সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ-মেরুবর্তী বিভাজন কাম্য নয় by অনিরুদ্ধ আহমেদ

তিনি হয়ে উঠলেন বিভাজন ও মতভেদের এক অনাকাঙ্ক্ষিত উপাদান। এখানে, এই প্রবাসে যেখানেই বাঙালিদের কোনো আমন্ত্রণ-নিমন্ত্রণে যাই না কেন; এমনকি ঈদ পুনর্মিলনীর উচ্ছ্বসিত আয়োজনেও, অবলীলাক্রমেই নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ইউনূস হয়ে ওঠেন আলোচনার বিষয়।


গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে তিনি কাজ করছেন প্রায় তিন দশক ধরে। তখন তিনি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসেননি

মাঝে মধ্যে মনে হয়, ড. মুহাম্মদ ইউনূস অত্যন্ত সৌভাগ্যবান ব্যক্তি। না, কেবল নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তির কারণে নয়। এ শীর্ষ পুরস্কার পাওয়ার কয়েক বছর পরও তিনি পত্রিকার শিরোনামে আসছেন প্রায় প্রতিদিন। তাতে প্রীতি ও প্রশংসা আছে যেমন, তেমনি আছে সমালোচনাও। বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য যে, যিনি হতে পারতেন বাঙালির, বাংলাদেশের মানুষের জন্য ঐক্যের প্রতীক, তিনি হয়ে উঠলেন বিভাজন ও মতভেদের এক অনাকাঙ্ক্ষিত উপাদান। এখানে, এই প্রবাসে যেখানেই বাঙালিদের কোনো আমন্ত্রণ-নিমন্ত্রণে যাই না কেন; এমনকি ঈদ পুনর্মিলনীর উচ্ছ্বসিত আয়োজনেও, অবলীলাক্রমেই নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ইউনূস হয়ে ওঠেন আলোচনার বিষয়। গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে তিনি কাজ করছেন প্রায় তিন দশক ধরে। তখন তিনি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসেননি। যে রাজনীতিকরা নিজেদের বাইরে দুর্নীতিবাজদের কথায় কথায় সন্ধান করেন এবং দুর্নীতি নির্মূল না হোক, অন্তত দুর্নীতি দমনে বারবার শপথ নেন, তারা কেউই তখন কিংবা তার বহু পরেও তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির সামান্যতম অভিযোগ আনেননি। কিন্তু তার নোবেল পুরস্কার জয় করা এবং পরে সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তার রাজনৈতিক দল গঠনের ব্যর্থ প্রয়াস তাকে রাজনীতিকদের সঙ্গে এক অসম প্রতিযোগিতায় নামিয়ে দেয়।
কেউ কেউ বলছেন, বাংলাদেশের কোনো অংশেই কিংবা দেশের বাইরে কোথাও শান্তি স্থাপন বিষয়ে এই অর্থনীতির অধ্যাপক কোনো অবদান রেখেছেন বলে কেউ তো শোনেননি। পরিহাসের ব্যাপার হলো এই যে, শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে যে সরলরৈখিক ব্যাখ্যা রাজনীতিকরা দিয়ে থাকেন, তার বাইরে মানুষের কল্যাণকর্মের জন্যও তো শান্তি পুরস্কার পাওয়া যায়_ এ কথা তারা বেমালুম ভুলে যান। ভুলে যান মাদার টেরেসার কথা, যিনি কোনো যুদ্ধ বন্ধ না করেই শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থি নেত্রী অং সান সু চি যে শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন; সে তো কোনো যুদ্ধ থামানোর জন্য নয়, মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে তার নিরাপস ভূমিকার জন্য।
