* লাইফ সাপোর্ট নিয়ে ব্যবসার অভিযোগ-* ১০ শতাংশ ফ্রি চিকিৎসার শর্ত মানা হয় না-* জরুরি বিভাগে ঢুকলেই এক হাজার ৭০০ টাকা-সেবার চেয়ে ব্যবসা আগে এ্যাপোলো হাসপাতালে by তৌফিক মারুফ

রাজধানীর বারিধারাসংলগ্ন ডুমনি এলাকার রিকশাচালক মতিয়ারের স্ত্রী সুফিয়া বেগম হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে নেওয়া হয় বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় অবস্থিত এ্যাপোলো হাসপাতালে। তবে তাঁকে ফটকের ভেতরেই ঢুকতে দেননি হাসপাতালের নিরাপত্তাকর্মীরা।


পরে সুফিয়া বেগমকে সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।
মতিয়ার বলেন, 'বাসার কাছের হাসপাতাল দেইখা তাড়াতাড়ি এ্যাপোলোতে লইয়া গেছিলাম। কিন্তু গেটে যাইতেই দারোয়ান কইছে, ইমারজেন্সিতে ঢুকলেই কমপক্ষে এক হাজার ৭০০ টাকা লাগব। আর ভর্তি হইলে সব চাইতে খারাপ বেডের ভাড়া পড়ব দিনে আড়াই হাজার টাকা। পরে তো ওষুধের বিল লাগবই। ফ্রি কোনো ব্যবস্থা নাই। যখন কইছি আমরা গরিব মানুষ, অত টাকা দিতে পারুম না, অল্প কিছু টাকা লইয়া আইছি। হেইডা হুইনা ওই দারোয়ান আমাগোরে সরকারি হাসপাতালে যাইতে কইল। দিশা না পাইয়া শেষ পর্যন্ত ঢাকা মেডিক্যালে গেছি।'
রাজধানীর মধ্য বাড্ডা এলাকার ব্যবসায়ী সুফিয়ার রহমান রাত ১২টার দিকে গাড়ি চালানোর সময় হঠাৎ অসুস্থ বোধ করেন। নিজেই গাড়ি নিয়ে দ্রুত চলে যান এ্যাপোলো হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। কয়েক মিনিট জরুরি বিভাগের বেডে শুয়ে ছিলেন। একজন চিকিৎসক পরীক্ষা করে দেখেন রক্তচাপ কিছুটা কম। এর মধ্যে সুফিয়ার সুস্থ বোধ করায় উঠে বাসায় রওনা দেন। কিন্তু ততক্ষণে তাঁর হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় দুই হাজার ৪০০ টাকার একটি বিল।
সুফিয়ার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বড়জোর আধা ঘণ্টার মতো ছিলাম। ব্লাডপ্রেসার ছাড়া আর কোনো চেকআপও করেনি। কোনো ওষুধও কিনিনি। তার পরও দুই হাজার ৪০০ টাকার বিল দেখে আমার আবার অসুস্থ হয়ে পড়ার উপক্রম হয়। কিন্তু কিছুই করার ছিল না। ভাগ্যিস পকেটে টাকা ছিল! বিল শোধ করে বাসায় ফিরতে পেরেছি। হাসপাতালের লোকেরা বলেছে, এটাই নাকি তাদের সিস্টেম।'
কালের কণ্ঠ থেকে এ্যাপোলো হাসপাতালের বিল দপ্তরে খোঁজ নিতে গেলে সেখানকার কর্মীরা জানান, জরুরি বিভাগে প্রথম ঘণ্টার জন্য সার্ভিস চার্জ এক হাজার টাকা। পরের প্রতি ঘণ্টার জন্য ৫০০ টাকা করে নেওয়া হয়। আর ডাক্তার ফি রাত ১১টা পর্যন্ত ৭০০ টাকা এবং রাত ১১টার পর এক হাজার ৪০০ টাকা। ওষুধ বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিল আলাদা। এ ছাড়া একেক ধরনের ওটির জন্য একেক হারে চার্জ রয়েছে।
