নীতিমালা ভেঙে রেলে নিয়োগ, মৌখিকে নম্বর দ্বিগুণ by একরামুল হক

সাম্প্রতিক জনবল নিয়োগে রেলওয়ের প্রতিষ্ঠিত নীতিমালা লঙ্ঘন করা হয়েছে। উপযুক্ত লোক বাদ দিয়ে অপেক্ষাকৃত নিচের পদের কর্মকর্তাকে নিয়োগ কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে। একই সঙ্গে মৌখিক পরীক্ষার নম্বর ২০ থেকে বাড়িয়ে ৪০ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে অর্থ লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে।


রেলওয়ে সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক অর্থ কেলেঙ্কারিতে জড়িত হয়ে সাময়িক বরখাস্ত হওয়া মহাব্যবস্থাপক (জিএম) ইউসুফ আলী মৃধার নির্দেশে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে নিয়োগ কমিটি গঠনের দপ্তরাদেশ দেওয়া হয়। তাতে আগের নিয়মের ব্যত্যয় ঘটানো হয়। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর শূন্য পদে নিয়োগের নীতিমালা তৈরি হয় ২০১০ সালের ২৯ আগস্ট। ওই নীতিমালার আলোকে ওই বছরের ৩০ ডিসেম্বর নিয়োগ কমিটি গঠনের একটি দপ্তরাদেশ জারি করেন তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক নুরুল আমীন। তা বাতিল বা সংশোধন না করে নতুন আদেশ জারি করা যায় না। কিন্তু এটি বাতিল বা সংশোধনের কোনো আদেশ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সদর দপ্তরে নেই বলে একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন। ফলে নতুন দপ্তরাদেশের ভিত্তিতে লোকবল নিয়োগের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
নতুন আদেশে সই করেন জ্যেষ্ঠ কল্যাণ কর্মকর্তা গোলাম কিবরিয়া। জানতে চাইলে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সংস্থাপন শাখার প্রধান কর্মকর্তা (সিপিও) প্রকৌশলী মো. গাওস আল মনির বলেন, ‘নিয়োগ-সংক্রান্ত দপ্তরাদেশ জারির অনেক পরেই আমি সংস্থাপন শাখার দায়িত্ব নিয়েছি। আগের দপ্তরাদেশ বাতিল কিংবা সংশোধনের ব্যাপারে আমার কাছে কোনো তথ্য নেই।’
আগের দপ্তরাদেশ বাতিল হয়েছে কি না, জানতে চাইলে জ্যেষ্ঠ কল্যাণ কর্মকর্তা গোলাম কিবরিয়া বলেন, ‘বাতিল না করে কি নতুন দপ্তরাদেশ দেওয়া যায়?’ বাতিলের আদেশের কপি আছে কি না, জানতে চাইলে কিবরিয়া বলেন, ‘২০১০ সালের ৩০ ডিসেম্বরের দপ্তরাদেশ প্রচার হয়েছে কি না, তা দেখতে হবে।’
রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলী এর জন্য ইউসুফ আলী মৃধাকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, ‘নিয়োগ নীতিমালা ভেঙে মৃধা সাহেব লোকবল নিয়োগ দিয়েছেন।’ উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘যেমন রেলভবনে অনুষ্ঠিত নিয়োগ-সংক্রান্ত সভার কার্যবিবরণীর ৩.০৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগে অতিরিক্ত প্রধান পর্যায়ের কর্মকর্তাকে (গ্রেড-৪) আহ্বায়ক করতে হবে। কিন্তু ইউসুফ আলী মৃধা তা অমান্য করে অনেক কনিষ্ঠ কর্মকর্তাকে কমিটির আহ্বায়ক করেছেন, যার মূল উদ্দেশ্য কনিষ্ঠ কর্মকর্তাকে চাপ দিয়ে নিজের পছন্দের লোক নিয়োগের পথ সুগম করা।’
