আচমকা অতীত by পল্লব মোহাইমেন

বিয়ের পর ১২ বছর পেরিয়ে গেছে মৌলি আর রিয়াদের। ১০ বছরের একটি সন্তানও আছে। বাসায় একদিন পুরোনো বইপত্র গোছাতে গিয়ে রিয়াদের তিন-চারটা ডায়েরি বেরিয়ে পড়ে। অফিস থেকে বাসায় ফেরার পর ছেলে বেশ কৌতূহলী চোখে রিয়াদের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘বাবা, তুমি ডায়েরি লিখতে?’ রিয়াদ ছেলের হাতে খয়েরি মলাটের


ডায়েরি দেখেই চিনতে পারে, মনটা চলে যায় দুই দশক আগের দিনগুলোতে। পরক্ষণেই ভয়ের একটা ঠান্ডা স্রোত শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে আসে। প্রতিক্রিয়ায় ছেলের হাত থেকে ডায়েরি ছোঁ মেরে নিয়ে নেয় রিয়াদ। ‘তুমি পড়েছ নাকি এই ডায়েরি?’ ছেলেকে জিজ্ঞেস করে। পাশে দাঁড়ানো মৌলি বলে ওঠে, ‘পড়লে ক্ষতি কী? আমিও একটু পড়ে দেখি।’
রিয়াদ জানে ডায়েরিতে কী লেখা আছে। জানে না সেসব পড়লে মৌলির মনে কী ধরনের ক্রিয়া হতে পারে। বছর বিশেক আগের পর পর তিন বছরের তিনটি ডায়েরি আবিষ্কৃত। সেগুলো এখন চাইলেই পড়ে ফেলতে পারে তার স্ত্রী। আবার সেগুলো পুনরুদ্ধার করে লুকিয়েও রাখা যাচ্ছে না। তাতে সন্দেহ আরও ঘনীভূত হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বছর খানেক একটা মেয়ের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ছিল রিয়াদের। বিয়ের অনেক আগেই চুকেবুকে গেছে তা। সেই সম্পর্কের শুরু এবং শেষের দিনগুলোর কথা সংক্ষেপে লেখা আছে ডায়েরিতে। সম্পর্ক যখন শেষের দিকে, তখন উদভ্রান্ত রিয়াদের হূদয়ভাঙা কান্নাও জমা আছে পাতায় পাতায়। বিয়ের সময় থেকে এখন পর্যন্ত মৌলিকেই ভালোবেসেছে রিয়াদ। কিন্তু অতীতের সেই ঘটনা বলি বলি করেও স্ত্রীকে আর বলা হয়নি। এখন ডায়েরি পড়লেই তা জেনে যাবে মৌলি। কী হবে?
দিন সাতেক পর রিয়াদ বুঝতে পারে ডায়েরির লেখাগুলো পড়েছে মৌলি। স্বামীকে সরাসরি কিছু বলে না। কিন্তু রিয়াদ বুঝতে পারে। ১২ বছরে যা কখনো করেনি মৌলি, ইদানীং তাই করছে রিয়াদের সঙ্গে। মেয়ে সহকর্মীদের নিয়ে সন্দেহ, অতীত নিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে খোঁচানো—এসব চলতে থাকে। ধীরে ধীরে রীতিমতো সন্দেহবাতিকগ্রস্ত হয়ে পড়ে মৌলি। রিয়াদও খোলামেলা আলোচনা করতে পারে না ডায়েরির লেখাগুলো নিয়ে। দুজনের মনই অশান্ত থাকে সব সময়। নিজেরাই যেন লড়ছে নিজেদের সঙ্গে।
