ক্ষমতার সম্ভাব্য পালাবদল নিয়ে শুধু ভারত নয়, অনেকেই শঙ্কিত by আবদুল মান্নান

কিছুদিন ধরে বিভিন্ন মিডিয়ার বদৌলতে এমন একটি ধারণা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে যে আগামী সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোটের পুনরায় ক্ষমতায় আসার একটা সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। তার সঙ্গে আরও একটি ধারণা জনগণকে বেশ কায়দা করে পরিবেশন করা হয়েছে যে ১৯৯১ সাল হতে পর পর দু’বার কোন দল বাংলাদেশে নির্বাচনে বিজয়ী হয়নি।


ইতোমধ্যে বেশকিছু সরকারি প্রতিষ্ঠানে বিএনপি-জামায়াত ঘরাণার কর্মকর্তারা তাদের অন্য সহকর্মীদের এই সঙ্কেত দেয়া শুরু করেছেন যে, কিছুদিনের মধ্যেই তো ক্ষমতার পালাবদল হচ্ছে তখন বোঝা যাবে কত ধানে কত চাল। কথায় বলে প্রশাসন শেষ বছরে এসে তারা পরবর্তী সরকারের জন্য কাজ শুরু করে দেয়। তেমন কিছু আলামত ইতোমধ্যে দেখা যাচ্ছে। সাম্প্রতিককালে পুলিশের কর্মকাণ্ডে এটি মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে যে ধীরে ধীরে তাদের ওপর হতে সরকারের নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে পড়ছে। তা যদি নাই বা হবে তাহলে মেডিক্যালে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের এমন অমানবিক আচরণ কেন? অথবা একজন পঙ্গু লিমন হোসেনকে নিয়েও এমন টানা-হেঁচড়ার কী কারণ থাকতে পারে? তবে সব কিছুর ওপর টেক্কা দিয়েছে বেসরকারী টিভি চ্যানেলগুলোর মধ্যরাতের টক শো। কয়েকজন বিশ্লেষক তো ইতোমধ্যে আগামী নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোটকে দুই-তৃতীয়াংশ আসনে শুধু বিজয়ী করে দেননি, তারা নির্বাচিত হলে তাদের করণীয় কী কী হতে পারে তাও নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আবার বিএনপি নিজেও মোটামুটি নিশ্চিন্ত যে সামনের বার নির্বাচিত হয়ে তারা ফের সরকার গঠন করছে এবং নির্বাচিত হলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তাদের কর্মসূচী কী হবে তাও তারা ইতোমধ্যে ঠিক করে ফেলেছে। তারা ঘোষণা করেছে বর্তমান সরকারের আমলে যতগুলো প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে বা বাস্তবায়নের পথে আছে তার সবই তারা ক্ষমতায় আসলে বাতিল করে দেবে। তার মধ্যে আছে বিভিন্ন বিদ্যুত উৎপাদন প্রকল্প (এ কাজটি তারা গতবার করেছিল), প্রস্তাবিত পদ্মা সেতু প্রকল্প, ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেনবিশিষ্ট হাইওয়ে প্রকল্প ইত্যাদি। তারা এই সরকারের আমলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তিও বাতিল করার হুমকি দিয়েছে। এর মধ্য ভারতের সঙ্গে যদি তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি হয় তা হলে তাও বাতিল হবে। বাতিল হয়ে যাবে ছিটমহল বিনিময় আর সীমানা চিহ্নিতকরণ চুক্তি। শুধু যে বিএনপি বা তাদের পেশাজীবী মিত্ররা বিশ্বাস করেন সামনের নির্বাচনে ক্ষমতার পালাবদল হচ্ছে তা নয়, আওয়ামী লীগের একশ্রেণীর নেতাকর্মী আছেন যাঁরা বিশ্বাস করেন তাঁরা সামনের বার পুনরায় ক্ষমতায় নাও ফিরতে পারেন সুতরাং এই সুযোগে যত রকমের দুর্বৃত্তপনা আছে তা চলতে থাকুক। এটি বেশি প্রযোজ্য এবার যাঁরা প্রথমবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন তাঁদের অনেকের ক্ষেত্রে এবং তাঁদের সঙ্গে আছে ছাত্রলীগ যুবলীগ নামধারী আর কিছু দুর্বৃত্ত। আবার বিএনপি-জামায়াত পুনরায় ক্ষমতায় ফেরার ব্যাপারে শঙ্কায় আছেন বিভিন্ন সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, যারা সরাসরি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকলেও তাঁরা প্রগতিশীল রাজনৈতিক মতবাদে বিশ্বাসী। নানা ভুল ভ্রান্তি সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর প্রতিষ্ঠিত দলটির ওপর তাঁরা আস্থাশীল। বিএনপি-জামায়াত পুনরায় রাষ্ট্রক্ষমতায় ফেরার ব্যাপারে দেশের ভিতরের অনেকের মাঝে যে উৎকণ্ঠা আছে তাই নয় আন্তর্জাতিক মহলেও শঙ্কা আছে। সম্প্রতি ভারতের সর্বাধিক প্রচারিত ইংরেজী দৈনিক টাইমস্ অব ইন্ডিয়ার বরাত দিয়ে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে যে, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো মনে করে আগামী নির্বাচনে বেগম জিয়া ক্ষমতায় আসলে বাংলাদেশ ভূখ- ব্যবহার করে ভারতবিরোধী শক্তিগুলোর সন্ত্রাসী ও নাশকতামূলক কর্মকা- আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। এই কারণে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো শঙ্কিত। সম্প্রতি মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে জাতিগত দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে আল-কায়দা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে অবস্থার যদি পরিবর্তন না হয় তা হলে সেখানে আল-কায়দা তাদের কর্মকা- শুরু করবে। প্রস্তুতি হিসেবে পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামী রুয়ান্ডার জাতিগত দাঙ্গার কিছু ভয়াবহ চিত্র ফটোশপে এডিট করে বিভিন্ন সামাজিক ওয়েবসাইটে ব্যাপকহারে প্রচার করেছে এবং বলেছে এই সব ছবি রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের ছবি। রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন হচ্ছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই তবে তার মাত্রা ঠিক কত ভয়াবহ তা যাচাই করার কোন উপায় নেই কারণ আরাকান প্রদেশে কোন বিদেশী সংবাদ মাধ্যমের প্রবেশাধিকার নেই। তবে এটি নিশ্চিত যে, বিএনপি-জামায়াত আগামীতে কখনো ক্ষমতায় এলে উত্তর-পূর্ব ভারত ও মিয়ানমারে সন্ত্রাসবাদ রফতানি করতে বাংলাদেশের ভূখ- ব্যবহৃত হবে এবং অতীতের মতো তাদের সহায়তায় এগিয়ে আসবে পাকিস্তানের আইএসআই।
বিএনপি-জামায়াতের পুনরায় ক্ষমতায় ফেরার ব্যাপারে পশ্চিমা দুনিয়াও কম শঙ্কিত নয় যদিও একটি রাজনৈতিক দল নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসাটা স্বাভাবিক হওয়া উচিত ছিল। এই না হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে অতীতে বিএনপি-জামায়াত জোট দুবার রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল কিন্তু সার্বিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনায় তারা তাদের দক্ষতার স্বাক্ষর রাখতে পারেনি । সুশাসনের প্রশ্ন যদি আসে বহির্বিশ্ব একটি দেশের শাসন বিষয়ে যতনা শঙ্কিত বা চিন্তিত ভূরাজনৈতিক কারণে তারা তার চাইতে বেশি উৎকণ্ঠিত নিরাপত্তাজনিত কারণে। বর্তমান বিশ্বে জঙ্গীবাদের জন্ম হয় কয়েকটি দেশে কিন্তু সহজে তা বিশ্বের যে কোন দেশে রফতানি হতে পারে। এই রফতানি হওয়ার পিছনে যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশ নীতিও কম দায়ী নয়। নির্মোহভাবে চিন্তা করলে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার যে সব ক্ষেত্রে সুশাসন উপহার দিতে পেরেছে তা কিন্তু নয়। এ ব্যাপারে তাদেরও অনেক অমার্জনীয় ভুলভ্রান্তি ও ব্যর্থতা আছে তবে এটি বর্তমান সরকারের চরম সমালোচকও অস্বীকার করতে পারবে না যে এই সরকারের আমলে বাংলাদেশ পূর্বের জোট সরকারের আমলের মতো জঙ্গীবাদ আর ধর্মীয় মৌলবাদের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র হিসেবে লালিত হয়নি। এই দুটি সামাজিক ব্যাধি বর্তমান সরকার কঠোরহস্তে দমন করে দেশে এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রশংসিত হয়েছে ।