এ্যাপোলো হাসপাতালের প্রশাসনিক দপ্তরের সূত্র থেকে জানা যায়, এই হাসপাতালে মোট ২৩টি ক্যাটাগরির বেড রয়েছে। এর মধ্যে সর্বনিম্ন স্ট্যান্ডার্ড ক্যাটাগরির বেড ভাড়া দৈনিক দুই হাজার ৫০০ টাকা এবং সর্বোচ্চ স্যুটের ভাড়া ১৬ হাজার টাকা করে। তবে বেশির ভাগ বেডের ভাড়া আট হাজার টাকা করে। আর এখন পর্যন্ত এই হাসপাতালে বেড চালু আছে মোট ৩৫৮টি। এ ছাড়া নতুন নতুন প্যাকেজ আকারে চেকআপের নামে রোগীদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি হারে টাকা। বিশেষ করে হোল বডি চেক আপ ফি বাবদ নেওয়া হয় পুরুষদের জন্য ১৫ হাজার টাকা এবং নারীদের জন্য ১৭ হাজার টাকা। একই ভাবে হার্ট চেকআপ প্যাকেজের নামে নেওয়া হয় ১১ হাজার টাকা, লিভার স্ক্রিনিংয়ের জন্য ৯ হাজার ৫০০ টাকা, ডায়াবেটিক প্যাকেজ চেকআপের জন্য আট হাজার টাকা। এ হার ইউনাইটেড কিংবা স্কয়ার হাসপাতালের চেয়ে অনেক বেশি। বিবিধ প্রক্রিয়ায় রোগীদের কাছ থেকে ইচ্ছামাফিক টাকা আদায়ের মাধ্যমে এ্যাপোলো হাসপাতাল নিজেদের আর্থিক স্বাস্থ্য স্ফীত করে চলেছে প্রতিনিয়ত। সেবাগ্রহীতাদের অভিযোগ, রোগীর উন্নত চিকিৎসা দেওয়ার নামে এবং সরকারের কোনো রকম মনিটরিং না থাকার সুযোগে এ্যাপোলো হাসপাতাল কর্র্তৃপক্ষ অস্বাভাবিক হারে টাকা আদায় করছে।
এ্যাপোলোর নিজস্ব আয়-ব্যয়ের হিসাব খতিয়ে দেখা যায়, যেখানে ২০০৯ সালে নিট লাভ ছিল সাত কোটি ১২ লাখ ২৪ হাজার ১১২ টাকা সেখানে এক বছরের মাথায় ২০১০ সালে নিট লাভের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ২৩ কোটি ৭৭ লাখ ১৬ হাজার ৫৭৬ টাকা। ওই বছর তাদের মোট লাভের পরিমাণ ছিল ১০০ কোটি টাকার বেশি।
এ্যাপোলোতে শুধু গরিবরাই চিকিৎসাবঞ্চিত থাকে না, বেড ভাড়া ও অন্যান্য চিকিৎসা ব্যয় অনেক বেশি বলে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। বিশেষ করে আইসিইউয়ের লাইফ সাপোর্ট বা ভেন্টিলেটর চার্জও অন্যান্য হাসপাতালের চেয়ে বেশি। এ হাসপাতালে ভেন্টিলেটরের ভাড়া নেওয়া হয় প্রতিদিন ছয় হাজার টাকা করে। ডাক্তার ফি নেওয়া হয় সাধারণ হিসাবের চেয়ে দেড়গুণ বেশি। ওষুধ ও পরীক্ষা ফি তো আলাদা আছেই।
জাতীয় স্বাস্থ্য আন্দোলনের সভাপতি ও মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ ই মাহাবুব কালের কণ্ঠকে বলেন, 'কোনো কোনো হাসপাতাল স্বাস্থ্যসেবা বা চিকিৎসাসেবাকে সেবামূলক ব্যবসা হিসেবে না নিয়ে অন্য ব্যবসার মতোই বাণিজ্যিকভাবে নিয়েছে, যা নৈতিকভাবে মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। সরকারের পক্ষ থেকে উপযুক্ত কোনো ফি বা সার্ভিস চার্জ নির্ধারণ করে না দেওয়ার কারণে হাসপাতালের নামে ব্যবসায়ীরা এ অনৈতিক বাণিজ্য করার সুযোগ পাচ্ছে।' তিনি আরো বলেন, 'এ ধরনের হাসপাতালে যাঁরা চিকিৎসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তাঁরাও রোগীর ভালোর চেয়ে হাসপাতালের আয়ের দিকেই বেশি নজর রাখেন। কারণ এর জন্য তাঁরা হাসপাতাল থেকে অস্বাভাবিক আয় বা অনৈতিকভাবে কমিশন কিংবা বোনাস পেয়ে থাকেন।'
