নদী দখল-দূষণ রুখতেই হবে by শাহজাহান মিয়া

প্রতিনিয়ত পরিবেশ রক্ষার কথা বলে আমরা গলা ফাটিয়ে ফেলছি। দেশে-বিদেশে সেমিনারে বড় বড় কথা বলছি। আমন্ত্রণ পেয়ে বিদেশে গিয়ে বক্তৃতা ঝাড়ছি। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে যে দুর্বৃত্তরূপী দখলদার ও দস্যুসম দূষণকারীদের অত্যাচারে অস্তিত্ব হারানোর ব্যথায় জর্জরিত আমাদের নদ-নদীগুলোর আর্তচিৎকার আমরা কি কেউ শুনতে পাই?


অনেকে হয়তো পাই। অনেকেই পাই না। শুধু বিভিন্ন শিল্প-কল-কারখানা প্রতিষ্ঠানের মালিকদের চরম দায়িত্বহীনতার কারণে ভয়াবহ দূষণের কবলে পড়েই তাদের প্রাণভোমরা বেরিয়ে যাচ্ছে তা নয়, নির্লজ্জ দখলদারদের বিষাক্ত নখরের হিংস্র থাবায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে কান্নার শক্তিও নদীগুলো হারিয়ে ফেলছে। এই ভয়ংকর চিত্র যেন কেউ দেখার নেই। ওদের কান্না শোনার সময় নেই। ২০০৯ সালের ৩ জুন একটি জাতীয় দৈনিকে 'বুড়িগঙ্গার বোবাকান্না শুনতে পাই' শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম। ২০০৯ সালের ২৪ মে মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন 'হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ' রাজধানী ঢাকার চারপাশ ঘিরে থাকা ভয়াবহ দূষণকবলিত ও নির্লজ্জ দখলদারদের কবজা থেকে বুড়িগঙ্গা, বালু, শীতলক্ষ্যা ও তুরাগ নদ মুক্ত করার প্রত্যাশায় হাইকোর্টের শরণাপন্ন হয়েছিল। হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ বুড়িগঙ্গাসহ চারটি নদীর তীর বেদখল, মাটি ভরাট এবং স্থায়ী-অস্থায়ী সব ধরনের অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। পরে আরো দু-একবার হাইকোর্ট এ রকম নির্দেশ দিয়েছিলেন। হাইকোর্ট নদী রক্ষায় বারবার নির্দেশ দিলেও সংশ্লিষ্ট সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা মোটেই সন্তোষজনক নয়।
আমাদের দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর একটি অংশের মধ্যে লোভ-লালসার মনোভাব এতটাই প্রকট যে তারা নিজেদের স্বার্থের জন্য নির্দ্বিধায় সবকিছু করতে পারে। ক্ষমতার কাছাকাছি থেকে নিজেদের আখের গোছানোর কাজই তাদের প্রতিনিয়ত তাড়া করে বেড়ায়। অবৈধভাবে জায়গা দখলের মতো ঘৃণ্য দস্যুপনাই সমাজে তাদের মর্যাদা বৃদ্ধির হাতিয়ার বলে মনে করে। তাই এ রকম দস্যুরা প্রকৃতির মহান দান নদী এবং এর তীর বিভিন্ন অবৈধ উপায়ে বা খুঁটির জোরে নিজেদের দখলে নিয়ে তাদের ঘৃণ্য শক্তি জাহির করে। শুধু নদীই নয়, সরকারি কোনো খাস জায়গা পেলেই যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে তাদের সঙ্গে থাকা লোকেরা মনে করে জায়গাটা যখন সরকারের, তখন তা তো আমাদেরই। একইভাবে নদীর পারে শত শত বিভিন্ন রকমের কল-কারখানা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ করে ওইগুলোর বিষাক্ত বর্জ্য নদীতে ফেলে পানির যে কী মারাত্মক ক্ষতিসাধন করছে তাও ভেবে দেখার সময় নেই এসব রক্তচোষা প্রতিষ্ঠানের মালিকদের। যারা আইনকানুন মানে না এবং নিয়মনীতির ধার ধারে না, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া সরকারের কাজ। সে কাজটি এখন পর্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে কোনো সরকারই পালন করেনি। ৪০০ বছরের পুরনো রাজধানী ঢাকাকে বাসযোগ্য রাখতে হলে বুড়িগঙ্গাকে বাঁচিয়ে রাখার যেমন কোনো বিকল্প নেই, তেমনি ঢাকার আশপাশ দিয়ে এখনো ক্ষীণ ধারায় প্রবহমান বালু, তুরাগ ও শীতলক্ষ্যাকে বাঁচিয়ে রাখাও অত্যন্ত জরুরি।
পানির অপর নাম জীবন। নদী প্রকৃতির অমূল্য এই সম্পদ বুকে ধারণ করে। পাহাড়-পর্বতের গা থেকে গলা বরফ পানিরূপে নদীতে ছুটে আসে। নদী তা বুকে ধারণ করে প্রবহমান থেকে পরিবেশ রক্ষা করে। নদীমাতৃক দেশ বলে পরিচিত বাংলাদেশে এখন পানি পাওয়াই দুষ্কর হয়ে পড়েছে। অবশ্য বাংলাদেশে শুষ্ক মৌসুমে পানির হাহাকার এবং বর্ষাকালে পানির আধিক্য ও বন্যার জন্য প্রতিবেশী ভারতই মূলত দায়ী। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে গঙ্গার পানি ভাগাভাগির চুক্তি থাকার পরও ভারত একতরফাভাবে শুষ্ক মৌসুমে উজানে পানি প্রত্যাহার করায় এ দেশের জন্য ফারাক্কা বাঁধ মরণ ফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তিও করছে না। ভারত আবার টিপাইমুখ বাঁধ দেওয়ার কথাও বলছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের মানচিত্র থেকে ইতিমধ্যে অনেক নদী হারিয়ে গেছে। যেগুলো টিকে আছে তার অধিকাংশই মৃতপ্রায়। পানির প্রবাহ কমে যাওয়ার পাশাপাশি দূষণ ও দখলের ফলেই নদীগুলো বিলীন হয়ে যাচ্ছে। দেশের দেড় শতাধিক নদী দখল, দূষণ ও পলি পড়ে ভরাটের শিকার হয়ে তাদের অস্তিত্ব এখন হুমকির সম্মুখীন। এর মধ্যে মারাত্মক হুমকির মুখে রয়েছে রাজধানী ঢাকার আশপাশের নদীগুলো। নদীর পাশেই সাধারণত গড়ে ওঠে শহর-নগর-বন্দর; কিন্তু আমাদের দেশের বিভিন্ন স্থানে শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীগুলোই দূষণ ও দখলের শিকার হয়েছে বেশি। পলি পড়ার ফলে স্বাধীনতার পর দেশের প্রায় ১৮ হাজার কিলোমিটার নৌপথ নাব্য হারিয়েছে। প্রতিবছর কোটি কোটি টন পলি উজান থেকে নেমে এসে নদীর তলদেশ ভরাট করে ফেলছে। তবে সবচেয়ে উদ্বেগজনক হলো মানুষের নিষ্ঠুরতার কাছে মানবসভ্যতা গড়ে ওঠায় সহায়তাকারী নদীর মর্মান্তিক মৃত্যু। মানুষের নির্মম-নিষ্ঠুর কশাঘাতে-অত্যাচারে জর্জরিত নদীগুলো যেন কাঁদছে। একসময় নদীগুলো তাদের বুকে ধারণ করত স্বচ্ছ টলমলে পানি। আর এখন চিত্র সম্পূর্ণ উল্টো। নদীগুলোর দুই পারে নির্মিত অবৈধ স্থাপনা, কল-কারখানা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান থেকে