দেশ-বিদেশ-ঘুরে এলাম ইবনে বতুতার দেশ মরক্কো by মোহাম্মদ কায়কোবাদ

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থীদের বিশ্বমানের প্রোগ্রামিং-নৈপুণ্যের ওপর ভর করে বিদেশে আর কম বেড়ানো হলো না। এমনকি ৯/১১-পরবর্তী বছরগুলোতেও আমেরিকা ভ্রমণ হয়েছে বহুবার। তারপর ইউরোপের নানা দেশ, জাপান, চীন—প্রতিবছরই একবার করে, গত ১৫ বছর।


এবার অবশ্য প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা নিয়ে নয়, সমাজে বিজ্ঞানকে কীভাবে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তা নিয়ে সভায় যোগদান করতে।
বাংলাদেশ ইউনেসকো জাতীয় পরিষদের সচিব ড. মুকাদ্দাস আলী ও শাহানা পারভীনের ত্বরিত পদক্ষেপে ও মরক্কোর দূতাবাসের কর্মকর্তার অদূতাবাসসুলভ আন্তরিকতায় ভিসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অনুমতি—সবই যথাসময়ে মিলে গেল। বিশ্বখ্যাত ভ্রমণকারী ইবনে বতুতার দেশে ভ্রমণ। বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের আগে যত ভ্রমণকারী ছিলেন, ইবনে বতুতা ছিলেন তার মধ্যে সবচেয়ে বড়। ইবনে বতুতা ভ্রমণ করেছিলেন ৭৫ হাজার মাইল, পক্ষান্তরে মার্কো পোলো মাত্রই তাঁর তিন ভাগের এক ভাগ।
এমিরেটসের ফ্লাইটে প্রথম দুবাই। ঘণ্টা ছয়েকের যাত্রাবিরতিতে দুবাই বিমানবন্দরের ঐশ্বর্য যেমনটি ক্লান্তি দূর করে অপেক্ষার একঘেয়েমি লাঘব করল, একই সময়ে কোটির কম মানুষের দেশের বিমান কোম্পানির আকাশসম সুনাম, শত শত আধুনিক বিমানে সমৃদ্ধ এমিরেটসের অগ্রযাত্রার সাপেক্ষে আমাদের ১৬ কোটি মানুষের দেশের বাংলাদেশ বিমানের নাজুক অবস্থা যে মন্ত্রী বদলিয়ে কিংবা ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদত্যাগে পরিবর্তন হচ্ছে না, তা দেখে মন ভারী হয়ে গেল। জনসংখ্যার বিচারে আমরা সংযুক্ত আরব আমিরাতের ২০ গুণ বড় হলেও তাদের বিমান সংস্থা আমাদের নিশ্চয়ই কমপক্ষে ২০ গুণ বড়। এতগুলো বিমানের যাত্রী তাদের সারা পৃথিবী থেকে জোগাড় করতে হয়। তারা যদি মনে করে, তাদের ব্যবসাটা ভালো যাচ্ছে না, তাহলে নানা ধরনের প্রদর্শনী করে বিদেশিদের আকৃষ্ট করে। ক্যাসাব্লাঙ্কা থেকে সাত ঘণ্টার ফ্লাইটের পরও আমাদের উড়োজাহাজটি সরাসরি গেটে যাত্রী নামাতে পারেনি, যেখানে প্রায় ২৫০টি গেট।
আমাদের দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি নিশ্চিত করতে বিমানকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে হবে। অন্ততপক্ষে আমাদের যাত্রীদের যাতায়াতের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা তো সাশ্রয় করা যাবে। সরকারের পয়সায় বিমান ভ্রমণ হলেই বাংলাদেশ বিমান ব্যবহার করতে হবে। ভারতে যারা দীর্ঘদিনের ছুটিতে যায়, তাদের ভারতের জাতীয় এয়ারলাইনস ব্যবহার করতে হয়। এ রকম আইন করলে নিশ্চয়ই আমাদের যাত্রী-সমস্যা হতো না। বছর বিশ আগে একটি পরিসংখ্যান পড়েছিলাম, যাতে লেখা ছিল, বাংলাদেশ বিমান পর্যাপ্ত যাত্রী পেলে আয়ের সর্বোত্তম উৎস হতে পারত। এই সর্বোত্তম উৎস নিয়ে আমরা কেন গবেষণা করি না, কেন এর সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধান বের করি না। বছর দশেক আগেও মালয়েশিয়ায় ভ্রমণকারীদের আকৃষ্ট করার জন্য বিনা পয়সায় হোটেলে থাকা-খাওয়া এবং বিমানবন্দরে যাওয়া-আসা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তাতে সম্ভবত তাদের লাভই হয়েছে।
