অবৈধ ভিওআইপি-১৭ লাখ টাকা নিয়ে ছাড়া হলো চার ব্যক্তিকে by এস এম রানা

চট্টগ্রাম নগরীর লালখান বাজার এলাকার একটি ভবন থেকে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসায়ী, ভবনের মালিক এবং তাঁর দুই ভাইকে র‌্যাব আটক করার পর ১৭ লাখ টাকা ঘুষ নিয়ে ছেড়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ঘুষের বিনিময়ে আটক চারজনকে ছেড়ে দিয়ে ভিওআইপি ব্যবসার দুই কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়।


পরে এ দুই কর্মীকে আসামি করে সিএমপির খুলশী থানায় মামলা করে র‌্যাব।
গত ২৮ আগস্ট সকাল সাড়ে ১০টায় ওই অভিযান চালানোর পরদিন দুজনকে আসামি করে খুলশী থানায় মামলাটি [নম্বর-৪০, তাং- ২৯(৮)২০১২] করেন র‌্যাবের ডিএডি শামসুল হক (নুর)।
ঘুষদাতাদের একজন জানে আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ওই দিন অভিযানকালে আটক হয়েছিলেন লালখান বাজার হাইলেভেল রোডের ৬১/এ ভবনের মালিক বশির আহমদ, তাঁর ভাই জসিম ও বাবুল। এ সময় ভিওআইপি ব্যবসায়ী আলী এবং দুই কর্মী দেলোয়ার ও বেলালকে আটক করা হয়। পরে দুপুরে ঘুষের টাকা পাওয়ার পর বশির, বাবুল ও আলীকে ছেড়ে দেওয়া হয়। অবশ্য জসিম আগেই বেরিয়ে টাকা জোগাড় করেন এবং কোতোয়ালি থানায় সহকারী কমিশনার আবদুল্লাহ আল মাহমুদের অফিসে গিয়ে তা দিয়ে আসেন।' জানে আলম জানান, জসিমের সঙ্গে তিনিও ছিলেন। জানে আলম জসিমের চাচাতো ভাই।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে র‌্যাব ৭-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. আনোয়ার লতিফ খান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ঘুষ লেনদেনের বিষয়ে এখনো কেউ অভিযোগ করেনি। অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
সিএমপির উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) মো. আবদুল্লাহীল বাকী গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এ বিষয়ে কিছু কানাঘুষা আমার কানেও এসেছে। কিন্তু কেউ অভিযোগ দেয়নি। অভিযোগ পেলে তদন্তসাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।' তিনি বলেন, 'কাউকে অন্যায় কাজের সুযোগ দেওয়া হবে না।'
প্রাপ্ত অভিযোগ মতে, ঘুষ লেনদেনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন র‌্যাব ৭-এর সহকারী পরিচালক এসএসপি মো. আমির খসরু এবং সিএমপির কোতোয়ালি জোনের সহকারী কমিশনার আবদুল্লাহ আল মাহমুদ। খসরু ১০ লাখ এবং মাহমুদ সাত লাখ টাকা নিয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