নিয়োগ নীতিমালার ৩.০৫ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘নব-নিয়োগ সংক্রান্ত সার্বিক মহাব্যবস্থাপক/পূর্ব ও পশ্চিম, এফএঅ্যান্ডসিএও/পূর্ব, সিসিএস/ পাহাড়তলী এবং প্রধান নির্বাহী, কেলোকা (কেন্দ্রীয় লোকোমোটিভ কারখানা) প্রধান দায়িত্ব পালন করবেন। নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ পরস্পর আলোচনা করে একই নীতি অনুসরণ করে নিয়োগ কার্যাদি সম্পন্ন করবেন। নব-নিয়োগের কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্নের জন্য তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর পদের ক্ষেত্রে পৃথক নির্বাচনী কমিটি গঠন করতে হবে। সংশ্লিষ্ট দপ্তরের অতিরিক্ত বিভাগীয় প্রধানকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের নির্বাচনী কমিটি গঠন করতে হবে। আহ্বায়ক যে অঞ্চলের হবেন, সদস্য সচিব (সংস্থাপন প্রতিনিধি) সে অঞ্চলের হতে হবে। সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় প্রধানের সুপারিশে নিজ নিজ ক্ষেত্রে এডিজি/আরএস, জিএম/পূর্ব ও পশ্চিম এবং এফএঅ্যান্ডসিএও/পূর্ব কমিটির অনুমোদন দেবেন।’
অভিযোগ উঠেছে, নীতিমালা অমান্য করে ইউসুফ আলী মৃধা পছন্দের কর্মকর্তাদের দিয়ে নিয়োগ কমিটি গঠন করেন। যেমন, গত বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি জারি করা দপ্তরাদেশে ১০টি শ্রেণীর নিয়োগ কমিটিতে অতিরিক্ত বিভাগীয় প্রধানকে আহ্বায়ক করা হয়নি। করা হয়েছে কনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, এক হাজার ৪৪১ জন খালাসি নিয়োগের কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে সহকারী যান্ত্রিক প্রকৌশলীকে। সরকারি চাকরিতে তাঁর গ্রেড অষ্টম কিংবা নবম। আর অতিরিক্ত বিভাগীয় প্রধানের গ্রেড চতুর্থ বা পঞ্চম। একইভাবে সুইপার পদে নিয়োগের কমিটিতে অতিরিক্ত বিভাগীয় প্রধানের পরিবর্তে সহকারী বাণিজ্যিক কর্মকর্তাকে আহ্বায়ক করা হয়েছে। অ্যাটেন্ড্যান্ট নিয়োগের ক্ষেত্রে আহ্বায়ক করা হয়েছে সহকারী কারখানা ব্যবস্থাপককে।
অতিরিক্ত বিভাগীয় প্রধানদের বাদ দিয়ে সহকারী বিভাগীয় প্রধানদের নিয়োগ কমিটির আহ্বায়ক করা প্রসঙ্গে জ্যেষ্ঠ কল্যাণ কর্মকর্তা গোলাম কিবরিয়া জানান, ‘আসলে তড়িঘড়ির কারণে এটা হয়েছে।’
পাশাপাশি এ নিয়োগের ক্ষেত্রে মৌখিক পরীক্ষার মান ২০ থেকে বাড়িয়ে ৪০ করা হয়েছে। জ্যেষ্ঠ কল্যাণ কর্মকর্তা গোলাম কিবরিয়া বলেন, ‘এটা কর্মচারী নেতাদের দাবির মুখে করা হয়েছে।’
রেলওয়ে শ্রমিক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম এই দাবি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘মৃধা সাহেবরা নিজেদের স্বার্থে মৌখিক পরীক্ষার মান বাড়িয়েছেন। নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফলকে প্রভাবিত করতে এটা করা হয়েছে, যা বুঝতে আমাদের অসুবিধা হচ্ছে না।’
২০০৫-০৬ সালের নিয়োগগুলোতে লিখিত পরীক্ষা ৮০ এবং মৌখিক ২০ নম্বরের ছিল। এবার লিখিত ৬০ এবং মৌখিক ৪০ নম্বর করা হয়।
সূত্র জানায়, রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলে প্রায় সাড়ে তিন হাজার পদের বিপরীতে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সহকারী চালক, ট্রেড অ্যাপ্রেন্টিস, ট্রলিম্যান, ঝাড়ুদার, চকিদারসহ কয়েকটি শ্রেণীতে প্রায় এক হাজার ৩০০ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় স্থগিত রাখা হয়েছে আরও প্রায় এক হাজার ৮০০ জনের নিয়োগ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে এক হাজার ৪৪১ জন খালাসি এবং ১৪৩ জন অ্যাটেন্ড্যান্ট। বাকি পদগুলো মামলার কারণে আগেই স্থগিত করা হয়।
যোগাযোগ করা হলে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের ভারপ্রাপ্ত মহাব্যবস্থাপক মো. মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘যাঁরা নিয়োগপত্র পেয়েছেন, তাঁরা কাজে যোগ দিয়েছেন। যেসব পদের পরীক্ষা শেষ হয়নি তা স্থগিত রয়েছে। এ ব্যাপারে ওপরের নির্দেশনা পেলে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

No comments

Powered by Blogger.