লাখ লাখ টন দূষিত বর্জ্য ফেলার ফলে পানি পচা পূতিগন্ধময় হয়ে পড়েছে। আলকাতরার মতো কালো রং ধারণ করা ওই পানির কঠিন স্তর ভেদ করে তাদের কান্না যেন আদম সন্তানদের কর্ণকুহরে প্রবেশও করতে পারছে না। চাপা আর্তনাদ আছড়ে মরছে নদীর বুকে। বিক্রমপুরের গ্রামে যাওয়ার পথে বাবুবাজার ব্রিজ পার হওয়ার সময় বাসের ভেতর বসে 'আমাকে বাঁচাও বাঁচাও বলে বুড়িগঙ্গার বোবাকান্না' আমি শুনতে পাই। তবে অবস্থা আগে এমন ছিল না। বছর পনেরো আগেও বুড়িগঙ্গার পানি ভালোই ছিল। ১৯৫৫ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত একটানা ৪০ বছর লঞ্চযোগে বুড়িগঙ্গা দিয়ে বাড়ি থেকে ঢাকা যাতায়াতের সময় এই নদীর পানি আমি দেখেছি। তখন পানি ছিল টলটলে। নদী ছিল অনেক গভীর ও প্রশস্ত। এখন বাবুবাজার ব্রিজ দিয়ে সড়কপথেই বাড়ি যেতে হয়। ব্রিজের ওপর না উঠতেই বুড়িগঙ্গার পচা পানির গন্ধ এড়াতে নাকে রুমাল ধরতে হয়। ব্রিজের ওপর থেকে নিচে পানির কালো রং দেখলে মন আঁতকে ওঠে। মাঘ-ফাল্গুন মাসে বুড়িগঙ্গা নদীর পাগলাঘাট থেকে উজানে লালবাগ বা কামরাঙ্গীরচর পর্যন্ত কেউ নৌকায় ভ্রমণ করার সাহস করলে পানির পচা গন্ধে তিনি নির্ঘাত অসুস্থ হয়ে পড়বেন। শীতলক্ষ্যারও একই দশা। এই নদীর এক সময়ের কাঁচা স্বচ্ছ স্ফটিকের মতো পানি এখন স্পর্শ করার উপায় নেই। দুই পারে দখলদারদের তাণ্ডব আর কল-কারখানার বর্জ্যে নদীর এখন মরণদশা। কক্সবাজার যাওয়ার পথে কর্ণফুলীর দুর্দশাও দেখেছি। গত মাসে উত্তরবঙ্গে যাওয়ার পথে দেখেছি তুরাগ ও আশুলিয়া এলাকার চিত্র। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, বিষয়টি কেউ যেন দেখেও দেখছে না। বছরের পর বছর ধরে প্রশাসনও যেন নির্বিকার। মাঝেমধ্যে কিছু করার প্রচেষ্টা দেখা গেলেও শেষ পর্যন্ত কোন অদৃশ্য হাতের কারসাজিতে তা বন্ধ হয়ে যায়। তবে এ রকম মানসিকতা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশ বা অঞ্চলে দেখা যায় না।
বুড়িগঙ্গা রক্ষার জন্য বর্তমান সরকারের আমলে ছয়বার অবৈধ দখলমুক্ত করার অভিযান চালানো হয়; কিন্তু কয়েক দিন পরই আবার সেই আগের মতো অবস্থা চলতে থাকে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ১৫২ কিলোমিটার নদীর দুই তীরের ১২৪ জন অবৈধ দখলদার চিহ্নিত করলেও অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। ওয়াসার মতে নদীটির পানি এতটাই দূষিত যে তা শোধন করেও ব্যবহার উপযোগী করা যাবে না। নদীর পারের এলাকাগুলো সব সময় অবৈধ দখলেই থাকে। শুধু সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে দখলদারিত্বের হাত বদল হয়। গত দুই বছর শুষ্ক মৌসুমে দুই পার থেকে বর্জ্য অপসারণের কাজ করা হয়েছিল। নদী থেকে পলিথিনসহ অন্যান্য বর্জ্যও ওঠানোর কাজ শুরু হয়েছিল। নদীটির তলদেশে ১০ ফুট পুরো পলিথিনের স্তর। এখন