র‌্যাব ও পুলিশের দুই কর্মকর্তার এ ঘুষ লেনদেনের বিষয়টি এখন সিএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মুখে মুখে। কিন্তু প্রকাশ্যে এ নিয়ে কেউ কোনো মন্তব্য করছেন না। আর ঘুষদাতারাও ভয়ে কোথাও লিখিত অভিযোগ দায়ের করেননি। তবে ঘুষদাতা জানে আলম কালের কণ্ঠের কাছে বিস্তারিত খুলে বলেছেন। অবশ্য অভিযুক্ত দুই কর্মকর্তা ঘুষ নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। খসরু ট্রেনিং শেষে গত ১৩ জুলাই র‌্যাব ৭-এ সহকারী পরিচালক পদে যোগ দেন।
র‌্যাব অভিযান চালালেও এর সঙ্গে সিএমপির সহকারী কমিশনার মাহমুদের যুক্ত হওয়ার ব্যাপারে জানা গেছে, মো. আমির খসরু ও আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবন থেকে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এ ছাড়া সিএমপির অপরাধ জোনভুক্ত (দক্ষিণ) এলাকা খুলশী থানার লালখান বাজার। এ জোনের সহকারী কমিশনার মাহমুদ। এ কারণে খসরুর সঙ্গে সহজেই মিলেছেন মাহমুদ।
জানা গেছে, নিজ কার্যালয়ে টাকা নেওয়ার বিষয়ে আবদুল্লাহ আল মাহমুদ সিএমপির শীর্ষ কর্মকর্তাকে জানিয়েছেন, ২৮ আগস্ট খসরু বলেছিলেন, তাঁর (খসরুর) শ্বশুর ফার্নিচার কেনার জন্য কিছু টাকা পাঠিয়েছেন। এ টাকাগুলো যেন বাহকের কাছ থেকে মাহমুদ গ্রহণ করেন। পরে খসরু এসে নিয়ে যাবেন। সেই হিসেবে মাহমুদ টাকাগুলো নেন। এমন কথা শোনার পর সিএমপির ওই শীর্ষ কর্মকর্তা মাহমুদের কাছে জানতে চান, 'খসরুর শ্বশুর অন্যভাবেও টাকাগুলো পাঠাতে পারতেন। ওই টাকা পুলিশ কার্যালয়ে কেন আসবে সেই প্রশ্ন করে ওই কর্মকর্তা আরো জানতে চান, মাহমুদই বা কেন তা গ্রহণ করবেন। জবাবে মাহমুদ ওই শীর্ষ কর্মকর্তাকে বলেন, তিনি সরল বিশ্বাসে এটা করেছেন।
আবদুল্লাহ আল মাহমুদের কার্যালয়ে গিয়ে ঘুষ দিয়েছেন বশির আহমদের ভাই জসিম উদ্দীন এবং চাচাতো ভাই জানে আলম। একটি বাজারের ব্যাগে করে তিনটি প্যাকেটে ১৭ লাখ টাকা দেওয়া হয় বলে জানান জানে আলম। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'র‌্যাব আমার চাচাতো ভাই বশির আহমদের ভবনের একটি ফ্ল্যাটে অভিযান চালিয়ে ভিওআইপি সরঞ্জাম উদ্ধার করে। এ সময় বশির, জসিম ও বাবুলকে আটক করে র‌্যাব। একই সঙ্গে ভিওআইপি ব্যবসায়ী আলীকেও আটক করা হয়। র‌্যাব সরঞ্জাম উদ্ধারের পর মোট ছয়জনকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এ পর্যায়ে এক ব্যক্তি র‌্যাবের লোক পরিচয় দিয়ে ২৫ লাখ টাকা দাবি করে। আর মামলা থেকে রক্ষা এবং কারাগারে যাওয়া থেকে রেহাই পেতে ঘুষ দিতে রাজি হন আটককৃতরা।' তিনি বলেন, 'ব্র্যাক ব্যাংকের কাজির দেউরী শাখা থেকে ৯ লাখ এবং অন্য দুটি স্থান থেকে আরো আট লাখ টাকা জোগাড় করা হয়। এ ১৭ লাখ টাকা ডাচ্-বাংলা ব্যাংকে নওশাদ রহমান টাটা নামের এক ব্যক্তির হিসাব নম্বরে সরাসরি জমা দিতে বলা হয়। কিন্তু ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের জুবিলী রোড শাখায় ওই হিসাব নম্বরে একসঙ্গে ১৭ লাখ টাকা জমা নিতে রাজি না হওয়ায় একই ব্যাংকে শাহীন আলমগীর নামের আরেক ব্যক্তির হিসাব নম্বর দেওয়া হয়। কিন্তু সেই হিসাব নম্বরেও টাকা জমা নিতে ব্যাংক রাজি হয়নি। কারণ ওই হিসাব নম্বরে দৈনিক ৫০ হাজার টাকা লেনদেনের নির্দেশনা ছিল। এ দুটি হিসাবে টাকা জমা করতে ব্যর্থ হয়ে সর্বশেষ মাহমুদ সাহেবের কার্যালয়ে টাকা দিয়ে আসি।'
