চারদিক-পড়ার বাইরের শৈশব by কামনাশীষ শেখর

আজকাল ছোটদের লেখাপড়ার প্রচণ্ড চাপ। স্কুল, কোচিং, প্রাইভেট শিক্ষক—দম ফেলার ফুরসত নেই তাদের। নিজের ওজনের চেয়েও বেশি ওজনের বই-খাতা নিয়ে সারা দিন ছুটছে তারা। এতে হয়তো কেউ কেউ ভালো ফল করছে, কিন্তু তাদের মনের বিকাশ কি ঘটছে?


টাঙ্গাইলে দুই দিনব্যাপী ছোটদের শিক্ষা ও সংস্কৃতি উৎসবে বিভিন্ন অধিবেশনে ঘুরেফিরে এই প্রশ্নটি উঠে এসেছে নানাজনের মুখ থেকে। তবে সবারই এক কথা—পড়াশোনার নামে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে ছোটদের আনন্দ; তাদের শৈশব, কৈশোর। আর তাই তো সুস্থধারার সংস্কৃতিচর্চার মাধ্যমে শিশুদের মানসিক উৎকর্ষ সাধনের উদ্দেশ্যেই এই উৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল বলে জানালেন সমন্বিত শিক্ষা-সংস্কৃতি কার্যক্রম, ফুলকির সমন্বয়কারী (নিরীক্ষণ ও মূল্যায়ন) সৈয়দ আমিনুল হক কায়সার। ২১ মার্চ সকালে টাঙ্গাইল শিল্পকলা একাডেমী চত্বরে উৎসবের উদ্বোধন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের কারুশিল্প বিভাগের চেয়ারম্যান আবদুস শাকুর শাহ। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক মাহবুব আলম, ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার জামিল হাসান, সাবেক সাংসদ ফজলুর রহমান খান বক্তব্য দেন। সমন্বিত শিক্ষা ও সংস্কৃতি কার্যক্রমের অবৈতনিক প্রধান সমন্বয়কারী শীলা মোমেন তাঁর বক্তব্যে উৎসব আয়োজনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন। তিনি বলেন, সংস্কৃতির সঙ্গে বিযুক্ত পরীক্ষা ও মুখস্থনির্ভর শিক্ষা শিক্ষার্থীদের যথার্থ মানসিক বিকাশের অন্তরায়। তাই ফুলকি দীর্ঘদিন ধরে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সঙ্গে সংস্কৃতির যোগ ঘটানোর কাজ করে চলেছে।
ফুলকির একটি প্রকল্প হচ্ছে ‘সমন্বিত শিক্ষা ও সংস্কৃতি কার্যক্রম’। টাঙ্গাইলসহ দেশের সাতটি জেলায় চলছে এই প্রকল্পের কার্যক্রম। টাঙ্গাইলের সাতটি স্কুলে ফুলকির উদ্যোগে চলছে নানা কার্যক্রম। আর এসব স্কুলে শিক্ষার্থীদের সংস্কৃতিচর্চার ফসল দুই দিনব্যাপী ছোটদের শিক্ষা ও সংস্কৃতি উৎসব-২০১১।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর উৎসব চত্বরে শিশুদের চারুকলা প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের অঙ্কন ও চিত্রায়ণ বিভাগের চেয়ারম্যান ফরিদা জামান। আর মিলনায়তনে চলে ফুলকির প্রকল্পভুক্ত তিনটি স্কুলের শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বিকেলে বসে বর্ণালি শিল্প ও সাহিত্য আসর। এতে আবদুস শাকুর শাহ, ফরিদা জামান, রণজিৎ দাস, জাহিদ মুস্তফা, মাহবুব আলমের মতো প্রথিতযশা শিল্পীদের সঙ্গে ছবি আঁকেন টাঙ্গাইলের খুদে আঁকিয়েরা। পাশাপাশি চলে টাঙ্গাইলের কবিদের কবিতা লেখা।
বিকেলে সংস্কৃতিহিতৈষী ফজলুর রহমান খান ফারুকের সভাপতিত্বে সুধী সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন শিশু শিক্ষা বিশেষজ্ঞ মমতাজ জাহান। সমাবেশে বক্তারা বলেন, ‘আমরা শিশুদের মানুষ করতে চাইছি, কিন্তু তাদের খেলার, মুক্তচিন্তার সুযোগ দিতে পারছি না। অথচ তাদের পড়াশোনার জন্য অতিরিক্ত চাপ দিচ্ছি। এত চাপের মধ্যে তারা সামাজিকভাবে বড় হতে পারছে না।’ শিশুদের আগামী দিনের মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে সুস্থ সংস্কৃতিচর্চার জায়গা তৈরি করতে হবে বলে বক্তারা অভিমত প্রকাশ করেন। শেষে আনন্দপাঠ, সোনারতরী ও চট্টগ্রামের রক্তকরবীর শিল্পীরা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করেন।
দ্বিতীয় দিন সকালে শিক্ষাবিদ সেকান্দার হায়াতের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় অভিভাবক সমাবেশ। এতে উপস্থিত ছিলেন টাঙ্গাইল জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আমির হোসেন ও টাঙ্গাইল পৌরসভার মেয়র শহিদুর রহমান খান মুক্তি। সেখানে বক্তাদের এক কথা—শিশুরা আনন্দময় পরিবেশে লেখাপড়ার সুযোগ পাচ্ছে না। মুখস্থনির্ভর লেখাপড়ার জন্য ছুটছে সবাই। এ অবস্থায় শিশুরা মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষ হচ্ছে না। মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষ হওয়ার জন্য তাদের সুস্থ সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় ঘটাতে হবে। তাদের লেখাপড়ার পরিবেশটা আনন্দময় করে তুলতে হবে। উৎসবে আসা মুক্তিযোদ্ধা ও গণসংগীতশিল্পী এলেন মল্লিক বলেন, যে শিক্ষার সঙ্গে আনন্দ নেই, তা কখনো স্থায়ী হয় না। আনন্দের সঙ্গে লেখাপড়া শিখলে শিশুরা সাহসী, আত্মবিশ্বাসী ও দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে।
সন্ধ্যায় আনন্দপাঠ, সোনারতরী ও সমন্বিতের শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট শিল্পী সুজিত মুস্তফা ও কত্থক নৃত্যশিল্পী তাবাসসুম আহমেদের নৃত্য পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শেষ হয় দুই দিনব্যাপী উৎসব। ছোট-বড় সবাই মিলনায়তন থেকে বের হয়। এ সময় বাড়ি ফিরতে ফিরতে অনেক শিশুই গেয়ে ওঠে, ‘বাংলা ভূমির প্রেমে আমার প্রাণ হইল পাগল, বাংলা প্রেমে ঢালমু আমার দেহ মনের বল গো...’
কামনাশীষ শেখর

No comments

Powered by Blogger.