধান পেয়েছি। বাংলাদেশে গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে আমাদের উদ্বেগের বিষয়টি সরকারের কাছে তুলেছি। গ্রামীণ ব্যাংক ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৯৮ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ঢাকায় দায়িত্ব পালনকালে এবং এমনকি আবার ফিরে আসার পর আমি গ্রামে যেতে ভালোবাসি। আমার মনে হয়, আমি ইতিমধ্যে পাঁচ থেকে ছয়বার গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ঋণগ্রহীতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। আমি দেখেছি, মানুষ নিজেদের ভাগ্যোন্নয়নে কী করছে।'
মজিনা বলেন, গ্রামীণ ব্যাংকের দর্শনকে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করে। আমেরিকাতেও গ্রামীণ ব্যাংক আছে। এটি জনগণকে সাহায্য করছে। গ্রামীণ ব্যাংকের স্বকীয়তা ও গুরুত্ব বজায় রাখতে আমরা সরকারের সঙ্গে একমত। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মজিনা আরো বলেন, 'গ্রামীণ ব্যাংকের স্বকীয় পরিচালন কাঠামো থাকা গুরুত্বপূর্ণ বলেও আমরা মনে করি। আপনারা ভাবুন, এটি একটি বিশাল ব্যাংক। এর ঋণগ্রহীতা ৮৩ লাখ। এর মধ্যে ৮১ লাখ নারী। তারাই আসলে গ্রামীণ ব্যাংককে পরিচালনা করে। এগুলো অনন্য ভাবনা। হতে পারে, অনেকে আজ এ ধারণা চুরি করেছে। তাই জনগণ ভুলে গেছে, গ্রামীণ ব্যাংকের ধারণাটি কতটা অনন্য ছিল। আমরা প্রত্যাশা করি, এ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তিনিই হবেন, যিনি এ ব্যাংকের ধারণার সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং এ ব্যাংকের প্রতি যাঁর দরদ আছে।'
টিকফা : বাংলাদেশের সঙ্গে প্রস্তাবিত বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা চুক্তি (টিকফা) স্বাক্ষর প্রক্রিয়ার অগ্রগতি সম্পর্কে প্রশ্নের উত্তরে রাষ্ট্রদূত বলেন, 'টিকফা খুবই সাধারণ একটি চুক্তি। অ্যাঙ্গোলায় রাষ্ট্রদূত থাকাকালে আমি ওই চুক্তি স্বাক্ষর করেছি। আমরা ওই চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলাম কারণ এটি একটি ফোরাম তৈরি করে, যা বছরে একবার বা দুবার বৈঠক করে বাণিজ্য ও বিনিয়োগে বাধাগুলো চিহ্নিত করা হয় এবং সেগুলো দূর করার ব্যাপারে আলোচনা হয়। এটিই টিকফা।'
রাষ্ট্রদূত বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়াতে চায়। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, টিকফা এ ক্ষেত্রে একটি ভালো ধারণা। তিনি বলেন, 'বাংলাদেশেরই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত যে টিকফা তাদের জন্য ভালো, না ভালো নয়। কারণ বাংলাদেশের জন্য যা ভালো তা-ই বাংলাদেশ সরকারের করা উচিত। বাংলাদেশকে চিন্তা করা উচিত, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্ক জোরদারে বাধাগুলো চিহ্নিত করতে টিকফা স্বাক্ষর করা ঠিক হবে কি হবে না। এটি জটিল কোনো বিষয় নয়।'
নতুন প্রচারণা : যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের এ সফর বসুন্ধরা গ্রুপ তথা বাংলাদেশের আবাসন খাতে বিনিয়োগকারী বাংলাদেশি আমেরিকানদের অনুপ্রাণিত করবে- গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর হোমল্যান্ড সিকিউরিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট গোলাম মেহরাজের এমন মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি আমেরিকান সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়ানোর জন্য আমি নতুন প্রচারণা শুরু করেছি। যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় পাঁচ লাখ বাংলাদেশি আছে। তারা দিন দিন উন্নতি করছে, রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হচ্ছে। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে তাদের আগ্রহ বাড়ছে।'
রাষ্ট্রদূত বলেন, 'এই গত জুন ও জুলাই মাসে আমি যুক্তরাষ্ট্রে ছিলাম। আমি ওয়াশিংটনে একটি গ্রুপের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। এরপর আমি নিউ ইয়র্ক, নিউ জার্সিতে আরো কজন বাংলাদেশি আমেরিকানের সঙ্গে দেখা করেছি। অন্যত্র গিয়েও বাংলাদেশি আমেরিকানদের সঙ্গে কথা বলেছি। পোর্টল্যান্ডে অবিশ্বাস্য কজন বাংলাদেশির দেখা পেয়েছি, যাঁরা ইন্টেলে কাজ করেন।'
রাষ্ট্রদূত বলেন, 'বাণিজ্য ও বিনিয়োগ এবং মানুষে মানুষে বিনিময় বাড়ানোর লক্ষ্যে বাংলাদেশি-আমেরিকানদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর সহযোগিতা দিচ্ছে।'
গণমাধ্যম : যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত বলেন, 'সব গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানকে আমি পছন্দ করি। বাংলাদেশের জন্য গণমাধ্যম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাংবাদিকরা জনগণকে বিভিন্ন বিষয়ে অবহিত করে। আর এটি সুশাসনের জন্য অপরিহার্য।'
গতকালের মতবিনিময় অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়ার নির্বাহী পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শেখ মুক্তাদির আরিফ, বাংলাদেশ প্রতিদিনের নির্বাহী সম্পাদক পীর হাবিবুর রহমান, কালের কণ্ঠের যুগ্ম সম্পাদক তৌহিদুর রহমান, যুগ্ম সম্পাদক ও বার্তা প্রধান চৌধুরী আফতাবুল ইসলাম, বাংলানিউজের হেড অব নিউজ মাহমুদ মেনন, ডেইলি সানের চিফ নিউজ এডিটর এস এম মোসলেম উদ্দিন আহমেদ, যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের প্রেস অ্যান্ড ইনফরমেশন অফিসার কেলি এস ম্যাকার্থি এবং হেড অব প্রেস সেকশন মেরিনা ইয়াসমিন এবং বসুন্ধরা ও ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপ লিমিটেডের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা।
মতবিনিময় অনুষ্ঠান ও ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া হাউসের প্রতিষ্ঠানগুলো পরিদর্শন শেষে রাষ্ট্রদূতকে বিদায় জানান সম্পাদক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকরা।

No comments

Powered by Blogger.