যা হোক, তারপর ক্যাসাব্লাঙ্কার ফ্লাইট। এই ফ্লাইটে মধ্য সারিতে আমার পার্শ্ববর্তী সিটে যাত্রী রয়েছে পুরো এক বছর বয়সী সময়ে-অসময়ে অকারণে ক্রন্দনরত এক শিশু এবং তাকে ব্যর্থভাবে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য নিয়োজিত তার অল্পবয়সী অনভিজ্ঞ অসহায় মা ও তার অনুজা খালা। তার সব স্থাবর সম্পত্তির আধার ব্যাগটি বিমান উড্ডয়নের সময় ওপরে শেলফে বিমানবালা রাখতে গেলেই ঘটল বিপত্তি। ব্যাগটি ধরলেই চিৎকার, আবার তাকে না দিলেও তা-ই। একখানি বই পর্যন্ত নিতে ভুলে গেছি। ফলে লম্বা উড্ডয়নকাল শিশুটির সুবাদে ভালোই কাটল। এর ফাঁকে মরক্কো সম্পর্কেও বেশ কিছু জানা গেল। তাদের ভাষা আরবি মরক্কোর উচ্চারণে। বয়স্ক বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানেরা ওই ভাষায়ই কথা বলে। উপনিবেশ থাকার সুবাদে ফরাসি ভাষা চলছে আবার ইদানীং ছেলেমেয়েরা ইংরেজি ভাষায়ও পারদর্শী হচ্ছে। শিশুর মা-বাবা হংকং থাকেন, ইংরেজি উচ্চারণ অতিশয় চমৎকার।
মধ্যপথে এক যাত্রী তো তার সিট থেকে দাঁড়িয়ে গেল বিমান তার গন্তব্যে চলে এসেছে মনে করে। স্থিতিজড়তা ও গতিজড়তার ব্যবধান বুঝতে অবস্থান পরিবর্তনের যে মাপকাঠি দরকার, তা শূন্য আকাশে তার হাতে ছিল না। টয়লেটে গিয়ে বুক এক বিঘত বেড়ে গেল। এই প্রথম একটি বিদেশি ফ্লাইট দেখলাম, যার না যাত্রাস্থান, না গন্তব্য—কোনোটিই বাংলাদেশের কোনো শহর নয়, অথচ কিছু কিছু নির্দেশ বাংলায়ও রয়েছে। এই নির্দেশ যে কারণেই হোক, যেহেতু ইংরেজি ও আরবিতেও আছে, আমি তো বেশ খুশি। অবশ্য একটি ক্ষুদ্র কাপড়খণ্ডে ততোধিক ক্ষুদ্র লেবেলে থাইল্যান্ড শব্দটি দেখে বুকটি আবার সমপরিমাণ নেমে গেল। ২০০০ সালের গ্রোগ্রামিংয়ের বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে উপঢৌকন হিসেবে প্রতিটি দলকে যে টুপি দিয়েছিল, তার ভেতরে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ দেখে রকেট বানানোর গর্বে মন ভরে গিয়েছিল। কাকতাল কিনা জানি না, আমাদের দলটি সেবারই সবচেয়ে ভালো ফল করেছিল, সারা বিশ্বে একাদশ স্থান, তাও আবার এমআইটি, হার্ভার্ড, বার্কলে, স্ট্যানফোর্ডের মতো বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পেছনে ফেলে। এক যুগ পরে আমাদের সেই সাফল্যের জন্য তৈরি পোশাকশিল্পের বঞ্চিত শিল্পীদের কৃতজ্ঞতা জানাই।
ক্যাসাব্লাঙ্কা বিমানবন্দর দেখেই বোঝা যায়, মরক্কো এমন কোনো ধনী দেশ নয়। তবে দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিক দর-কষাকষির জায়গা হিসেবে রাবাত ও এই শহরটিকে সবাই পছন্দ করে আসছে। আমাদের যেতে হবে রাবাত। প্রাইভেট কারে ক্যাসাব্লাঙ্কা থেকে রাবাতের ৯০ কিলোমিটার দূরত্ব কীভাবে যে এক ঘণ্টায় অতিক্রম করা যায়, তা না গেলে বিশ্বাস হবে না। সারা রাস্তার কোথাও কোনো ট্রাফিক