এ্যাপোলো হাসপাতালের বাণিজ্য বিভাগের মহাব্যবস্থাপক ডা. সাগুফা আনোয়ার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা অবশ্যই ব্যবসা করি। তবে সবটাই করি রোগীর নিরাপত্তা ও চিকিৎসার জন্য। আমাদের সঙ্গে এ দেশের অন্য কারো তুলনা করা যাবে না, এমনকি অন্য দেশের অনেক বড় হাসপাতালের চেয়ে আমাদের অবস্থান অনেক ভালো। এ জন্যই বাংলাদেশে একমাত্র আমরা জয়েন্ট কমিশন ইন্টারন্যাশনাল-জেসিআই সনদ অর্জন করেছি।' ওই কর্মকর্তা বলেন, 'কেবল স্বাস্থ্যসেবা হলেই চলে না, এখন রোগীর সার্বিক চিকিৎসা নিরাপত্তাই সবচেয়ে বড়। এ জন্য আমাদের এখানকার সব কিছু অধিকতর নিরাপদ রাখতে হয়। তাই খরচ হয় বেশি। এ জন্য মানুষের কাছে খরচ বেশি মনে হয়। তবে অন্যদের তুলনায় এ খরচ বড়জোর ১০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি হতে পারে।'
তিনি আরো বলেন, 'এ্যাপোলো এখন কেবল ঢাকাতেই সীমাবদ্ধ নয়, চট্টগ্রামসহ আরো কয়েকটি শহরে এ্যাপোলোর হাসপাতাল তৈরি হচ্ছে। ঢাকায় নতুন আরেকটি ভবনের কাজ চলছে। তার পরও আমাদের মূল স্বত্বাধিকারী প্রতিষ্ঠান এসটিএস গ্রুপ এখানকার আয় থেকে কোনো টাকা নেয় না। এখানে যা আয় হয় তা দিয়ে আমরা নতুন নতুন কাজ করছি।'
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র জানায়, এ্যাপোলোর অধিক ব্যবসায়িক প্রবণতার বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের নজরে রয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে এ্যাপোলোসহ বড় হাসপাতালগুলো নিয়ে নানান অভিযোগ পাওয়া যায়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওপর এসব বিষয় মনিটরিং করার দায়িত্ব রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) মোমতাজ উদ্দীন ভূইয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, হাসপাতালগুলো পরিচালনা ও রোগীদের কাছ থেকে অধিক হারে বিভিন্ন ফি ও খরচ আদায় নিয়ে অভিযোগ লেগেই আছে। এ জন্য একটা নীতিমালা তৈরির কাজ চলছে। এটা হলে কোনো হাসপাতালই ইচ্ছামতো টাকা নিতে পারবে না।
জাতীয় স্বাস্থ্য আন্দোলনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ ই মাহাবুব বলেন, সরকারের আইনে আছে যেকোনো বেসরকারি হাসপাতালে মোট রোগীর ১০ শতাংশ গরিব রোগীকে বিনা মূল্যে সার্বিক চিকিৎসা দিতে হবে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই এটা মানা হয় না। এ ব্যাপারে সরকারেরও কোনো নজরদারি চোখে পড়ে না।
এ্যাপোলোর মহাব্যবস্থাপক ডা. সাগুফা আনোয়ার এ বিষয়ে বলেন, 'সরকারের নির্দেশনামতো আমরা ১০ শতাংশ ফ্রি সেবা দেই। এখানে যারা ভর্তি হয় কিংবা চিকিৎসা নেয় তাদের ভেতর থেকেই আমরা যাচাই-বাছাই করে ওই কোটা পূরণ করে থাকি। তবে সাধারণ কথায় একেবারে গরিবদের জন্য এ সেবা দেওয়ার সুযোগ নেই।'
