চলচ্চিত্র শিল্প-সৃষ্টিশীলতার দ্বার খুলে যাক

জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার-২০১০ প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প নিয়ে যে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন তা নিঃসন্দেহে এ শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের প্রাণিত করেছে। ক্রিকেট থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক আদালতে সমুদ্রসীমা জয়ের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে, চলচ্চিত্র ক্ষেত্রেও আমরা সাফল্য


ছিনিয়ে আনতে পারব। তিনি চলচ্চিত্রকে শিল্প ঘোষণার আশ্বাসও দিয়েছেন। সরকারের তরফে এমন ইতিবাচক মনোভঙ্গি চলচ্চিত্র শিল্পের সম্ভাবনাকে নতুন মাত্রায় বিকশিত করতে পারে। সত্যি কথা বলতে, বিশ্বজুড়ে যখন বিনোদন বাণিজ্যের রমরমা তখন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনের দুর্দশাজনক চিত্র একই সঙ্গে বিস্ময় ও হতাশার জন্ম দিয়ে চলেছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের চলচ্চিত্র উপমহাদেশ ছাড়িয়ে যখন বিশ্বজুড়েই বড় একটি বাজার সৃষ্টি করতে পেরেছে, তখন আমাদের চলচ্চিত্র ক্রমাগত অভ্যন্তরীণ বাজার হারাচ্ছে। এমন নয় যে, এ দেশের চলচ্চিত্রকে প্রেক্ষাগৃহে বিদেশি চলচ্চিত্রের সঙ্গে তীব্র প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে। বরং চলচ্চিত্র নিয়ে সংরক্ষণমূলক মনোভাবের কারণে বিদেশি চলচ্চিত্র বহুকাল প্রেক্ষাগৃহে মুক্তিই পায়নি। বলতে গেলে এ দেশের চলচ্চিত্র দিনের পর দিন নিজের সঙ্গে নিজের প্রতিযোগিতায় হেরেছে। কেন এমন হলো তা অনুসন্ধান করা চলচ্চিত্রের নবযাত্রার জন্য অত্যন্ত জরুরি। চলচ্চিত্র বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের মতে, আমাদের চলচ্চিত্র সময়ের সঙ্গে প্রজন্মের পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেনি। এ কথা যেমন প্রেক্ষাগৃহের সম্পর্কে সত্য, তেমনি সত্য নতুন প্রযুক্তি আত্মস্থ করার ক্ষেত্রেও। তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, এ শিল্পটি নতুন প্রজন্মের সৃষ্টিশীল ও মেধাবী তরুণদের আকৃষ্ট করতে পারেনি। বিগত কয়েক দশক ধরে বিশ্বজুড়ে বিনোদন বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যে বিপুল পরিবর্তন ঘটেছে, নতুন প্রজন্মের প্রযোজক, পরিচালক ও কলাকুশলীরা এ শিল্পকলাকে যে মাত্রায় অভিষিক্ত করেছেন তার কতটা ছাপ এ দেশের চলচ্চিত্রে পড়েছে তা রীতিমতো গবেষণার বিষয়। মেধাবী ও সৃষ্টিশীলদের অনুপস্থিতির কারণে চলচ্চিত্রের ললাটে জুটেছে অনুকারকের অভিধাও। দেশে যে নতুন নির্মাতা ও কলাকুশলীদের বিশেষ অভাব রয়েছে তা নয়। বরং বাস্তবচিত্র হলো, নতুন নির্মাতাদের রীতিমতো লড়াই করে যেতে হচ্ছে টিকে থাকার জন্য। অভিযোগ রয়েছে, এফডিসিতে এদের প্রবেশাধিকার অবারিত নয়। বিকল্পধারার চলচ্চিত্র আন্দোলন এ দেশে অনেক বিশ্বমানের চলচ্চিত্রকারের জন্ম দিয়েছে। কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের খুব একটা ধারণ করতে পারেনি। কিছু বেসরকারি উদ্যোগ বেশ উৎসাহব্যঞ্জক, সরকারি অনুদানে ছবি তৈরির কিছু উদাহরণও প্রশংসনীয়। বিনোদন বাণিজ্যের বড় ক্ষেত্রে একে শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য যে পরিকল্পনা থাকা দরকার তা কি আমাদের আছে? পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আজও চলচ্চিত্র শিক্ষার কোনো ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। অভিনয়সহ নাট্যশিক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও শিক্ষা শেষে শিক্ষার্থীরা চলচ্চিত্রে আত্তীকৃত হতে পারেন না। ফিল্ম সোসাইটি মুভমেন্টের মাধ্যমে গড়ে ওঠা তরুণরাও এফডিসির সমর্থন পান না। এ অবস্থায় চলচ্চিত্র শিল্পে নতুনদের যুক্ত হওয়ার স্বীকৃত পদ্ধতি কী? শিল্পে নতুন প্রাণসঞ্চার করতে হলে সৃজনশীল ও মেধাবী তরুণদের বিকল্পই-বা কী? চলচ্চিত্র প্রদর্শনের জন্য পুরনো প্রেক্ষাগৃহের স্থানে নতুন সিনেপ্লেক্স জায়গা করে নিয়েছে সব দেশেই। আমাদের দেশে পুরনোটা নতুন করে সেজে উঠবার বদলে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। দর্শকরা হল-বিমুখ হয়ে পড়ছে। এ অবস্থা থেকে ফিরে আসতেই হবে। সেটি করতে হলে প্রথমত ও প্রধানত ভালো সিনেমা বানাতে হবে। সিনেমা ভালো হলে দর্শক তা দেখবেই। আর দর্শক বাড়তে থাকলে চলচ্চিত্র অঙ্গনের বহু সমস্যাই অস্তিত্বহীন হয়ে পড়বে। সে জন্য সবকিছুর আগে বছরে অন্তত ৫০টি ভালো সিনেমা চাই। আর সেটি করতে হলে অন্তত ৫০ জন নতুন পরিচালকের জন্য দ্বার উন্মুক্ত করতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.