লাইট নেই, শুধু দুটি স্থানে টোল প্লাজা। এক ঘণ্টায় চলে এলাম রাবাত। হাইওয়ে বলতে যা বোঝায় এবং বাংলাদেশে যা নেই। গোটা দেশ হলো সমুদ্রের তীরঘেঁষে, আবহাওয়া সব সময়ই ভালো। রাবাত শহরকে মনে হলো একটি বিশাল পার্ক, রাস্তাগুলো সব একমুখী, সড়কদ্বীপগুলো প্রশস্ত। আফ্রিকার একটি দেশে যে এত গাছ আছে, তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। তাও আবার সাহারা মরুভূমির সঙ্গে লাগানো। রাস্তায় যানবাহনগুলো ট্রাফিক আইন মেনে চলে, কোথাও বড় কোনো যানজট দেখতে পেলাম না। রাস্তায় দু-একজন ভিক্ষুক যে দেখা যায়নি তা নয়, তবে স্মার্ট সবল ভিক্ষুকদের ক্ষুদ্রতর দেহধারী পুলিশ যে ভ্যানে তুলে নিয়ে যাচ্ছে তা দেখেছি ঠিক আমাদের দেশে আন্দোলনরত হরতাল পালনকারী রাজনৈতিক কর্মীদের যেভাবে করা হয়।
আইএসইএসসিওর ৩০ বছর পূর্তি উদ্যাপন উপলক্ষে দেশের প্রধানমন্ত্রী এসেছিলেন, তার দেহরক্ষীকে দেখার সৌভাগ্য হলো না। যারা ছবি তুলতে চেয়েছিল, তাদের কাউকে বঞ্চিত করেননি। রাবাতে অত্যন্ত সাদামাটাভাবে রয়েছে রাজা হাসানের কবর। ২০১১ সালের নির্বাচনে পার্লামেন্টকে যদিও অনেক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তবুও রাজাই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। সম্প্রতি উইকিলিকসের ফাঁস করা তথ্য অনুযায়ী, রাজার সম্পদ দুই বিলিয়ন ডলারের বেশি, আর রাজপ্রাসাদে নাকি প্রতিদিন ব্যয় হয় প্রায় এক মিলিয়ন ডলার। তাও আবার মূলতই পোশাক এবং গাড়ি মেরামতের জন্য। মরক্কোর মুদ্রা দিরহাম, এক মার্কিন ডলার আট দিরহামের কিছুটা বেশি। একটি পার্টি হলো। আটজন অতিথির জন্য প্রথম এল বিশাল পাত্রে করে সালাদ, লেটুসপাতা থেকে নানা বর্ণের সবজি, কিছু ফল একটি পাখির মতো করে সাজিয়ে। এর পর এল পাস্তিলা—অত্যন্ত সুস্বাদু করে তৈরি করা রুটির ভেতর ইতালিয়ান কিংবা মেক্সিকান পাস্তা। এর পর এল গোটা চারেক মরক্কোর মুরগির রোস্ট। সঙ্গে ছিল নানা ধরনের ফলমূলের রস এবং ঠান্ডা পানীয়।
মানুষের সঙ্গে কথা বলে, অনুষ্ঠানগুলোতে যোগদান করে, রাস্তায় হেঁটে, শপিং সেন্টারে গিয়ে দেশটি সম্পর্কে অনুভূতি ভালোই হলো। হংকং তার স্ট্র্যাটেজিক অবস্থান ব্যবহার করছে, যা করছে সিঙ্গাপুরও। দক্ষিণ কোরিয়া আর জাপানও কী কী ব্যবহার করে অগ্রগতির পথে এগিয়ে যাচ্ছে, এমনকি যুদ্ধবিধ্বস্ত ভিয়েতনামও এগিয়ে যাচ্ছে, ক্ষুদ্র দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত তার বিমান বহর দিয়ে সারা বিশ্বে যোগ্য দেশ হিসেবে মর্যাদা পাচ্ছে, মরক্কো মর্যাদা পাচ্ছে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের দর-কষাকষির স্থান হিসেবে। আমরা বঞ্চিত পোশাকশিল্পের নারীদের এবং মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত খেটে খাওয়া মানুষের অমানুষিক পরিশ্রমের বিনিময়ে অর্জিত বিদেশি মুদ্রা ছাড়া অন্য কোনো শ্রেয়তর উপায়ের সন্ধান করতে পারি কি না।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ফেলো বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস।

No comments

Powered by Blogger.