একটি দেশে কোন কারণে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হলে তা শুধু সেই রাষ্ট্রের সীমানার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। তা প্রথমত পার্শ¦বর্তী দেশগুলোকেও কম বেশি আঘাত করে। মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে জাতিগত দাঙ্গা শুরু হলে তা বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াকে বিচলিত করে কারণ এই অসন্তোষের কারণে মানুষ নিজের ভিটেমাটি হতে উচ্ছেদ হয়ে অবধারিতভাবে পাশের দেশে আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করে যা বাঙালী ১৯৭১ এ করেছিল । এতে অনেক সময় ওই সব দেশে সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা ও অস্তিরতা সৃষ্টি হতে পারে। অভিযোগ আছে বাংলাদেশের জঙ্গীবাদ নির্ভর সংগঠনগুলো, যেমন হুজি, লস্করই তৈয়বা, জেএমবি, হিজবুত তাহরীর, রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোকে তাদের সদস্য সংগ্রহের একটি ভাল উৎস হিসাবে ব্যবহার করে। আবার এই সংগঠনগুলোর সঙ্গে জামায়াতের এক ধরনের সখ্য রয়েছে। সরকার সচেতন না হলে আবার এই সকল জঙ্গী সংগঠনগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হবে এবং চাইকি বাংলাদেশ হতে এই অঞ্চলে জঙ্গীবাদ রফতানিও হতে পারে।
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী হলে তারা আওয়ামী লীগের সাধারণ নেতা কর্মীদের ওপর একটি মিনি ‘অপারেশন সার্চলাইট’ বাস্তবায়ন শুরু করে। সারাদেশে শুরু হয়ে যায় হত্যা, লুটপাট, ধর্ষণ আর অগ্নিসংযোগ। এতে কয়েক লাখ মানুষ নিজের ভিটেমাটি হতে উচ্ছেদ হয়ে পড়ে এবং বিপুল সংখ্যক মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে একাত্তরের মতো দেশত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেয়। অথচ এই কাজটি না করলে বিএনপি-জামায়াত জোটের তেমন কোন ক্ষতি ছিল না। অথচ আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালে সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে কিন্তু তারা তা করা হতে বিরত থাকতে পেরেছে যদিও এই ধরনের ধ্বংসাত্মক কাজ করার সক্ষমতা বিএনপি-জামায়াত জোটের চাইতে আওয়ামী লীগের কোন অংশে কম ছিল না এটি না হওয়ার পিছনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের বিচক্ষণতা কাজ করেছে। একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে সামনের বার বেগম জিয়ার নেতৃত্বাধীন জোট ক্ষমতায় আসলে তাতে আপত্তির কিছু ছিল না যদি না অতীতের অভিজ্ঞতা ভয়াবহভাবে তিক্ত না হতো।
বর্তমান ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি আর কৌশলগত অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের গুরুত্ব পশ্চিমা বিশ্ব ও ভারতের কাছে আগের যে কোন সময়ের তুলনায় অনেক গুণ বেশি। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে বঙ্গপোসাগরে তার সার্বভৌমত্ব কায়েম করেছে। বর্তমান বিশ্বের একমাত্র সামরিক পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা করেছে তারা তাদের নৌ শক্তির ষাট শতাংশ ভারত মহাসাগরে মোতায়েন করবে। মধ্যপ্রাচ্য হতে যুক্তরাষ্ট্রে তেল সরবরাহের প্রধান সমুদ্র পথকে তারা নিরাপদ রাখতে বদ্ধপরিকর। এই জন্য যুক্তরাষ্ট্র সব সময় চাইবে এই অঞ্চলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকুক। মিয়ানমারের গণতন্ত্রের দ্বার উন্মুক্ত হওয়ার কারণে অপার সম্ভাবনার এই দেশটির দিকে এখন বিশ্বের অনেক উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের নজর। বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া আর ইন্দোনেশিয়ায় বিশ্বের সিংহভাগ মুসলমান বাস করে এবং এই তিনটি দেশই বর্তমানে দারিদ্র্যকে পিছনে ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। ভারতের পশ্চিম সীমান্তে অদূর