ডেসটিনির বিরুদ্ধে তদন্তে নেমেছে দুদক-এনবিআর-ডাকা হতে পারে চেয়ারম্যান এমডি ও পরিচালকদের

মাল্টি লেভেল মার্কেটিং কম্পানি ডেসটিনি-২০০০ লিমিটেডের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সমবায় আইনের আওতায় কর অব্যাহতির সুযোগের অপব্যবহার করে ডেসটিনি গ্রুপ রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে কি না- তা খতিয়ে দেখছে এনবিআর।


আর স্বপ্রণোদিত হয়ে দুদক তদন্ত করছে মানি লন্ডারিং ও প্রতারণার অভিযোগ।
গতকাল বুধবার এনবিআরের সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি) থেকে জরুরিভিত্তিতে এসব বিষয়ের ওপর তদন্ত শুরু করা হয়েছে। এনবিআর সূত্রে জানা যায়, সোমবার সিআইসির কর্মকর্তাদের নিয়ে ২০ সদস্যের টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। কমিটি পুরো বিষয়টি সরেজমিন যাচাই-বাছাই করে এনবিআরের চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন আহমেদের কাছে প্রতিবেদন জমা দেবে। তদন্তের স্বার্থে ডেসটিনি গ্রুপের দাপ্তরিক কাগজপত্র, আর্থিক লেনদেনের হিসাব সংগ্রহের প্রক্রিয়া শুরু করেছে এনবিআর। প্রয়োজনে তদন্ত কমিটি ডেসটিনি গ্রুপের চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রতিষ্ঠানের পরিচালকদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করবে। একই সঙ্গে এসব ব্যক্তির পরিবারের সদস্যদেরও ডাকা হতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের নির্দেশে এনবিআর জরুরিভাবে এই তদন্তকাজ শুরু করেছে বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
টাস্কফোর্সের প্রধান সমন্বয়কারী এবং এনবিআরের সদস্য (গোয়েন্দা, অডিট ও তদন্ত) মোহাম্মদ আলাউদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বিষয়টির সঙ্গে যেহেতু অনেক সাধারণ মানুষ জড়িত, তাই তদন্ত গুরুত্বের সঙ্গেই করা হবে। আপাতত ডেসটিনি গ্রুপের ১০টি প্রতিষ্ঠানের আয়কর, ভ্যাট ও শুল্ক ফাঁকির বিষয়টি বিস্তারিতভাবে যাচাই করা হচ্ছে। অর্থপাচারের বিষয়টিও এর সঙ্গে জড়িত আছে কি না- তা পরীক্ষা করা হচ্ছে।' দ্রুততম সময়ের মধ্যে তদন্ত শেষ করা হবে বলে জানান মোহাম্মদ আলাউদ্দিন। তিনি জানান, তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত ডেসটিনি গ্রুপের আর্থিক লেনদেনের ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপের ব্যাপারে এনবিআর থেকে সুপারিশ করা হবে না।
নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে এনবিআরের আরেক কর্মকর্তা বলেন, বিষয়টি সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। তাই পুরো বিষয়টি এনবিআরের নিয়ন্ত্রণে নেই।
এনবিআরের গোয়েন্দা শাখার সূত্রে জানা যায়, ডেসটিনির চালু প্রতিষ্ঠানগুলোর গত ১০ বছরের ব্যাংক হিসাব সংগ্রহ করা হচ্ছে। এর মধ্যে মেয়াদি ও সঞ্চয়ী আমানত এবং এফডিআরের পরিমাণ জানতে চাওয়া হয়েছে। তবে বৈদেশিক লেনদেনের পরিমাণ বিশেষভাবে দেখা হবে। এসব হিসাব জানতে এনবিআর থেকে আয়কর আইনের আওতায় সব সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে চিঠি দেওয়া হয়েছে। সব হিসাব আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে এনবিআরে পাঠাতে হবে। অন্যথায় ওই সব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সিআইসির এক কর্মকর্তা বলেন, গত এক বছর থেকে অর্থপাচারের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে বড় বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, করপোরেট হাউস নজরদারিতে রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের তালিকায় ডেসটিনি গ্রুপও ছিল। তিনি আরো বলেন, ডেসটিনি গ্রুপের চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও পরিচালকদের এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাব চাওয়া হয়েছে। এসব ব্যক্তি কোন তারিখে কত টাকা কোন অ্যাকাউন্টে পাঠিয়েছেন, সেসবের হিসাবও নেওয়া হচ্ছে।