জানে আলম আরো বলেন, 'মোট ২৫ লাখ টাকা দাবি করেছিলেন কর্মকর্তারা। তাৎক্ষণিকভাবে ১৭ লাখ টাকা দেওয়ার পর বাকি আট লাখ টাকা সন্ধ্যায় দেওয়ার কথা ছিল। এর মধ্যে নগদ আরো পাঁচ লাখ এবং তিন লাখ টাকার চেক দেওয়ার কথা ছিল ওই দিন সন্ধ্যায়। এ টাকা সন্ধ্যায় র‌্যাবের কর্মকর্তা পরিচয়দানকারী কবির ফোন করে নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সন্ধ্যায় আর কেউ ফোন করেননি। ফলে টাকাও দেওয়া হয়নি।' জানে আলম বলেন, 'আমরা প্রবেশের পর মাহমুদ সাহেব জানতে চান, সব ঠিক আছে কি না। আমি বলি, ঠিক আছে। পরে তিনি একটি স্থানের দিকে ইঙ্গিত করে টাকার ব্যাগ সেখানে রাখতে বলেন। আমরা ব্যাগভর্তি টাকা সেখানে রেখে আসি।' জানে আলম বলেন, 'টাকা দেওয়ার পরই চারজনকে ছেড়ে দিয়ে দুজন কর্মীকে আটক করে নিয়ে যায় র‌্যাব এবং শেষ পর্যন্ত ওই চারজনকে মামলায় জড়ানো হয়নি।'
দুজনকে আটক করার পর র‌্যাব সংবাদপত্রে একটি বিজ্ঞপ্তি পাঠায়। সেখানে ২৮ আগস্ট সকাল সাড়ে ১০টায় লালখান বাজার হাইলেভেল রোডের ৬১/এ ঠিকানায় বশির আহমদের বাড়িতে দ্বিতীয় তলায় অভিযান চালিয়ে প্রায় ৪০ লাখ টাকার ভিওআইপি সরঞ্জামসহ দেলোয়ার ও বেলালকে আটক করার তথ্য এবং উদ্ধার করা সরঞ্জামের বিবরণ আছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে র‌্যাব-৭-এর সহকারী পরিচালক এএসপি মো. আমির খসরু কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমি শুধু ভিওআইপি সরঞ্জাম উদ্ধার ও দুজনকে আটক করে মামলার আসামি করেছি। কোনো টাকা নিইনি।' ভবনের মালিক, তাঁর দুই ভাই এবং ভিওআইপি মালিক আলীকে আটক করার কথা অস্বীকার করে তিনি বলেন, 'অভিযানে দেলোয়ার ও বেলালকে আটক করা হয়েছে, অন্যদের নয়।' এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'মাহমুদ ভাই আমার ইউনিভার্সিটি জীবনের বন্ধু। আমি তার সঙ্গে দেখা করতে যাই।'
নিজের কার্যালয়ে বসে টাকা নেওয়ার কথা অস্বীকার করে আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বলেন, 'খসরু আমার শিক্ষাজীবনের বন্ধু এবং সে আমার কার্যালয়ে আসে। ঘটনার দিনও আমার কার্যালয়ে এসেছিল, তবে বেশিক্ষণ থাকেনি।' তিনি বলেন, 'আমার কার্যালয়ে কেউ টাকার লেনদেন করেনি এবং আমি এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতও নই।'

No comments

Powered by Blogger.