সেমাইবিহীন ঈদ আনন্দ! by ড. আহমেদ আমিনুল ইসলাম

ঈদ পার করে এসেছি প্রায় সপ্তাহ হলো। নাড়ির টান ছিন্ন করে কর্মস্থলে ফিরে এলেও এখনও ঈদ শেষ করতে পারিনি আমরা। এ যেন রবি ঠাকুরের বিখ্যাত সেই গান ‘এসেছিলে তবু আসো নাই জানায়ে গেলে’-এর মতো অবস্থা। আজ পর্যন্ত বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে ‘সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠানমালা’র যন্ত্রণাদায়ক ঈদ-অত্যাচার চলছে;


চলছে বললেও ভুল হবে কোন কোন চ্যানেল ইতোমধ্যে কিছু অনুষ্ঠানমালার পুনর্প্রচারও করেছে। চ্যানেল মালিকরা তাদের অনুষ্ঠানমালার প্রচার ও পুনর্প্রচারের মাধ্যমে আমাদের ধৈর্যের সর্বোচ্চ পরীক্ষাটি কেন নিচ্ছেন জানি না। এ পরীক্ষা পাসের ফল আমাদের জীবনে কি প্রাপ্তিযোগ ঘটাবে তাও জানি না। যাহোক, অত্যাচার বলি, নিপীড়ন বলি কিংবা মুখটাকে বাংলা পাঁচের মতো করে বিনোদনই বলি এসবের শেষ না দেখে ঈদ সম্পর্কে কিছু লিখব না মোটামুটি এরূপ এক দৃঢ়তাই বর্তমান লেখার বিলম্বের মৃদু কারণ। এরিস্টটল বলেছিলেন ‘বড় বই মানে বড় জঞ্জাল।’ আমাদের টিভি চ্যানেলগুলোর ভূরি ভূরি অনুষ্ঠানের দিকে তাকিয়ে তাই বলা যায়, ‘বেশি অনুষ্ঠান মানে বাজে অনুষ্ঠান।’ এসব আমাদের মানসিক বিকাশকে রুদ্ধ করে, বদ্ধ করে, উৎকেন্দ্রিক করে। সবগুলো না হলেও অনেক অনুষ্ঠান ছিল মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য চরম ক্ষতিকারক। মাঝে মাঝে মনে হয়েছে, আমাদের স্বাজাত্যবোধ, বাঙালি মানসিকতা সর্বোপরি যে আদর্শিক দর্শনের ওপর সমগ্র জাতি দাঁড়িয়ে আছে, তা থেকে এ দেশের টিভি চ্যানেলের অধিকাংশই অনেকটা দূরে। একটা অলীক ভুবনে তাদের বসবাস। আমার এ কথার পশ্চাতে পর্যাপ্ত লজিক নেই তা মানি। কথিত ‘মৃদু কারণ’ উপেক্ষা করেও ঈদ আনন্দ-বেদনার কাব্যকথা লেখা যেতেই পারত। তুচ্ছ অনেক বিষয় ছিল যা ঈদ উদযাপনকে মাঝেমধ্যে দ্বিধান্বিত করেছিল। এসব নিয়ে নানাজন নানাভাবে নানামাধ্যমে ‘কহেছেন বিস্তর’। কিন্তু প্রাপ্তিযোগ শূন্য। তাই কোন মহাপুরুষ যেন বলেছিলেন, ‘যাহা বাহান্ন তাহাই তেপ্পান্ন।’ অর্থাৎ যারা বলার তারা বলেই যাবেন, যারা শোনার তারা শুনেই যাবেন, কিন্তু দায়িত্বশীলরা হয় কানে তুলো না হয় চোখে ঠুলি পরেই কাটাবেন দিন, ঘুমাবেন রাত্রিভর। মাঝখান থেকে আমজনতার নাস্তানাবুদ অবস্থা! ঈদের সঙ্গে সেমাইয়ের আন্তরিক সম্পর্ক। সেমাই ছাড়া ঈদের অভিজ্ঞতা এবারই প্রথম। ভয়েও বলা যেতে পারে; আবার বলা যেতে পারে স্বাস্থ্য সচেতনতার কারণেও। প্রিন্ট বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কল্যাণে আমরা দেখেছি কামরাঙ্গির চরসহ ঢাকার আশপাশে অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা পরিবেশে সেমাই বানানোর দৃশ্য। দেখেছি এসব সেমাই নামী-দামী ব্র্যান্ডের মোড়কে আবৃত হয়ে অভিজাত বিপণিবিতানগুলোর মূল্যবান তাকে সজ্জিত হয়। এসব দৃশ্য দেখে নিজের না হোক অন্তত সন্তানের ভবিষ্যৎ জীবনের কথা ভেবে কেবল আনন্দময়ই নয়, ঈদ-ঐতিহ্যের সেমাইকে তীব্র অস্বস্তি নিয়েই বিসর্জন দিতে হলো। সেমাই বানানো সেসব দৃশ্য দেখে গা রি-রি করে উঠেছিল। কাজেই সাহস করে এবার আর সেমাই খাওয়া হলো না আমাদের। আমাদের নিত্যদিনের খাদ্যদ্রব্যসমূহ দিন দিন এমন নিরাপত্তাহীনতার হুমকির সম্মুখে পতিত হতে চলেছে, অথচ এ থেকে পরিত্রাণের লক্ষ্যে কার্যকর কোন নজরদারি দেখছি না! কেবল কি সেমাই ভীতি! খাদ্যদ্রব্য বিষয়ক নানা প্রকার ভীতিকর পরিবেশ আমাদেরকে চারপাশ থেকে ক্রমাগত নানাভাবে আচ্ছন্ন ও