ক্ষোভের বৈঠক ২৬ ক্যাডার কর্মকর্তার by আশরাফুল হক রাজীব

পদোন্নতি, পদায়নসহ বিভিন্ন অসংগতির শিকার সরকারের ২৬টি ক্যাডারের ক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা একজোট হয়ে বৈঠক করেছেন। গত মঙ্গলবার প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের সম্মেলন কক্ষে এ বৈঠক হয়। বৈঠকে উপসচিব থেকে সিনিয়র সচিব পর্যায়ের শতাধিক কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। এ বৈঠক সম্পর্কে সরকারের কোনো দপ্তরই অবগত ছিল না।


বৈঠকে উপস্থিত বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জনপ্রশাসনে পদে পদে বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে। পদোন্নতি থেকে শুরু করে পদায়ন, প্রেষণসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে অনিয়মই নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে উপসচিব ও এর ওপরের পদগুলোতে বিধি লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়তই। সর্বশেষ পদোন্নতির ক্ষেত্রেও জ্যেষ্ঠতার সাধারণ নীতিমালা মানা হয়নি। একই ব্যাচের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি না দিয়ে জুনিয়র কর্মকর্তাকে উপসচিব করা হয়েছে। বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনে (এসিআর) কোনো বিরূপ মন্তব্য না থাকলেও বাদ পড়েছেন কেউ কেউ। এ ধরনের ঘটনা প্রতি পদোন্নতিতেই ঘটছে। এভাবে পদোন্নতি দেওয়ায় উপসচিব থেকে ওপরের পদগুলো সৃষ্টির মূল লক্ষ্যই পথ হারিয়ে ফেলেছে। ফলে জনপ্রশাসনে বেড়েছে আন্তক্যাডার অসন্তোষ। এসব অসন্তোষ থেকেই গত মঙ্গলবারের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে তাঁরা জানিয়েছেন।
বৈঠকে অংশগ্রহণকারী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কাজী আখতার উদ্দিন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা বিভিন্ন ক্যাডারের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে বসেছিলাম। সেটি ছিল একটি প্রাথমিক বৈঠক। বৈঠকে সংশ্লিষ্ট ক্যাডারের উপসচিব থেকে তদূর্ধ্ব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কল্যাণে একটি সংগঠন করারও সিদ্ধান্ত হয়। এখনো কোনো কিছুই চূড়ান্ত হয়নি।'
সভায় প্রশাসন ও পররাষ্ট্র ক্যাডার ছাড়া অন্যান্য ক্যাডারের অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব ও উপসচিবরা উপস্থিত ছিলেন। অন্যান্য কাডারের মধ্যে হিসাব ও নিরীক্ষা, ট্যাক্স, আনসার, খাদ্য, ডাক, তথ্য, সমবায়, পরিসংখ্যান, গণপূর্ত, সড়ক ও জনপথ, টেলিকম, জনস্বাস্থ্য, রেলওয়ে, কৃষি, মৎস্য, প্রাণিসম্পদ ও শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা বেশি উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে উপসচিব ও তদূর্ধ্ব পর্যায়ের পদোন্নতিতে যেসব অনিয়ম করা হচ্ছে তা তুলে ধরা হয়। সভায় বলা হয়, সুপ্রিম কোর্টের রায়ে যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পর্যায়ে আগের ৩০ ভাগ কোটা বাতিল করা হয়েছে। এ আদেশে বলা হয়েছে, উপসচিব হওয়ার পর আর কোনো ক্যাডার পরিচিতি থাকতে পারে না। ফলে এ পর্যায়ে এসে সাধারণ জ্যেষ্ঠতার নীতি অনুসরণ করতে হবে। কিন্তু তা না করে অন্যান্য ক্যাডার থেকে উপসচিব ও যুগ্ম সচিব হওয়া কর্মকর্তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। সেখানে জ্যেষ্ঠতার নীতি লঙ্ঘন করে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বেশিসংখ্যক পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।
বৈঠক সূত্রে জানা যায়, আনসার ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা বৈঠকে বলেন, 'বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে চাকরিতে যোগদানের পর ভুলেই গিয়েছিলাম যে, ক্যাডার পদে চাকরি করছি। চাকরিতে যোগদান করেই দেখেছি আমাদের পরিচালনা করছেন সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা। সেখান থেকে মুক্তির আশায় উপসচিব হয়েছিলাম। এখানে এসে দেখছি শাসন করছে প্রশাসন ক্যাডার। কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে পড়ার অবস্থা। অথচ সিভিল সার্ভিস রুলে সব ক্যাডারের সমতার কথা বলা হয়েছে।