বুড়িগঙ্গা রক্ষার কোনো কার্যক্রম নেই। নদীর পানিতে শিল্পবর্জ্যের আধিক্যই বেশি। প্রকাশ্যে বা গোপনে সুড়ঙ্গ পথে প্রতিদিন বিভিন্ন কল-কারখানা থেকে পরিশোধন ছাড়াই প্রায় ৬২ রকমের রাসায়নিক বর্জ্য বুড়িগঙ্গায় ফেলা হচ্ছে। সেগুলোর মধ্যে ক্রোমিয়াম, পারদ, ক্লোরিন, নানা ধরনের এসিড, দস্তা, নিকেল, সিসা, ফসফোজিপসাম, ক্যাডমিয়াম, লোগাম অ্যালকালির মতো প্রাণী ও পরিবেশ বিধ্বংসী ভয়ংকর বর্জ্যও রয়েছে। নদীটিকে ব্যবহার করা হচ্ছে স্রেফ ভাগাড় হিসেবে। নদীকে রক্ষা করতে হলে উচ্চ আদালতের রায় বাস্তবায়ন করতেই হবে।
বুড়িগঙ্গা শুধু ঢাকার পাশে প্রবহমান প্রধান নদীই নয়, এটি ঢাকার প্রাণ। রাজধানীর প্রায় দেড় কোটি মানুষের বাসযোগ্য পরিবেশ নিশ্চিত করতে এই নদীকে বাঁচিয়ে রাখার কোনো বিকল্প নেই। প্রায় সারা বিশ্বের মানুষ যার যার দেশে পরিবেশ বজায় রাখতে সচেতন। শুধু আমাদের দেশের মানুষ পরিবেশ রক্ষায় কোনো তাগিদ বোধ করছে না। উল্টো ধ্বংস কিভাবে করা যায় সে পথেই এগোচ্ছে। বুড়িগঙ্গাকে বাঁচাতে লালবাগ-কামরাঙ্গীরচর এলাকায় নদী ভরাট বন্ধ করে সব অবৈধ স্থাপনা ভেঙে ফেলতে হবে। চোখ বন্ধ করে মুখের দিকে না তাকিয়ে এ কাজটি করতে হবে। নদীর সীমানা চিহ্নিত করে তা সুরক্ষাও নিশ্চিত করতে হবে। কল-কারখানা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানে বাধ্যতামূলকভাবে এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (ইটিপি) স্থাপন করতে হবে। স্যুয়ারেজ লাইনেও ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট বসিয়ে পয়োবর্জ্য দূষণমুক্ত করার ব্যবস্থা করতে হবে। নদীর তীরে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা বিভিন্ন কল-কারখানা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বর্জ্য বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যাসহ দেশের কোনো নদীতে ফেলা একদম বন্ধ করতে হবে। রাজধানীর হাজারীবাগ এলাকার প্রায় ২০০ ট্যানারি কারখানা এলাকার পরিবেশ বিপর্যস্ত ও বিষময় করে তুলেছে। নদী না বাঁচলে যে শহর বাঁচবে না এবং ফলে মানুষেরও টিকে থাকা দায় হবে এ সত্যটি আমরা মোটেই বুঝতে চাচ্ছি না। কারণ, নদী দূষণ এখন শুধু নদীর পানিতেই সীমাবদ্ধ থাকছে না, তা আশপাশের জনপদকেও দূষিত করছে। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা শিল্প-কারখানার বর্জ্য নদীর পানি দূষণ করছে। আর ওই দূষিত পানি ছড়িয়ে পড়ছে আশপাশের আবাসিক এলাকা এবং আবাদি জমিতে। এর ফলে সাভার, আশুলিয়া ও গাজীপুর এলাকার কৃষকদের এখন দুর্ভোগের সীমা নেই। তাই শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে বাধ্য করতে হবে, যাতে তারা অপরিশোধিত বর্জ্য কোনোমতেই নদীতে ফেলতে না পারে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.