জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার-প্রথমবারের মতো শাকিব-পূর্ণিমার ঘরে by কামরুজ্জামান

অভিনয়ের এক যুগে এর চেয়ে আনন্দময় ঘটনা আর কী-ই বা হতে পারে শাকিব খানের জন্য? পেলেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সেরা অভিনেতার মর্যাদা। পুরস্কার নেওয়ার জন্যই তিনি কক্সবাজার থেকে ছুটে এলেন ঢাকায়। পরের দিন আবার চলে গেলেন কক্সবাজারে।


ভীষণ আনন্দিত তিনি। ভালোবাসলেই ঘর বাঁধা যায় না ছবিতে অভিনয়ের জন্য তিনি পুরস্কৃত হয়েছেন।
‘ভালোবাসলেই ঘর বাঁধা যায় না ছবিতে অভিনয়ের সময় আমি এবং আমাদের ছবির ইউনিটের প্রত্যেকই একটা কথা বলেছি যে এই ছবি ব্যবসায়িকভাবে যেমন সফল হবে, তেমনি আবার স্বীকৃতিও পাবে। ছবির গল্পটি পরিচালক এমনভাবে উপস্থাপন করেছিলেন যে আমাদের সবার আত্মবিশ্বাসটা বেড়ে গিয়েছিল,’ বলছিলেন শাকিব খান।
১২ বছরে শাকিব অভিনয় করেছেন শতাধিক ছবিতে। শুধু কি এই একটি ছবি নিয়েই তিনি প্রত্যাশা করেছিলেন?
শাকিবের না-সূচক জবাব।
‘যখন সুভা ছবিটিতে কাজ করলাম, তখন মনে হয়েছিল, এ ছবিটি দিয়ে আমি একটা বড় স্বীকৃতি পাব। যখন পেলাম না, তখন মন খারাপ যতটা হয়েছে, তার চেয়ে জেদটা বেশি হয়েছিল যে আমি যেন আরও ভালো করি এবং স্বীকৃতিটা আমার মেলে। এরপর বেশ মন দিয়েই কাজ করলাম। তা-ও পাইনি। তখন মনে হলো, আসলে ভাগ্য সহায় না হলে পাব না। তবে দুঃখ অনুভব করিনি এই কারণে যে দর্শকদের কাছ থেকে অনেক বড় স্বীকৃতি আমি এর মধ্যেই পেয়ে গেছি। সিনেমায় যে একটা পরিবর্তন হলো, সেখানে যখন নিজের উপস্থিতির কথা ভাবি, তাতেও অনেক আনন্দিত হই। আর এভাবেই মিলে গেল এবারের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।’
শাকিব এমন একটা সময় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেলেন, যখন সিনেমার বাজার মন্দা। একের পর এক সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তাঁর অভিনীত চলচ্চিত্রগুলোও এখন আর সপ্তাহের সাত দিনই প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ করতে পারছে না। শাকিব নিশ্চয়ই বিচলিত?
‘দেখুন, প্রত্যেকটি মানুষের জীবনের কিছু উত্থান-পতন থাকে। পুরো সিনেমারই হয়তো খারাপ সময় এখন যাচ্ছে। তার মানে কিন্তু এই নয় যে সবকিছুই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এখন বরং সিনেমার নির্মাতারাই নতুন করে সবকিছু ভাবতে শুরু করেছেন। গল্প থেকে শুরু করে সিনেমা নির্মাণের ভাবনাতেও পরিবর্তন আসছে। আমি তো সিনেমার বাইরে আলাদা কিছু নই। ফলে আমাকেও এখন অনেক কিছু ভাবতে হচ্ছে। এই যে খারাপ সময়টার কথা বলা হচ্ছে, এই খারাপ সময়টা কিন্তু স্থিতিশীল নয়। আমরা অবশ্যই এখান থেকে বেরিয়ে আসব। ’
শাকিব তাঁর ক্যারিয়ার প্ল্যানিংয়েও পরিবর্তন এনেছেন। সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আগের মতো আর বেশি বেশি কাজ নয়। বছরে যদি তিনি পাঁচটি ছবিতে কাজ করেন, সেগুলো হতে হবে ভালো গল্পের সিনেমা, ভালো চরিত্র থাকতে হবে।
প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার বিষয়েও শাকিবের খোলামেলা কথা হচ্ছে, ভালো সিনেমা হল যদি দেশে ৩০০টিও থাকে, তবুও মানুষ সেখানে যাবে। কিন্তু নামে শুধু সিনেমা হল—এমন ৬০০ সিনেমা হল থেকেও কোনো লাভ নেই। ডলবি ডিজিটাল সিনেমা হলের এখন বেশি প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।
১৫ বছরে প্রায় ৮০টি ছবিতে অভিনয় করেছেন পূর্ণিমা। বহু ব্যবসাসফল ছবি উপহার দিয়েছেন তিনি। পেয়েছেন তারকা খ্যাতি। মনের মধ্যে দুঃখবোধ ছিল একটাই—জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া হলো না তাঁর। তবে এবার সেই দুঃখ ঘুচল। ওরা আমাকে ভালো হতে দিল না ছবিতে অভিনয়ের জন্য তিনি পেয়েছেন সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার।