তিনি বলেন, 'আমরা যদি একদম হতদরিদ্রদের এখানে সেবা দেওয়ার চেষ্টা করি তবে এখানে যে ভিড় হবে তা সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না।'
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক বলেন, ফ্রি চিকিৎসার বিষয়টি অনেকেই মানছে না। এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট আইন হয়নি। তবে নতুন নীতিমালা তৈরি হচ্ছে। এটা হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ থাকবে।
এদিকে এ্যাপোলোর লাইফ সাপোর্ট নিয়ে অনেক অভিযোগ পাওয়া যায়। অনেক ক্ষেত্রেই অপ্রয়োজনে ভেন্টিলেটর ব্যবহার কিংবা রোগী মারা যাওয়ার পরও ভেন্টিলেটর ব্যবহারের মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার মতো গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।
বর্তমানে অন্য একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রাজশাহী থেকে আসা এক রোগীর স্বজন নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, 'মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের ফলে অচেতন হয়ে পড়ার পর আমার মাকে রাজশাহীর চিকিৎসকের পরামর্শে এ্যাপোলোতে নিয়ে এসে আইসিইউতে ভর্তি করাই। এ সময় হাসপাতালের চিকিৎসকরা তাঁর লাইফ সাপোর্ট লাগবে বলে জানান। টানা সাত দিন লাইফ সাপোর্ট চলার পর খরচ সামলাতে না পেরে মাকে এ্যাপোলো থেকে রাজধানীর আরেকটি অপেক্ষাকৃত ছোট হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানে তাঁকে আইসিইউতে রাখা হলেও ভেন্টিলেটর ব্যবহার করতে হয়নি। বরং আমার মা এখন তুলনামূলক একটু সুস্থ।'
একই ভাবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক রোগীর স্বজন জানান, তাঁর বড় ভাই মারা গেছেন এ্যাপোলো হাসপাতালে। যেদিন রাত ১০টায় মারা গেছেন বলে ডাক্তাররা নিশ্চিত করেন, সেদিন সকালের দিকেই তিনি ভেতরে গিয়ে দেখেছেন তাঁর ভাইয়ের শ্বাস-প্রশ্বাস নেই। বিষয়টি তিনি ওই সময় উপস্থিত চিকিৎসককে জানালেও তাঁরা ভেন্টিলেটর না খুলে আরো পর্যবেক্ষণে রাখার অজুহাত দেখান এবং রাতে মৃত্যুর কথা ঘোষণা করেন। বিল পরিশোধের সময় দেখা যায়, ওই বাড়তি সময়টুকুর বিল যোগ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে এ্যাপোলোর মহাব্যবস্থাপক ডা সাগুফা আনোয়ার বলেন, 'এ ধরনের আজব অভিযোগ অনেক সময় আমাদের কানেও আসে। তবে এর কোনো ভিত্তি নেই। মূলত আইসিইউতে রোগীর স্বার্থেই স্বজনদের ইচ্ছামতো যখন-তখন ঢুকতে না দেওয়ার কারণে তাঁদের মধ্যে নানান ভাবনা কাজ করে। তাঁদের সঠিক সচেতনতা নেই বলেই এমনটা হয়। তা না হলে এমন একটি বিশ্বমানের হাসপাতালের চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে তাঁরা প্রশ্ন তুলতে পারতেন না।'
