শুধু সংসদীয় অভিশংসন প্রথার প্রবর্তন কাম্য নয়-বিচারকদের জবাবদিহি

বিচারক অপসারণে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বিলোপ করে সংসদীয় অভিশংসন বা ইমপিচমেন্টের বিধান পুনরুজ্জীবনের সিদ্ধান্তকে আমরা নীতিগতভাবে সমর্থন করি। কিন্তু উচ্চ আদালতের শুধু জবাবদিহির প্রশ্নে সংসদের কাছে এটা ফেরত আনার দাবি বিভ্রান্তিকর। কারণ, বিচারকদের জবাবদিহির সঙ্গে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্ন অবিভাজ্য।


এতে বিচার বিভাগ স্বাধীন করার বিষয়ে স্পষ্ট উচ্চারণ পাওয়া যায় না।
জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালে সংসদ বিলুপ্ত থাকা অবস্থায় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল প্রবর্তন করেছিলেন। অভিশংসন প্রথা সংসদ ছাড়া কার্যকর করা যায় না। তাই জিয়ার পদক্ষেপে একটি শাসনগত শূন্যতা পূরণ হয়েছিল। জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান আমাদের ভূখণ্ডে সামরিক সাংস্কৃতিক ফসল। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নের সময় তর্ক হয়েছিল যে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল নাকি সংসদীয় অভিশংসনের মাধ্যমে বিচারকদের অপসারণ করা হবে। জনপ্রতিনিধিরা বিচারক অপসারণ করার মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে যথেষ্ট প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার পরিচয় না দিতে পারেন—এই শঙ্কা তখনো ছিল। শেষ পর্যন্ত ১৯৫৬ সালের সংবিধানে সংসদীয় অভিশংসনের বিধানই যুক্ত করা হয়েছিল। আটান্নর প্রথম সামরিক শাসনে সংবিধান ধ্বংসপ্রাপ্ত হলো। ১৯৬২ সালে জেনারেল আইয়ুব খান প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পাকিস্তানের সংবিধানের দেহে প্রতিস্থাপন করলেন। জেনারেল জিয়া ওই বিধানটি বাংলাদেশে যেভাবে নকল করেছিলেন, তার দ্বিতীয় নজির নেই। নব্বইয়ের দশকের গণতান্ত্রিক অভ্যুত্থানের পর নেপালের সংবিধানে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল যুক্ত করা হলেও তার গঠনশৈলী সম্পূর্ণ ভিন্ন। নেপালি কাউন্সিল শুধু অপসারণ নয়, বিচারক নিয়োগও নিশ্চিত করে থাকে।
লক্ষণীয় যে ৩৪ বছর পর বাংলাদেশের সংসদ এমন একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, যাতে জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। সাংসদদের পরিপক্বতা ও প্রজ্ঞা নিয়ে যেভাবে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, তা আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে স্বাধীন বাংলাদেশের ৪০ বছর পর আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ৬০ বছর পেছনে ফিরছে কি না। যাঁরা অভিশংসন প্রথার প্রত্যাবর্তনের বিরোধিতা করছেন, তাঁদের যুক্তি ও উদ্বেগ উড়িয়ে দেওয়ার নয়। তবে আমরা মনে করি, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বিলোপ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সংসদীয় কমিটি আপনা-আপনি আরেকটি যৌক্তিক ও সম্পূরক দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। আর সেটা হলো, সংসদীয় গণতন্ত্রের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বর্তমানে সংবিধানে থাকা প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতা কমিয়ে আনা, স্বাধীনভাবে ভোট দিলে সংসদের আসন বাতিল হওয়াসংক্রান্ত ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করা এবং সর্বোপরি উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে কমিশন গঠন করা। এসব না করা হলে শুনতে যতই মধুর হোক, বাস্তবে বিষয়টির কোনো পরিবর্তন হবে না। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল প্রধানমন্ত্রী বা সংসদ নেতার সম্মতি ছাড়া বৈঠকে বসতেই অক্ষম। তেমনি সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে পাস করার বিধানসংবলিত অভিশংসন প্রস্তাব—সেই একই সংসদ নেতা বা প্রধানমন্ত্রী সম্মত না হলে তা অকার্যকরই থেকে যেতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.