বিয়ের তিন বছর পর শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে গেলে হঠাৎ করেই কানে আসে স্ত্রী নীলার এক অতীত সম্পর্কের কথা। প্রথমে আসিফের বিশ্বাস হয়নি। একটু খোঁজ নিয়ে বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হয় আসিফ। বিয়ের আগে বড় ভাইয়ের এক বন্ধুর সঙ্গে উথালপাতাল সম্পর্ক ছিল নীলার। এরপর যতবার দেখতে হয় নীলার মুখ, ততবারই একটা বিরক্তি এসে ধাক্কা মারে আসিফের মনে। বিয়ের পর থেকেই নীলাকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছে আসিফ। নিজের সব কথাই বলেছে নির্দ্বিধায়। আর নীলা এটা চেপে গেল। বললে কী হতো! অতীতের সম্পর্ক নিয়ে তো কোনো আপত্তি বা রাগ করত না আসিফ।
আসিফের আচরণের পরিবর্তন ঠিকই টের পায় নীলা। কিন্তু কারণ কী জানে না। একদিন এক রেস্তোরাঁয় মৃদু আলোয় প্রিয় খাবার খেতে খেতে আসিফ নীলার অতীত ধরে টান দেয়। নীলা স্বীকার করে নেয়, এও বলে, ওটা অনেক আগেই শেষ। তার পর শুধু আসিফকেই ভালোবেসেছে সে। কিন্তু কেন আগে বলেনি নীলা—ক্ষোভে ফেটে পড়ে আসিফ। দুজনের সম্পর্কের মধ্যে দেয়াল তৈরি হতে থাকে।
আসিফ-নীলার ঘটনার উল্টোটাও দেখা যায়। অনেক স্বামী বা স্ত্রী তাদের বর্তমানটাকেই বেশি গুরুত্ব দেয়। হঠাৎ করে অতীত জেনে ফেললে শুরুতে কিছুটা মন খারাপ হলেও পরে বর্তমানের বিশ্বস্ততাটাই সামনে উঠে আসে। যেমনটা বললেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ঝুনু শামসুন্নাহার। তিনি বলেন, ‘বিদেশ তো বটেই, আমাদের দেশেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় বিয়ের আগে অন্য একটা সম্পর্ক থাকে। এটাকে গুরুত্ব না দিলেই তো হয়। আর জীবনের সবকিছু কি কেউ কাউকে বলে বা বলা যায়!’
এখন আমার সঙ্গীটা কেমন? আমাকে ভালোবাসে কি না? বিশ্বস্ততা আছে কি না? এই ব্যাপারগুলোকেই গুরুত্ব দেওয়া উচিত বলে মনে করেন ঝুনু শামসুন্নাহার। তিনি বললেন, ‘আগের সম্পর্কটা শেষ, সেটা তো আর স্ত্রী বা স্বামী বয়ে বেড়াচ্ছে না। তাই আগেকার যতটুকু ঘটনা, সেটুকু মেনে নিলেই হয়। নিজেরা না পারলে বিশেষজ্ঞদের কাছেও যাওয়া যেতে পারে। মোগল আমলে কত সস্তায় ঘি খেয়েছিলাম, সেই অতীত নিয়ে ভেবে লাভ নেই। এসবে সন্দেহ বাড়ে। সন্দেহ করতে করতে সুন্দর সময়গুলো নষ্ট করে ফেলে। বর্তমান সময়টাতে বিশ্বস্ত থাকাই আসল কথা।’
অতীত জেনে পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠে। অশান্তি লেগে যায় সংসারে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে বড় ফাটল ধরায়। বিষয়টি বিচ্ছেদ, আদালত পর্যন্ত গড়ায়। এমন ঘটনাও ঘটে বলে জানালেন আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী তারানা হালিম। এ রকম অনেক মামলাও পরিচালনা করতে হয়েছে তাঁকে। তারানা হালিম বললেন, ‘বিষয়টা খুবই ব্যক্তিগত। ব্যক্তিকেই এর সমাধান খুঁজে বের করতে হয়। স্বামীরা যদি উদার হন, তবে কোনো সমস্যা নেই। একই কথা স্ত্রীদের বেলায়ও। অতীতটা নয়, বর্তমানের বিশ্বাস-ভালোবাসাকেই সবার ওপরে স্থান দেওয়া ভালো।’