ভবিষ্যতে পুরোপুরি শান্তি ফিরে আসবে তেমন সম্ভাবনা নেই। চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক উন্নয়ন হওয়ার কারণে তার উত্তর সীমান্ত তেমন কোন উত্তেজনা নেই। বাকি রইল ভারত বাংলাদেশের পূর্ব সীমান্তে। এই সীমান্তে অশান্তি সৃষ্টি হতে পারে যদি বাংলাদেশ তার ভূখ-কে পার্শ্ববর্তী দেশে অশান্তি সৃষ্টি করতে অন্যের হাতে তুলে দেয় যা চারদলীয় জোট সরকারের আমলে দেয়া হয়েছিল। সে সময় চট্টগ্রামে যে দশ ট্রাক অস্ত্রের চালান ধরা পড়ল এখন তো পরিষ্কার, তা আনা হয়েছিল অসমের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার জন্য। এই অস্ত্র খালাস মামলায় সাক্ষী দিতে গিয়ে বিভিন্নজন আদালতে বলেছেন এই অস্ত্র চালানের ব্যাপারে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়া পর্যন্ত অবহিত ছিলেন। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অস্ত্র সরবরাহ নতুন কোন ঘটনা নয়। জোট সরকারের আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ সে সময় একাধিকবার প্রকাশ্যে বলেছেন এই বিচ্ছিন্নতাবাদীরা আসলে তাদের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছে এবং আমাদের উচিত তাদের নৈতিক সমর্থন দেয়া, যদিও সমর্থন শুধুমাত্র নৈতিক সমর্থনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। বাংলাদেশকে ব্যবহার করে সুযোগ পেলেই পূর্ব ভারতে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির জন্য সব সময় পাকিস্তানের আইএসআই এই দেশে সক্রিয় থাকে। ১৯৯১ সালে নির্বাচনে বিএনপিকে বিজয়ী করার জন্য আইএসআই যে দু’হাতে অর্থ বিলি করেছিল তা তো আইএসআইয়ের তৎকালীন প্রধান জেনারেল আসাদ দুররানি স্বীকার করেছেন। পাকিস্তানের বহুল প্রচারিত সাপ্তাহিক পত্রিকা ফ্রাইডে টাইমস আরো জানিয়েছে ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে পরাজিত করার জন্য আইএসআই বাংলাদেশে আনুমানিক দশ লাখ ডলার ব্যয় করেছিল। সামনের নির্বাচনেও যে আইএসআই একই কাজ করবে তা বলা বাহুল্য। এই অর্থের একটি বিরাট অংশ ব্যয় হবে মিডিয়া এবং মতামত সৃষ্টিকারীদের (ঙঢ়রহরড়হ সড়নরষরুবৎ) পিছনে যার আলামত ইতোমধ্যে দেখা যাচ্ছে।
ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী গত সাড়ে তিন বছরে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা আশঙ্কাজনকভাবে কমেছে। কমেছে তা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। জনপ্রিয়তা কমার পিছনে বস্তুতপক্ষে বিরোধী দলের তেমন কোন অবদান নেই। বাস্তবে সরকারী দল একটার পর একটা ভুল করেছে এবং বিরোধী দল তাতে রং মসলা মিশিয়ে পুঁজি করে কাজে লাগিয়েছে এবং তারা সঙ্গে পেয়েছে এক শ্রেণীর গণমাধ্যমকে। বাংলাদেশের গণমাধ্যমের একটি বড় অংশ অজ্ঞাত কারণে সব সময় আওয়ামী লীগবিরোধী অবস্থান নিয়েছে। এই সরকারের আরও একটি পর্বতসম ব্যর্থতা হচ্ছে তারা কখনও তাদের অর্জনগুলোকে জনগণের সামনে কার্যকরভাবে তুলে ধরতে পারেনি। ঐতিহাসিকভাবে আওয়ামী লীগ সব সময় প্রচারে অমার্জনীয়ভাবে দুর্বল। তিলকে তাল করতে বিএনপির জুড়ি নেই আর ঠিক উল্টোটা হচ্ছে আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে। তাদের অপরিণামদর্শী কর্মকা-ের কারণে অনেক সময় তাল পরিমাণ অর্জন তিল হয়ে দেখা দেয়। আওয়ামী লীগের আর একটি বড় ব্যর্থতা হচ্ছে তারা কদাচিৎ কাজের মানুষ আর দলের মানুষের মধ্যে পার্থক্য করতে সক্ষম। এর ফলে অনেক অকাজের মানুষ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন এবং দলের ও সরকারের সর্বনাশ করেছেন যার দায়দায়িত্ব অনেকটা এককভাবে প্রধানমন্ত্রীকে বহন করতে হয়েছে এবং হবে। এর সর্বশেষ উদাহরণ সোনালী ব্যাংক-হল মার্ক অর্থ কেলেঙ্কারি। এই বিষয়ে আমি একজন সরকার ঘনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রীর সুহৃদকে প্রশ্ন করেছিলাম। উত্তরে তিনি জানালেন যারা বিভিন্ন সরকারী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন তাঁদের ক’জনের ব্যাংক এ্যাকাউন্ট ছিল? একই অবস্থা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। মধ্যপ্রাচ্যের কোন কোন দেশে, নেপালে যে সব ব্যক্তিকে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন তাদের অনেকের তো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে উচ্চমান সহকারী হওয়ার যোগ্যতাই নেই বলে মনে করেন কোন কোন সাবেক পেশাদার কূটনীতিবিদ। একজন জানালেন জাপানের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশে দীর্ঘদিন ধরে কোন রাষ্ট্রদূত ছিল না। জাপান আমাদের সর্ববৃহৎ দাতা দেশ। দলের লোককে পুরস্কৃত করার অনেক উপায় আছে সেগুলো ব্যবহার করা উচিত ছিল সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করে নয়।
যারা দেশে দীর্ঘমেয়াদী শান্তি প্রত্যাশা করেন, যারা একাত্তরের মানবতাবিরোধীদের অপরাধের বিচারের এই পর্যায়ে একটি যৌক্তিক সমাপ্তি দেখতে চান (বিএনপি-জামায়াত সামনের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করলে প্রথম যে কাজটি করবে তা হচ্ছে এই বিচার কাজ বন্ধ করে দেয়া), যারা বাংলাদেশকে পুনরায় জঙ্গীবাদ আর ধর্মীয় মৌলবাদের অভয়ারণ্য হিসেবে দেখতে চান না তারা সকলে প্রত্যাশা করেন সামনের নির্বাচনে জনগণের সমর্থন নিয়ে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় ফিরে আসবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে তা কিন্তু কোন এক জাদু মন্ত্রবলে হবে না। এরজন্য দ্রুত সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে যে সকল অপদার্থরা বসে আছেন তাদের অপসারণ করতে হবে। এদের অনেকেই স্রেফ আখের ঘোচাতে ব্যস্ত। দল ক্ষমতায় না থাকলে তাদের কিছু যায় আসে না। তাদের অনেকেই দেশ ত্যাগী হবেন। তাদের ত্যাগ করার এখনই সময়। ছাত্রলীগ আর যুবলীগ হতে পারে দলের প্রধান চালিকা শক্তি। কিন্তু বর্তমানে তাদের যা অবস্থা তাতে তারা শুধুই দলের জন্য একটি বড় বোঝা। সে বোঝাকে সম্পদে রূপান্তর করে কীভাবে ইতিবাচকভাবে কাজে লাগানো যায় তা এখনই চিন্তা করা উচিত। তা সম্ভব না হলে তাদের সংশ্রব ত্যাগ করলে দলের কোন ক্ষতি বৃদ্ধি হবে বলে কেউ তেমন একটা মনে করেন না। আগামীতে বিএনপি সরকার গঠন করতে পারে বলে ভারত শঙ্কিত। এই সরকার গঠনে ভারতেরও একটা ভূমিকা থাকবে কারণ তারা বর্তমান সরকারকে দেয়া অনেক প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। বেগম জিয়া সুযোগ পেলেই বাংলাদেশকে বর্তমান সরকার ভারতের করদ রাজ্যে পরিণত করেছে বলে চিৎকার করেন। এই সুযোগ ভারতই করে দিয়েছে। তিস্তার পানিচুক্তি না হলে তার জন্য সরকারের সমালোচনা তো বিএনপি করবেই। সীমান্তে বিএসএফের কর্মকা-ে বাংলাদেশের প্রত্যেকটা মানুষ ক্ষুব্ধ। তাকে সরকার বিরোধীদের পুুঁজি না করার তো কোন কারণ দেখি না। গত সাড়ে তিন বছরে বর্তমান সরকার ভারতকে শুধু দিয়েই গেল, বিনিময়ে কী পেয়েছে তার তো হিসাব নিকাশ সরকারবিরোধীরা করবেই। সুতরাং ভারতের শঙ্কা যাতে বাস্তবে পরিণত না হয় তা দেখার দায়িত্ব তো যত না বাংলাদেশের তার চাইতে বেশি ভারতের। সামনের নির্বাচন পর্যন্ত সময় আছে এক বছরের কিছু বেশি। এই সময়ে অনেক কিছু ঘটে যেতে পারে আর সব কিছু যে বর্তমান সরকারের পক্ষে ঘটবে তা কিন্তু নয়। আর কিছু দিনের মধ্যেই অনেক কিছুই সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। তখন ইচ্ছা করলেও অনেক কিছু করা যাবে না ।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও বিশ্লেষক

No comments

Powered by Blogger.