ডেসটিনির ১০টি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য জানতে সংশ্লিষ্ট কর অঞ্চল এবং কম্পানি সার্কেলে সোমবার টাস্কফোর্স থেকে যোগাযোগ করা হয়েছে। তাদের সব তথ্য বৃহস্পতিবারের মধ্যে এনবিআরে পাঠাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এনবিআরের তথ্যে জানা যায়, ২০০৯ সালের ৩০ জুন ডেসটিনি গ্রুপের সম্পদের পরিমাণ ছিল ২৩ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। কিন্তু ২০১১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় তিন হাজার ১৮৩ কোটি টাকা।
পৃথকভাবে তদন্তে নেমে গতকাল ডেসটিনির কাছ থেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করেছে দুদকের টিম। দুদক কমিশনার এম বদিউজ্জামান এ তথ্য জানিয়ে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আগে আমরা ডেসটিনির প্রতারণার বিষয়টি খুঁজে বের করব। পরে দেখব, প্রতারণার মাধ্যমে অর্জিত অর্থ কোথায় গেছে। তদন্তের বিষয়ে আমরা কাউকেই ছাড় দেব না।'
ডেসটিনির প্রতারণা ও জনস্বার্থবিরোধী কাজের প্রতিকার চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০০৪ ও ২০০৫ সালে অর্থ মন্ত্রণালয়কে পৃথক চিঠি দেয়। ২০১১ সালে তারা চিঠি দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। বদিউজ্জামান বলেন, 'আমরা ওইসব চিঠি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে চাইব। কী কারণে ডেসটিনির বিরুদ্ধে এত দিন ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি, তা-ও খতিয়ে দেখা হবে।' তিনি জানান, দুদকের উপপরিচালক মোজাহার আলী সরদারকে প্রধান করে এরই মধ্যে দুই সদস্যের একটি টিম গঠন করা হয়েছে। টিমের অন্য সদস্য হলেন সহকারী পরিচালক তৌফিকুল ইসলাম। প্রয়োজনে সদস্য সংখ্যা আরো বাড়নো হবে।
ডেসটিনির বিষয়ে তদন্তের কথা স্বীকার করে দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, 'গত কয়েক দিন ধরে পত্র-পত্রিকায় লক্ষ্য করছি, ডেসটিনির বিরুদ্ধে শত শত কোটি টাকার কর ফাঁকি, অবৈধ ব্যাংকিং, প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ এবং অবৈধভাবে টাকা হস্তান্তর, রূপান্তর ও স্থানান্তরের খবর প্রকাশিত হচ্ছে। এসব খবরকে আমরা আমলে নিয়েছি। দুদক স্বপ্রণোদিত হয়ে কাজ শুরু করেছে।'
গোলাম রহমান বলেন, দুদকের তফসিলভুক্ত অপরাধ অনুসন্ধানে ইতিমধ্যে দুজন অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে দুদক গুরুত্ব সহকারে কাজ করবে। অপরাধী যিনিই হোক না কেন, তাঁকে আইনের আওতায় আনা হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'দুদকের অবস্থান কোনো মাল্টি লেভেল কম্পানির বিরুদ্ধে নয়। আমাদের বিবেচ্য হলো, ডেসটিনি মানি লন্ডারিং ও দুদকের তফসিলভুক্ত কোনো অপরাধ করেছে কি না।'
এদিকে জয়েন্ট স্টক কম্পানিজ ও ফার্মগুলোর পরিদপ্তরের রেজিস্ট্রার আহমেদুর রহিমকে প্রধান করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের গঠিত আরেকটি তদন্ত কমিটি আগামী ১০ এপ্রিল বৈঠক করবে। ডেসটিনির বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের তদন্ত কিভাবে সূক্ষ্মভাবে শেষ করা যায়, তা নির্ধারণ করতেই ওই বৈঠক করা হবে।
জানা যায়, ডেসটিনি গ্রুপের ৩৭টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সচল ১০টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে- ডেসটিনি সাসকো প্রপার্টিজ, ডেসটিনি শপিং সেন্টার, ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি, ডেসটিনি ট্রি প্লান্টেশন, ডেসটিনি ইলেকট্রিক অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস সোসাইটি, এয়ার ডেসটিনি লিমিটেড, ডেসটিনি হিটাচি ইলেকট্রিক ইন্ডাস্ট্রিজ, অ্যাডুকেশন অ্যান্ড হেলথ ফাউন্ডেশন, দৈনিক ডেসটিনি এবং বৈশাখী টেলিভিশন।

No comments

Powered by Blogger.