আক্রমণ করে চলেছে। এ থেকে মুক্তির উপায় কি জানি না। মুক্তির কোন লক্ষণ আছে বলে কল্পনাও করা যায় না। মাছ-মাংস, শাক-সবজি, ফলমূল প্রভৃতির মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক মেশানোয় আমাদের জীবনযাত্রা দিন দিন চরম আতঙ্কের অতলে তলিয়ে যাচ্ছে। আমরা নির্বিকার সেসব মেনেও নিচ্ছি। কারণ একটাই বাঁচতে তো হবে, সুতরাং মাত্রাতিরিক্ত ফর্মালিন হোক কিংবা বিষাক্ত কার্বাইড হোকÑকিছুতেই তো জীবনধারা পাল্টাতে পারছি না। ভয় বা ভীতি মাঝেমধ্যে মনের ভিতর যে বাসা বাঁধে না এমন নয়। সর্পভীতির চেয়ে খাদ্যদ্রব্যে মেশানো ক্ষতিকর রাসায়নিকের ভীতি আমাদেরকে আতঙ্কের এক অন্ধকার গহ্বরের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এই আতঙ্ক অন্ধকার ঘরে সাপের সঙ্গে বসবাসের আতঙ্কের শামিল। কোনখানে পা দিয়ে কি বিপদে পড়ব তা যেমন অজানা, তেমনি কোন ফলমূল বা কি খাবারদাবার থেকে কি রাসায়নিকের প্রভাবে আমাদের কি ক্ষতি হয় সে আশঙ্কায় কুলকিনারা না পেয়ে অসহায় জীবনযাপনে বাধ্য হয়ে পড়েছি। বলা যায় আমরা একটি বিশাল চক্রের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছি। এসব ভাবলে যে কোন আনন্দময় মুহূর্ত নিমিষেই অস্বস্তির কালো বাতাসে ঢেকে যায়!
শঙ্কা আশঙ্কা থাকার পরও এবারের ঈদ শেষ পর্যন্ত ভালোয় ভালোয় কেটে গেল। ঈদকেন্দ্রিক রাজনীতিটুকু দেশের বড় দুটি দল গতানুগতিকভাবেই করার চেষ্টা করেছে। তৃতীয় দল হিসেবে জাতীয় পার্টির হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ব্যক্ত আশাবাদ কারও মনে কোন আশার সঞ্চার করতে পেরেছে কি না তা আসলে সময়েই প্রমাণিত হবে। সম্প্রতি তার ভারত সফরকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার এই মৃদু ঝড়। সময় এলেই আমরা দেখতে পাব তৃতীয় শক্তিরূপ কোন বৃক্ষ এ দেশের মাটিতে আদৌ সম্ভব কি না। তবে সাধারণ জনগণ ঈদকে কিভাবে উপভোগ করেছে তা বুঝে অন্তত এটুকু বলা চলে যে, ‘মন্দ নয়’। কারণ আজ পর্যন্ত বড় কোন দুর্ঘটনা ঘটেনি এটি আশার কথা, এক অর্থে সাফল্যের কথাও। সরকার এই সাফল্যকে নিজের ঝুলিতে ভরার চেষ্টা করলেও সাধারণের সচেতনতাবোধ এ সাফল্যের পেছনে বেশি এ কথা মানতে হবে। তবে সবচেয়ে শিক্ষণীয়, এবারের ঈদের ছুটি নানা কারণে কিছুটা প্রলম্বিত হওয়ায় শহর ছেড়ে মানুষ গ্রামে যাওয়ার জন্যও পেয়েছে দীর্ঘ সময়। তাই ভিড় হলেও মানুষ সামলে নিতে পেরেছে নদী, সড়ক কিংবা রেলপথে বাড়ি যাওয়ার সকল রকমের ঝক্কি-ঝামেলা। আবার এ কথাও ঠিক যে, সব পথেই সকলের গুনতে হয়েছে ‘বাড়তি পয়সা’। কারণ ‘বখশিশ’ হোক আর চাঁদাবাজির স্টাইলে অনেকটা ‘জোর করে আদায়’ হোক সাধারণ মানুষ এই অত্যাচারের উৎপাত থেকে রেহাই পায়নি। বরং বাসার বাইরে বেরিয়ে প্রথম রিক্সাভাড়া দেয়া থেকে শুরু করে স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছানো, বাস-ট্রেন-লঞ্চে ওঠা, মালপত্র ওঠানো, নিজের কেনা টিকেটের নির্দিষ্ট আসনটি রক্ষা প্রভৃতি পর্যায়ে বাধ্য হয়ে কিংবা বেকায়দায় পড়ে ‘ঈদি’ প্রদান করতে করতে মধ্যবিত্ত একজন চাকরিজীবী মানুষ নাস্তানাবুদ না হয়ে পারেনি। তবু প্রিয়জনদের সঙ্গে মিলেমিশে গ্রামে গিয়ে ঈদের আনন্দ উপভোগ সম্ভব হয়েছে মানুষের- এটা কম পাওনা নয়। আবার কেউ কেউ এই ভোগান্তিকেই বাধ্য হয়ে উপভোগ করেছে। তারা ভেবেছে ‘এভাবেই ঈদ করতে হয়’ অথবা এরই নাম বুঝি ‘ঈদ’।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
ধরংষধস.লঁ@মসধরষ.পড়স

No comments

Powered by Blogger.