সভায় ট্যাক্স ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা বলেন, '১৯৮৩ সালের বিশেষ বিসিএস পরীক্ষায় থানা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে ছয় মাস চাকরি করেছি। সেখান থেকে ৮২ ব্যাচে ট্যাক্স ক্যাডারে যোগদান করলাম। মূল উদ্দেশ্য ছিল ঢাকায় থাকব। পরবর্তী সময়ে তো উপসচিব হতেই পারব। আমার সঙ্গে বিশেষ বিসিএসে চাকরি করেছেন কিন্তু ৮২ ব্যাচের পরীক্ষায় তাঁরা ফেল করেছেন, এমন সাতজন বর্তমানে সচিব। আমি যদি পরীক্ষায় ফেল করতাম, তাহলে বিশেষ বিসিএসের চাকরিই করতাম। তাহলে হয়তো আজ আমিও সচিব থাকতাম। কিন্তু এখন আমি যুগ্ম সচিব। উপসচিব হয়েছি সরকারের একটি বিশেষ চাকরিতে কাজ করার আশায়। সরকারই আমাকে উপসচিব করেছে। কিন্তু উপসচিব করার পর এখন প্রকৃতপক্ষে আমাকে হত্যা করা হয়েছে। কারণ আমি বাইরে তাঁদের মতো মর্যাদা পাই না। মর্যাদাহীন জীবন হত্যারই নামান্তর। সমঅধিকারের ভিত্তিতে চাকরিতে এসেছিলাম। সেখান থেকে আমি উপসচিব বা এর ঊধর্ে্ব পদোন্নতি না পেতে পারি। কিন্তু কোন কারণে পদোন্নতি পেলাম না তা আমাকে বুঝতে হবে। কোনো একটি ক্যাডার বা কোনো ব্যক্তিবিশেষের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় আমাকে পদোন্নতি থেকে বাদ দেওয়া যাবে না।'
অন্য একজন কর্মকর্তা বলেন, 'আমরা বিভিন্ন ক্যাডার থেকে উপসচিব হিসেবে পদোন্নতির সময়ে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের অনেক জুনিয়র ব্যাচের সঙ্গে পদোন্নতি পাচ্ছি। নিজ ক্যাডারের পঞ্চম গ্রেডে প্রায় সাত থেকে আট বছর চাকরি করার পর উপসচিব পদে পদোন্নতি পাচ্ছি। ফলে যুগ্ম সচিব হিসেবে পদোন্নতির সময়ে অন্যান্য ক্যাডারের ক্ষেত্রে ফিডার হিসেবে তিন বছর বিবেচনা করা সঠিক নয়। এর অবসান দরকার।
সরকারের সিনিয়র সচিব রোকেয়া সুলতানা সভায় বলেন, এসব সমস্যার সমাধানে একটি কাঠামো দরকার। এসব অধিকার আদায়ের প্রশ্নে আমাদের কোনো প্রতিপক্ষ নেই। আমরা যে বিভিন্ন পর্যায়ে ন্যায্য অধিকার পাচ্ছি না, তাই শুধু সরকারকে জানাতে হবে। এ জানানোর কাজ অবশ্যই সুষ্ঠু নিয়মশৃঙ্খলার মধ্যে হতে হবে।'
সভায় অসম পদোন্নতিসহ বিভিন্ন অসঙ্গতি কথা তুলে ধরার জন্য সংগঠন গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। সংগঠনের নাম চূড়ান্ত না হলেও প্রাথমিকভাবে 'বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন' নাম রাখার বিষয়ে আলোচনা হয় বলে জানা যায়। প্রস্তাবিত এ সংগঠনের আহ্বায়ক হিসেবে প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের সদস্য সরকারের সিনিয়র সচিব রোকেয়া সুলতানার নাম প্রস্তাব করা হয়। যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কাজী আকতার উদ্দিন আহমেদ এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব শামসুল কিবরিয়া। পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তাদের মূল ক্যাডারকে ভিত্তি করে প্রত্যেক ক্যাডার থেকে পদোন্নতি পাওয়া দুইজন করে কর্মকর্তাকে সদস্য করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর বাইরে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের যুগ্ম সচিব এ এইচ এম আবদুল্লাহ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব নাজিম উদ্দিন চৌধুরী ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব সাইদুর রহমান সেলিমকে কমিটিতে সদস্য হিসেবে রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।
বৈঠকে যোগ দেওয়া ট্যাক্স ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা বলেন, ২০১২ সালে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে ১৩১ জন পদোন্নতি পেয়েছেন। পদোন্নতি দেওয়ার সময় যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করলে প্রশাসন ক্যাডারের বাইরে অন্যান্য ক্যাডারের ৪০ থেকে ৫০ জন পদোন্নতি পেয়ে অতিরিক্ত সচিব হতে পারতেন। কিন্তু পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে মাত্র ১৭ জনকে। এ ক্ষেত্রে আদালতের নির্দেশনা যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়নি। তিনি আরো বলেন, 'আমাদের জুনিয়র ব্যাচের কর্মকর্তারা আমাদের ডিঙিয়ে পদোন্নতি পেয়ে যাচ্ছেন। আমরা সিনিয়র হয়ে জুনিয়রের অধীনে কাজ করি।'

No comments

Powered by Blogger.