বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৩৬১ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। নূরউদ্দীন আহমেদ, বীর প্রতীক অমিত সাহসী এক যোদ্ধা শেষ রাত। এমন সময় নূরউদ্দীন আহমেদসহ একদল মুক্তিযোদ্ধার নিঃশব্দে অবস্থান পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাম্পের কাছে।
তাঁদের অবস্থান থেকে ক্যাম্প ৫০-৬০ গজ দূরে। সময় গড়াতে থাকল। ভোর হয় হয়, তাঁদের অধিনায়ক আক্রমণ শুরু করার সংকেত দিলেন। নিঃস্তব্ধতা খান খান করে একযোগে গর্জে উঠল মুক্তিযোদ্ধা সবার অস্ত্র। ভীতসন্ত্রস্ত পাকিস্তানি সেনারাও পাল্টা আক্রমণ শুরু করল। গোলাগুলির শব্দে গোটা এলাকা প্রকম্পিত। ঘণ্টা দুই যুদ্ধ করে মুক্তিযোদ্ধারা বেশির ভাগ নিরাপদে সরে গেলেন পেছনে। তাঁদের আকস্মিক আক্রমণে হতাহত হলো বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা। পাল্টা আক্রমণে শহীদ হলেন নূরউদ্দীন আহমেদের কয়েকজন সহযোদ্ধা। এ ঘটনা দিলকুশা চা-বাগানে। ১৯৭১ সালের মধ্য জুলাইয়ে।
দিলকুশা চা-বাগান মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলার অন্তর্গত। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে চার মাইল দূরে। সীমান্তের ওপারে কুকিতলে ছিল মুক্তিবাহিনীর ৪ নম্বর সেক্টরের একটি সাব-সেক্টর। এই সাব-সেক্টরের গণবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা প্রায় সীমান্ত অতিক্রম করে হিট অ্যান্ড রান পদ্ধতিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ওপর আক্রমণ চালাতেন। এরই ধারাবাহিকতায় সে দিন তাঁরা দিলকুশা চা-বাগানে আক্রমণ করেন। সেখানে ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর শক্ত এক ঘাঁটি। এই ঘাঁটির মাধ্যমে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সীমান্ত এলাকায় নজরদারি করত।
মুক্তিবাহিনীর কয়েকটি দলের সমন্বয়ে এই আক্রমণ পরিচালিত হয়। তাঁরা বিভক্ত ছিলেন তিনটি অ্যাসল্ট পার্টি ও তিনটি কাট অফ পার্টি হিসেবে। অ্যাসল্ট পার্টি বা আক্রমণকারী দলে ছিলেন নূরউদ্দীন আহমেদ। পরিকল্পনামাফিক কুকিতল থেকে রওনা হয়ে রাত দুইটায় তাঁরা লাঠিটিলায় পৌঁছেন। সেখান থেকে ভোর পাঁচটার আগেই দিলকুশা চা-বাগানে যান। তাঁরা অবস্থান নেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাম্প থেকে ৫০-৬০ গজ দূরে। অ্যাসল্ট পার্টির মুক্তিযোদ্ধারা তিন দিক থেকে আক্রমণ চালান। আকস্মিক আক্রমণে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। কয়েকজন নিহত ও অনেকে আহত হয়।
দিলকুশা চা-বাগান দখল করা মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ্য ছিল না। অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত করাই ছিল তাঁদের লক্ষ্য। আক্রমণ করেই মুক্তিযোদ্ধাদের সেখান থেকে সরে পড়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা তাঁরা করতে পারেননি। নিজেদের মধ্যে ভুল-বোঝাবুঝি হওয়ায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকক্ষণ মুখোমুখি যুদ্ধ করতে হয়। মুখোমুখি যুদ্ধে নূরউদ্দীন আহমেদ যথেষ্ট বীরত্ব প্রদর্শন করেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পাল্টা আক্রমণে মুক্তিবাহিনীরও কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়। ছয়জন মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গুলিতে শহীদ হন।
নূরউদ্দীন আহমেদ ১৯৭১ সালে দশম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধ করেন ৪ নম্বর সেক্টরের কুকিতল ও জালালপুর সাব-সেক্টরের অধীনে। লাঠিটিলা, ছোটলেখা, কানাইঘাটসহ আরও কয়েকটি স্থানের যুদ্ধে তিনি অংশ নেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য নূরউদ্দীন আহমেদকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৩৫৩।
নূরউদ্দীন আহমেদের পৈতৃক বাড়ি হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলার গজনাইপুর ইউনিয়নের সাতাইহাল গ্রামে। বর্তমানে বাস করেন ৪৩৭/৩ পূর্ব গোড়ানে, ভাড়া বাড়িতে। তাঁর বাবার নাম তমিজউদ্দীন আহমেদ। মা তাহমিনা বেগম। স্ত্রী সুলতানা তাইবুন নাহার। তাঁদের এক ছেলে, দুই মেয়ে।
সূত্র: নূরউদ্দীন আহমেদ, বীর প্রতীক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৪।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.