বাংলাদেশে নিযুক্ত একজন সাবেক রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে এ প্রসঙ্গেই কথা হচ্ছিল। তিনি হতবাক হচ্ছেন যে, ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারের এই বাহ্যত বৈরিতার কারণ কী-ই বা হতে পারে! তিনি মনে করেন, নোবেল পুরস্কারটি ইস্যু নয়। সম্ভবত এর কারণ বিগত সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্ব্বাবধায়ক সরকারের আমলে ড. ইউনূসের রাজনীতি করার প্রয়াস। বস্তুত সে সময়ে ইউনূসের সর্বগ্রাহ্যতাই সামরিক বাহিনীকে উৎসাহিত করেছিল ড ইউনূসকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান করতে। শোনা যায় সে প্রস্তাব তার কাছে পাঠানোও হয়েছিল। কিন্তু সম্ভবত তিনি ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করতে চাননি। যে জন্য ড. ফখরুদ্দীন আহমদকে সেই কাজটি করতে হলো। তৎকালীন সেনা প্রশাসনকে দেওয়া ড ইউনূসের পরামর্শ অনুযায়ী এটা করা হয় বলে অনেকে বলছেন। ইউনূস সম্ভবত চেয়েছিলেন রাজনীতির অঙ্গন থেকে দুই নেত্রীর বিয়োজনের পর তার নিজের রাজনৈতিক দল নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করতে আরও দীর্ঘমেয়াদের জন্য। কিন্তু এবার বিধি বাম হলো। সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাতেই ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা নিল এবং রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ ইউনূস বেরিয়ে এলেন রাজনীতির মোহজাল থেকে। বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে অধ্যাপক ইউনূসের রাজনীতিতে অংশ নেওয়ার এই প্রচেষ্টাকেই রাজনীতিকরা ভালো চোখে দেখেননি বলে মনে করছেন অনেকেই। সাবেক ওই মার্কিন কূটনীতিকও মনে করেন যে, ড. ইউনূস যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমালোচনার পাত্র হয়ে উঠেছেন, তার কারণ রাজনীতিতে তিনি বর্তমান নেতৃত্বের স্থলাভিষিক্ত হতে চেয়েছিলেন। বলাবাহুল্য, ড. ইউনূস বিরোধী দল বিএনপির নেতৃত্বের কাছেও গ্রহণযোগ্য কোনো ব্যক্তি নন। বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়া তাকে ওই একই রাজনৈতিক কারণে কোণঠাসা করতে চান। স্মরণ করা যেতে পারে, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান অধ্যাপক ইউনূসকে সুদখোর বলেই ব্যঙ্গ করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কণ্ঠে সাইফুর রহমানের বক্তব্যের প্রতিধ্বনি শোনা গেল বহু পরে। বিএনপি বর্তমানে ড. ইউনূসের ব্যাপারে যে তাদের অবস্থান সত্যি সত্যি পরিবর্তন করেছে_ এমনটি মনে করার কারণ দেখি না। বিএনপি ক্ষমতায় গেলে ড. ইউনূসকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়া হবে_ মওদুদ আহমদের এই কথাটি খুব পানসে মনে হলো। খানিকটা পরিহাসও বটে। কারণ বিএনপি ক্ষমতায় থাকতেই ইউনূস নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। অথচ জনগণের আনন্দ-উচ্ছ্বাসের তুলনায় তৎকালীন সরকারের তরফ থেকে ইউনূসকে কেন্দ্র করে কিছুই করা হয়নি। তখনও ইউনূস তার রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেননি। আর এখন তো ইউনূসকে সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবার কারণ আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপিরও কিছু কম নেই। তবে মওদুদ ইউনূসের যে মস্ত বড় ক্ষতিটি করলেন, সেটি তিনি নিজে না বুঝতে পারলেও আমরা বুঝতে পারছি :ইউনূসকে তিনি দলীয় আবর্তে আবদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন। তবে বিএনপিই হোক আর আওয়ামী লীগই হোক, ড. ইউনূসের প্রতি এই বৈরিতার পেছনে ইউনূসভীতিই সম্ভবত কাজ করেছে সবচেয়ে বেশি।
গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা নিয়ে কিছু সমালোচনা থাকতেই পারে। কিন্তু সরকারের তরফ থেকে এই প্রায় মরিয়া হয়ে ইউনূসকে কোণঠাসা করার চেষ্টা, নানা আপত্তি সত্ত্বেও গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদকে পাশ কাটিয়ে আইনে সংশোধন আনা_ এর সবকিছু কেবল যে সৌজন্যের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন তা-ই নয়; কৌশলগত দিক দিয়েও বড় রকমের বিভ্রান্তি। তাকে প্রতিদ্বন্দ্বী না ভেবে সহযোগী শক্তি হিসেবে সঙ্গে নিলে দেশ উপকৃত হতো। শোনা যায়, ড. ইউনূস একটি আপস প্রচেষ্টাও চালিয়েছিলেন বর্তমান সরকারপ্রধানের সঙ্গে সম্পর্ক সহজতর করার। কিন্তু কে বা কার হস্তক্ষেপে কিংবা অনাগ্রহে বরফ গলানোর সেই প্রয়াসকে শেষাবধি হিমাগারেই নিক্ষেপ করা হয়। আশঙ্কা হচ্ছে, এই হঠকারিতা কিংবা হতবুদ্ধি দেশকে আবারও নতুন কোনো সংকটের দিকে ঠেলে দেয় কি-না!
সম্প্রতি সংবাদপত্রে প্রকাশিত নিবন্ধে মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক লিখেছেন, জনগণ যা চেয়েছিল সেটা হলো তার সম্মানজনক প্রস্থান। সত্যি বটে। কিন্তু এই জলকে ঘোলা করার জন্য ইউনূস নিজেও কি দায়ী নন, একেবারেই? ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ ত্যাগ করতে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে ইউনূসকে ব্যক্তিগতভাবে অনুরোধ করা হয়েছিল। তিনি সেটা মানেননি। তিনি ভালো করেই জানতেন যে, নির্দিষ্ট বয়সসীমার বাইরে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে থাকার আইন বাংলাদেশে নেই। ওই অধ্যাপকটি ভুলবশত বলছেন যে, অর্থমন্ত্রী কিংবা রাষ্ট্রপতি সত্তর-ঊর্ধ্ব হলে ইউনূস হবেন না কেন? এ যুক্তি প্রয়োগ করলে সেনাবাহিনী থেকে সর্বত্র অবসরের আইন পরিবর্তন করতে হবে। মনে রাখা প্রয়োজন যে, এই প্রাজ্ঞ অধ্যাপক ভুলে যাচ্ছেন যে, জনপ্রতিনিধিদের বয়সসীমা ও সরকারি কর্মকর্তাদের বয়সসীমা এক ব্যাপার নয়। তবে বিস্ময়কর ব্যাপার এও যে, অধ্যাপক ইউনূস নিজেও এ আইনের তোয়াক্কা না করে, সরকারের আপস প্রচেষ্টা এবং পরে সরকারি নোটিশকে অবজ্ঞা করে মামলা করেছিলেন সরকারি নির্দেশের বিরুদ্ধে। আদালতে ইউনূস জয়লাভ করেননি। তিনি তখনও ক্ষান্ত হননি। নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনোনয়নে তার ভূমিকা রাখতে চেয়েছিলেন। এসব কর্মকাণ্ড ইউনূসের ব্যক্তিত্বকে খাটোই করেছে বরং। সবকিছুর ঊধর্ে্ব থেকে এই নোবেল বিজয়ী ব্যক্তি তার অবদানকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে পারতেন।
ইউনূস আমাদের অহঙ্কার, আমাদের গর্ব_ এ কথা যেমন সত্যি, তেমনি এই গর্বকে যারা খর্ব করছে সরকার কিংবা এই নোবেল বিজয়ী ব্যক্তি নিজেই; তাদের কেউ সমালোচনার ঊধর্ে্ব নন। অধ্যাপক ইউনূসকে কেন্দ্র করে এই মেরুবর্তী বিভাজনের অবসান ঘটুক_ এটাই দেশের মানুষ চায়। হয়তো ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ নিয়ে অধ্যাপক ইউনূস এবং সরকারের মধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত দড়ি টানাটানি না হলে সবাই খুশি হতেন ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে দেখে। কেন তার অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হবে? ইউনূসের মেধা ও শ্রমকে ব্যবহার করে বাংলাদেশ কি উপকৃত হতে পারত না? ইউনূসভীতির পেছনে তো বটেই, ইউনূসপ্রীতির ইউনূস পেছনেও রাজনৈতিক বিবেচনাটাই যখন মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়, তখন অর্থনৈতিক অগ্রগতি মুখ থুবড়ে পড়ে। ভীতি ও প্রীতির ঊধর্ে্ব উঠে এখন সময় এসেছে বিষয়টি মূল্যায়নের।

অনিরুদ্ধ আহমেদ :যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাংবাদিক ও লেখক

No comments

Powered by Blogger.