অনেক মেয়ের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, বিয়ের পর নিজে থেকে স্বামীকে অতীতের সত্য বলাটাই ভুল হয়েছে। বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। স্বামী খুব ক্ষুব্ধ না হলেও মাঝেমধ্যে সেই অতীত নিয়ে খোটা দেয়, এমন ঘটনা তো ঘটেই। আমাদের সমাজে এমনও দেখা যায়, একটা উড়ো চিঠি, একটা উড়ো মেইল ভালোবাসার বন্ধনটাকেই যেন উড়িয়ে নিয়ে যায়। সত্য-মিথ্যার বিচার-বিবেচনাও সেখানে কাজ করে না। আবার এসব ঘটনাকে একেবারেই পাত্তা দেয় না অনেকে। পুরো বিষয়টাই নির্ভর করে একেকজন ব্যক্তির ওপর। কে কীভাবে নিচ্ছে, কীভাবে ভাবছে—এটা মানুষে মানুষে আলাদাভাবেই নির্ধারিত হয়ে থাকে।
সৎ থাকার ব্যাপারে বিশেষ জোর দিলেন তারানা হালিম। বললেন, ‘আমার কাছে মনে হয় এ রকম ঘটনাকে কোনো নির্দিষ্ট ছক, নিয়ম বা বিধিতে ফেলা যাবে না। সততাই সর্বোত্তম পন্থা। যদি অতীত কোনো সম্পর্ক থেকে থাকে, যা বর্তমানে নেই; তবে বিয়ে নামক সম্পর্কে যাওয়ার আগে জীবনসঙ্গীকে তা জানানো ভালো। দুজনের জীবনের খাতাটা খোলা থাকা উচিত। সম্পর্কের সূচনা বিশ্বস্ততার ভিত থেকে হওয়া উচিত। যদি বলার পর পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করে, তবুও মেয়েটি বা ছেলেটির অন্তর জানবে, সে সৎ ছিল।’
বিয়ের পর আচমকা অতীত এলে সংসারে অশান্তি তৈরি হতে পারে। তাই তারানা হালিম মনে করেন, বিয়ের আগেই স্বচ্ছ ও পরিষ্কারভাবে বলে-কয়ে নেওয়া উচিত। পরে কথা উঠলে সঙ্গীকে তো এটুকু বলা যাবে, ‘তুমি তো সব জেনেশুনেই আমাকে গ্রহণ করেছ।’
দাম্পত্যজীবনের সুখ বর্তমান ঘিরেই। অতীত বা ভবিষ্যৎ প্রধান হয়ে উঠলে জীবনযাপনে অযথাই জটিলতা বাড়ে। এ মুহূর্তে আমার সঙ্গী আমার প্রতি বিশ্বস্ত, আমি তার প্রতি বিশ্বস্ত—এটাই বন্ধন টিকিয়ে রাখার মূলমন্ত্র। এই আস্থা যদি থাকে দুজন মানব-মানবীর মধ্যে, তবে অতীতের কোনো দমকা হাওয়াই দম পাবে না।

[বিশেষজ্ঞ ছাড়া এই প্রতিবেদনে ব্যবহূত চরিত্রগুলোর ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে]
 অতীতে কোনো সম্পর্ক থাকলে বিয়ের আগে তা বলে-কয়ে নেওয়া ভালো
 তাৎক্ষণিকভাবে স্বামী বা স্ত্রীর ওপর ক্ষুব্ধ হওয়া ঠিক না
 পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ অনেক সমস্যার সমাধান করে দেয়
 বর্তমানকেই প্রাধান্য দেওয়া উচিত
 বর্তমানে স্বামী বা স্ত্রী বিশ্বস্ত কি না, পরস্পরকে ভালোবাসেন কি না সেটাই আসল
 অতীত আঁকড়ে ধরার কোনো মানে নেই
 বর্তমানের ভালোবাসা আর আস্থাকে স্থান দিন সবার ওপরে

No comments

Powered by Blogger.