তিনি বলেন, 'অন্য হাসপাতালের চেয়ে বেশি ফি নেওয়ার বিষয়টি মানুষ যেভাবে দেখে আমরা সেভাবে দেখি না। এখানে যে বিল নেওয়া হয় তা আমাদের সেবা ও রোগীর সার্বিক নিরাপত্তার ব্যবস্থাপনাগত দিক থেকে খুবই যুক্তিযুক্ত। তাদের অন্যদের চেয়ে বেশি মনে হলে হতে পারে। বরং এটা দেখা দরকার যে, যে পরিমাণ টাকা দিচ্ছে সে অনুপাতে সেবা ঠিকমতো রোগীরা পাচ্ছেন কি না।'

ভুল চিকিৎসা
চিকিৎসার নামে অস্বাভাবিক অর্থ আদায়ের অভিযোগের পাশাপাশি এই হাসপাতালের বিরুদ্ধে ভুল চিকিৎসারও অভিযোগ রয়েছে। গত বছরের আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে একজন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তার এক মেয়েকে অসুস্থ অবস্থায় ভর্তি করা হয় এ্যাপোলো হাসপাতালে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ওই রোগীর শরীরে ম্যালেরিয়ার জীবাণু শনাক্ত করা হয়। এর ভিত্তিতে চিকিৎসা চলার একপর্যায়ে ওই রোগীর মৃত্যু ঘটে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক এক কর্মকর্তার সূত্র ধরে বিষয়টি অবহিত হন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে এ্যাপোলো হাসপাতালের পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট ভুল বলে অভিহিত করা হয়।
ওই ঘটনার পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগতত্ত্ব ও রোগ নিয়ন্ত্রণ) ডা. বে-নজীর আহম্মেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এক রোগীর মৃত্যুর পর আমরা জানতে পেরেছি, ওই হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ রোগীর শরীরে ম্যালেরিয়া শনাক্ত করে রিপোর্ট দিয়েছিল। আমরা পরে সেই রিপোর্ট হাতে পাই। এ সূত্র ধরে আমরা বিভিন্ন পদ্ধতিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেও ম্যালেরিয়া জীবাণুর কোনো অস্তিত্ব পাইনি। এমনকি ওই রোগীর অতীত তথ্য সংগ্রহ করেও জানতে পেরেছি, নিকটতম সময়ে তিনি ঢাকার বাইরে, বিশেষ করে ম্যালেরিয়ার ঝুঁকিতে থাকা দেশের ১৩টি জেলার কোনোটিতেই যাননি। তাই ওই রিপোর্টটি আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়নি।'
এ্যাপোলোর মহাব্যবস্থাপক এ বিষয়ে বলেন, 'আমরা রোগীর চিকিৎসা নিরাপত্তা শতভাগ নিশ্চিত করার জন্য সব সময় সতর্ক ও সচেতন থাকি। সব কর্মীকে যথেষ্ট প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ফলে এখানে ভুল চিকিৎসার কোনো সুযোগ নেই।'

দালাল ডাক্তার
এ্যাপোলো হাসপাতালে রোগী পাঠান এমন একাধিক চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে কালের কণ্ঠকে বলেন, এ্যাপোলো কর্তৃপক্ষ এখন কাগজে-কলমে একটি ফরমেট দিয়ে এক ধরনের চুক্তির ব্যবস্থা নিয়েছে। এতে করে অনেক চিকিৎসকই বাইরে থেকে এ হাসপাতালে রোগী পাঠাতে ভয় পাচ্ছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এ্যাপোলোর একজন চিকিৎসক বলেন, 