৩ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে এ পুরস্কার নেন তিনি।
৩ এপ্রিল বেশ সকালেই ঘুম ভেঙে যায়। আস্তে আস্তে প্রস্তুতি নিতে থাকেন তিনি। কিন্তু ঘড়ির কাঁটা যেন থমকে আছে। একটু পর পর দেয়ালে টানানো ঘড়িটার দিকে চোখ দেন। আর কিছু সময় পরই তিনি রওনা হবেন।
পূর্ণিমা এমন একটি সম্মানের পুরস্কারের আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন প্রায়। কারণ, শাস্তি ছবিতে অভিনয় করার সময় প্রত্যাশা করেছিলেন যে এ ছবিতেই তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাবেন। সেবার হতাশ হয়েছিলেন। এরপর সুভাতে অভিনয় করে আশা করেছিলেন পুরস্কারটি পাবেন। এবারও তিনি আশাহত হলেন। মেঘের পর মেঘ ছবিতেও যখন পুরস্কারটি পেলেন না, তখন তিনি মনে করেছিলেন, পুরস্কারটি বোধ হয় আর পাবেন না।
সবুরে মেওয়া ফলে। তাই পূর্ণিমা ওরা আমাকে ভালো হতে দিল না ছবিতে অভিনয়ের জন্য পেয়ে গেলেন পুরস্কারটি।
‘কে না চায় দেশের সেরা স্বীকৃতি পেতে। সেদিক থেকে বলব যে আমাকে অনেক দিন অপেক্ষা করতে হলো। আমি পরিচালক কাজী হায়াতের কাছে কৃতজ্ঞ যে তাঁর কল্যাণেই ওরা আমাকে ভালো হতে দিল না ছবিতে অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছিলাম। এখন বলতে পারেন আমার অভিনয়জীবনে না-পাওয়ার কোনো বেদনা থাকল না,’ বলছিলেন পূর্ণিমা।
পূর্ণিমার মতে, পুরস্কার মানেই একটা ধ্যান-ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে ভিন্নধারার ছবিতে অভিনয় করতে হয়। এবারের পুরস্কারগুলো অবশ্য সেই ধ্যান-ধারণাকে ভুল বলে প্রমাণিত করেছে। বাণিজ্যিক ছবিতেও যে ভালো কাজ করার সুযোগ থাকে, তা প্রমাণিত হয়েছে।
এমন একটি সময় পূর্ণিমা এ পুরস্কার পেলেন, যখন বাংলা সিনেমা রুগ্ণ শিল্পে পরিণত হয়েছে। কারও কারও মতে, এই শিল্প এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। কথাগুলো মানেন পূর্ণিমা। ‘কয়েক দিন আগে এফডিসিতে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে যা দেখলাম, তা দেখে কষ্ট লাগল। ভুতুড়ে একটা পরিবেশ। বেশির ভাগ শুটিং-ফ্লোর বন্ধ। লোকজনের আনাগোনা নেই। ’
এই প্রতিকূলতার মধ্যেও পূর্ণিমার আত্মবিশ্বাস যে এ শিল্পে বিপ্লব আসবেই। আবার নতুন করে, নতুন উদ্যমে ঘুরে দাঁড়াবে চলচ্চিত্রশিল্প।
পূর্ণিমা অভিনীত জজ ব্যারিস্টার, পুলিশ কমিশনার দ্রুত নির্মাণের পথে। ইফতেখার ফাহমির টু বি কন্টিনিউ-র কাজ শেষ। মোস্তফা কামাল রাজের ছবির শুটিং করছেন এখন তিনি। জানালেন, চ্যানেল আইয়ের আরও দুটি ছবিতে অভিনয়ের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন তিনি।
যে মানুষটি আগে মাসে প্রায় ২০ দিন শুটিং-ডাবিং নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করতেন, এখন তিনি মাসে সাত থেকে আট দিন শুটিং নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। জানতে চাইলাম, সময়গুলো পার করেন কীভাবে?
‘নির্মাণাধীন ছবির চরিত্রগুলো নিয়ে ভাবি, শুটিংয়ের জন্য প্রস্তুতি নিই, পোশাক তৈরি করি, মাঝেমধ্যে ভ্রমণে যাই ঢাকার আশপাশে, ভালো ভালো সিনেমা দেখি—সময় কেটে যায় এভাবেই। আশার কথা হচ্ছে, এখন সিনেমার ফরম্যাট বদলে যাচ্ছে। ডিজিটাল সিনেমা হচ্ছে। তরুণ নির্মাতারা বিভিন্ন ভাবনা নিয়ে সিনেমা নির্মাণে আসছেন। তাঁদের কারও কারও পাণ্ডুলিপি পাচ্ছি, সেগুলো পড়ে মনে হচ্ছে, আমাদের সিনেমা মন্দা সময়টা পার করে এই তরুণ নির্মাতাদের মাধ্যমেই আবার নতুন যুগের সূচনা করবে। সেই সময়ের অপেক্ষায় আছি আমরা সবাই।’

No comments

Powered by Blogger.