ন্যক্কারজনক তৎপরতা-তদন্তের ভিত্তিতে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হোক

২০০৯ সালেও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) গুদামে আগুন লাগিয়ে কয়েক কোটি টাকার বই ও কাগজ পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল নতুন সরকারকে বেকায়দায় ফেলা। কিন্তু সেবার অনেক কষ্টে সময়মতোই ছাত্রদের হাতে বই তুলে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল।


তখন সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে ব্যর্থ হয়ে এবার ষড়যন্ত্রকারীরা আরো বড় ধরনের পরিকল্পনা করছিল। গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যমতে, এনসিটিবি ভবনের দশম তলায় এক কর্মকর্তার কক্ষে গত মঙ্গলবার বিকেল ৩টায় বোর্ডেরই কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী গোপন বৈঠক করেছেন। তাতে বিস্তারিত পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিধি বাম। বৈঠকের বিষয়টি গোয়েন্দা সংস্থার অবগতিতে চলে আসে। এর চেয়ে জঘন্য কাজ আর কী হতে পারে?
খুব ভালো গণতন্ত্র না হলেও বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ। এখানে নানা মত ও পথের রাজনীতি রয়েছে। প্রায় প্রতি নির্বাচনেই প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল বা জোটের মধ্যে ক্ষমতার পালাবদল হচ্ছে। কিন্তু বিপক্ষ রাজনীতির সরকারকে বেকায়দায় ফেলা কিংবা অরাজকতা সৃষ্টির জন্য এ ধরনের ঘৃণ্য তৎপরতা চালানো হবে কেন? মাধ্যমিক ও প্রাথমিক পর্যায়ে ছাত্ররা যদি সময়মতো বই না পায়, তাহলে সমস্যায় পড়বে কারা? ক্ষতিগ্রস্ত হবে কারা? সব মত ও পথের অভিভাবক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তাঁদের সন্তানদের লেখাপড়া বিঘি্নত হবে। দেশের শিক্ষার অগ্রগতি ব্যাহত হবে। এটা কি সুস্থ দেশবাসীর কাম্য হতে পারে? তা-ও আবার এই ঘৃণিত পরিকল্পনা করছেন তাঁরাই, যাঁদের হাতে সুষ্ঠুভাবে বই মুদ্রণ ও বিতরণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সেই এনসিটিবির একশ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারী। এ কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য প্রতি মাসেই এনসিটিবির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সরকারের কাছ থেকে বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পেয়ে আসছেন। ছিঃ! আমাদের ভাবতেও কষ্ট হয় এ ধরনের জঘন্য মনোবৃত্তির অধিকারী লোকজন সরকারের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে কাজ করে। আজকের এই দুরবস্থার জন্য দায়ী সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অবাধ রাজনৈতিকীকরণ। নিয়োগ, পদোন্নতি থেকে শুরু করে সর্বত্র প্রবল রাজনৈতিক উপস্থিতি। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে দায়িত্বশীল, সৎ ও যোগ্য লোকজনের ভাত উঠে যাচ্ছে। সেখানে দোর্দণ্ড দাপটে সব কাজে প্রভাব বিস্তার করে দলীয় ক্যাডার ও দালাল শ্রেণীর লোকজন। যখন যে দল বা জোট ক্ষমতায় থাকে, তখন সে দল বা জোটের সমর্থক ক্যাডাররা লুটপাট করে খায়। বিরোধী পক্ষের ক্যাডাররা তখন সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে নানা অপতৎপরতা চালাতে থাকে। আবার লুটপাট ব্যাহত হলে কিংবা স্বার্থে আঘাত লাগলে সরকারি দলের ক্যাডাররাও অনেক অঘটন ঘটিয়ে থাকে। কিন্তু কোনো সুস্থ কিংবা কার্যকর রাষ্ট্রে এ ধরনের পরিস্থিতি চলতে পারে না, চলাও উচিত নয়। ভাবতে যতই কষ্ট লাগুক, আমাদের সংকীর্ণ স্বার্থ হাসিলে মগ্ন একশ্রেণীর রাজনীতিবিদের সম্বিত ফিরে না এলে ভবিষ্যতে এমন ঘটনা ঘটতেই থাকবে। এর চেয়ে খারাপ কিছুও হতে পারে।
এনসিটিবিতে গত মঙ্গলবারের বৈঠকটি হয়েছে গবেষণা কর্মকর্তা দুলাল মিয়া ভুঁইয়ার কক্ষে। তিনি এবং বৈঠকে যোগদানকারী অন্যরা এনসিটিবিতে 'মিলন গ্রুপ' হিসেবে পরিচিত। এই মিলন হচ্ছেন সাবেক জোট সরকারের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী এহছানুল হক মিলন। স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যায়, তাঁরা হয় জোট সরকারের আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত, নতুবা বিশেষ সুযোগ-সুবিধাভোগী। এ অবস্থা সরকারি খাতের প্রায় প্রতিটি অফিস, প্রতিষ্ঠান বা সংস্থায় বিরাজ করছে। শোনা যায়, বিদ্যুৎ, জ্বালানিসহ আরো কিছু খাতে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার নানা অপচেষ্টা রয়েছে। এ ধরনের অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা এ দেশে নতুন নয়। '৭২ থেকে '৭৫ সাল পর্যন্ত দেশে বহু পাটের গুদামে আগুন লাগানো হয়েছে। বহু অন্তর্ঘাতমূলক কাজকর্ম চলেছে। তখন সেসব চলেছে স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক শক্তির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তায়। এখনকার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। চার দশকে অন্তর্ঘাত দমনকারী বাহিনীগুলোর অনেক শক্তি বৃদ্ধি ঘটেছে। তাদের কাজে লাগিয়ে অন্তর্ঘাত বা ধ্বংসাত্মক তৎপরতা পরিচালনাকারীদের সমূলে বিনাশ করতে হবে। তদন্তের ভিত্তিতে দোষীদের কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। এ ব্যাপারে জনগণকেও প্রয়োজনে সোচ্চার হতে ও ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। তা না হলে স্বাধীনতার সুফল কখনো আমাদের ঘরে উঠবে না। বাঙালি জাতির দুঃখ কোনো দিনই ঘুচবে না।

No comments

Powered by Blogger.