'প্রতি মাসে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসকরা দুই শতাধিক রোগী পাঠান এ হাসপাতালে। এর বিনিময়ে তাঁরা বিশেষ কমিশন পেয়ে থাকেন। অনেক সময় চেকের মাধ্যমে কমিশনের অর্থ পরিশোধ করা হয়। গত মার্চ মাসে ২৪৮ জন রোগী আসে বিভিন্ন চিকিৎসকের মাধ্যমে। এর মধ্যে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, বারডেম, ল্যাবএইড, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, হৃদরোগ হাসপাতাল থেকেও সেখানে কর্মরত চিকিৎসকরা রোগী পাঠিয়েছেন।'
এ প্রসঙ্গে ডা. সাগুফা আনোয়ার বলেন, 'মানুষ ভালোবাসা ও ভালো সেবা পেলে এমনিতেই এখানে আসবে। ভালো সেবা না পেলে জোর করে কাউকে আনা যায় না। বিভিন্ন কারণে আমাদের সম্পর্কে অনেকের ভুল ধারণা থাকতে পারে। সঠিকভাবে না জানার ফলে এটা হয়। আমাদের গোপন কিছু নেই। সব কিছুই উন্মুক্ত।'

হাসপাতালে হোটেল ব্যবসা
এ্যাপোলো হাসপাতালের সামনে হঠাৎ এসে থামে লাল রঙের একটি প্রাইভেট কার। কয়েকজন তরুণ-তরুণী ঝটপট নেমে হাঁটা শুরু করলেন এ্যাপোলোর দিকে। এ সময় ভেতর থেকে বের হতে থাকা তাঁদের পরিচিত একজনকে বলতে শোনা যায়, 'দোস্ত, ঝাক্কাস লাঞ্চ হইছে! যা তোরা খেয়ে আয়।' পাশ থেকে আরেকজন বলেন, 'লাঞ্চ ক্যান, সন্ধ্যায়ও আসবি, এখানকার চিকেন আর নানটা ভালোই হয়।'
জানতে চাইলে হাসপাতালের মূল ফটকের সামনে দাঁড়ানো এক নিরাপত্তাকর্মী বলেন, 'ওনারা কোনো রোগী দেখতে বা নিজেরা কোনো ডাক্তার দেখাতে আসেননি। এসেছেন হাসপাতালের ফুড ভিলেজে। যেখানে বাংলা-চায়নিজ সব ধরনের খাবার পাওয়া যায়। প্রতিদিনই বাইরের বহু মানুষ এখানে খেতে আসে।'
এই কথার সূত্র ধরে গত সোমবার দুপুরে ফুড ভিলেজ নামের রেস্তোরাঁয় গিয়ে দেখা যায় উপচে পড়া ভিড়। জনপ্রতি লাঞ্চ প্যাকেজ শুরু ২০০ টাকা থেকে। এ ছাড়া নিচতলায়ও আলাদা ফাস্ট ফুডের দোকান রয়েছে। দুই জায়গায়ই বহিরাগতদের ভিড় হয় সেখানে। ফলে রোগীদের স্বজন বা দর্শনার্থীরা ঠিকমতো বসার জায়গা পান না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই রেস্তোরাঁর এক কর্মী বলেন, হাসপাতালের রেস্তোরাঁ হলেও এটা সবার জন্য উন্মুক্ত হওয়ায় ভিড় বেশি হয়।
এ্যাপোলো ফুড ভিলেজে বহিরাগতদের অবাধ আগমনের বিষয়টি স্বীকার করে এ হাসপাতালের মহাব্যবস্থাপক বলেন, 'এখানে যারা রোগী হিসেবে আসেন, মূলত তাঁদের স্বজনদের জন্যই ফুড ভিলেজ ও নিচের ফাস্ট ফুডের দোকান করা হয়েছে। ব্যবসা করার উদ্দেশ্যে করা হয়নি। কিন্তু বহিরাগতদের আসা-যাওয়া বন্ধ করতে পারছি না। করতে পারলে ভালো হতো। কারণ অনেক সময়ই বহিরাগতরা এসে দীর্ঘসময় বসে থাকে, ফলে রোগী বা রোগীর স্বজনদের ভোগান্তি হয়। তবে হাসপাতালের চিকিৎসক ও স্টাফদের জন্য আলাদা দুটি ক্যানটিন রয়েছে, সেগুলোতে অন্য কারো যাওয়ার সুযোগ নেই।'

No comments

Powered by Blogger.