ইলিশ এবং পরিবেশবিষয়ক কথকতা by ড. জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস

ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছ। বর্ষবরণ থেকে বধূবরণ_সব জায়গায় এ মাছটির বিশেষ দরকার হয়। ইলিশ যে কত সামাজিক কাজে লাগে, কে জানে। গ্রামের বৌ-ঝিদের কিছু ঘরোয়া অনুষ্ঠানে আমি ইলিশের অদ্ভুত ব্যবহার দেখেছি। বিশেষ করে এই অনুষ্ঠানে বড় ঘরের (শোয়ার ঘরে) বাস্তুখুঁটির কাছে (যেখানে ঠাকুরের ঘট থাকে) ইলিশ কাটা হয় এবং সেখানেই মাছের আঁশগুলো পুঁতে রাখা হয়।


কেন এবং কী কারণে এ কর্মটি করা হয়, তা আমার আজও জানা হয়নি। তবে অন্ত্যজ জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত এ লোকাচারটি খুবই প্রাচীন বলে জানি। আসলে ইলিশ স্বাদে-গন্ধে অনন্য। ডাচ-জাপানি-হিন্দুস্তানি-পাকিস্তানি কিংবা ফিলিপিনোদেরও অবলীলায় স্বীকার করতে দেখেছি বিষয়টি। কারণ কোনো না কোনোভাবে তাদের ইলিশ পরিবেশনের অভিজ্ঞতা আমার আছে। তবে বদনাম একটাই_প্রচুর কাঁটা। কাটা চামচ কিংবা কাঠি দিয়ে খাওয়াটা বিপজ্জনক। অথচ সামুদ্রিক মাছ হিসেবে ইলিশের কাঁটা নরম হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি। জীবনের এক পর্যায়ে মিঠা পানিতে আসতে হয় বলেই কি না। যাহোক, বাঙালি যে কারো পক্ষে ইলিশ বা ইলিশ-কালচার থেকে দূরে থাকাটা অসম্ভব_এটা আমি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। আমার প্রবাসজীবনের কথা বলছি। গত শতকের নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে ফিলিপাইনে ছিলাম বেশ কিছুদিন। সেখানে তখন ইলিশ পাওয়া যেত না। তাই বলে কি আমরা (বাঙালিরা) ইলিশ থেকে দূরে ছিলাম? মোটেই না। সেখানে কিছুটা ইলিশ-ইলিশ স্বাদের বাঙ্গুস মাছ (গরষশ ভরংয) দিয়ে দুধের স্বাধ ঘোলে মেটানোর চেষ্টা করতাম সবাই। একইভাবে পহেলা বৈশাখের পান্তা-ইলিশও (আসলে পান্তা বাঙ্গুস) বাদ যায়নি। এখন অবশ্য ডিজিটাল ব্যবসা-বাণিজ্যের কারণে বিশ্বের এমন কোনো জায়গা নেই, যেখান থেকে ইলিশের স্বাদ পাওয়া যায় না। যেমন_জাপানে দেখেছি, আজ কম্পিউটারে ক্লিক করলেই কাল দুয়ারে ইলিশের কার্টন হাজির। এই যে ইলিশের এত প্রশস্তি গাইছি, আমাদের কয়জনের সৌভাগ্য হয়েছে একটি তাজা ইলিশ ছুঁয়ে দেখার (আমি ইলিশ ধরা জেলে কিংবা ইলিশ নিয়ে গবেষণা করেন, এমন কারো কথা বলছি না)। বোধ হয় খুব বেশি নয়। তবে আমার হয়েছে। ঘটনাক্রমে আমি ইলিশ-শিকারি কিংবা ইলিশ-গবেষকদেরও কেউ নই। আমি গড়াই-পদ্মা অববাহিকার একজন সাধারণ চাষি পরিবারের সন্তান। তাই সেখানকার অনেকের মতো আমারও সৌভাগ্য হয়েছিল তাজা ইলিশের ছটফটানি হাতেনাতে অনুভব করার। অবশ্য সেই অনুভূতি একটু ভিন্ন ধাঁচের এবং তা ভিন্ন সময় বলেই বোধ হয়। সময়টা ছিল ১৯৭১ সাল। আমার শৈশব ছেড়ে কৈশোরে পা রাখার সময়। কোথায় ভাবনাহীন জীবন কাটাব! কিন্তু তা হয়নি। বড়দের সঙ্গে আমাদেরও খারাপ সময় গেছে। কখন খানসেনা (পাকিস্তানি মিলিটারি) আসে, জ্বালিয়ে দেয়, পুড়িয়ে দেয়_এসব চিন্তায়। তবু আশাহত হতে দেখিনি কাউকে। কারণ রাতে মুক্তিবাহিনীর আনাগোনা ছিল। স্বাধীন বাংলা বেতার ছিল। আর ছিল কিছু ভাবনা, 'যদি ওদের মুখোমুখি পড়েই যায় কেউ, তাহলে শেষ চেষ্টা হয় যেন একজনকে মেরেই মরা।' সবার সঙ্গে সেই বোধটা ভাগাভাগি করে নিয়েই বোধ হয় ছটফট করা ইলিশকে খানসেনা ভেবে চেপে ধরেছি নৌকার পাটাতনে। এভাবে কম করে হলেও এক ডজন ইলিশকে চেপে ধরার সুযোগ হয়েছে আমার।
পৃথিবীজুড়ে গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের কথা বলা হচ্ছে কিছুদিন ধরে। আর এদিকে আমাদের গড়াই মর মর। গড়াইয়ের প্রতিবেশী কালীগঙ্গা-কুমার-নবগঙ্গা আগেই দেহ রেখেছে এক ভুল চিকিৎসার শিকার হয়ে। সেটা ছিল গঙ্গা-কপোতাক্ষ পরিকল্পনা। আর গড়াইয়ের দুরবস্থার শুরুটা আমরা জানি_ফারাক্কা দিয়ে। সেটা ছিল ভারতীয় এক অপপরিকল্পনার ফসল। (হিন্দু) পুরাণের কথা বলতে হয়। সগর রাজার হতভাগ্য পুত্রদের উদ্ধারের জন্য প্রকৌশলী ভগীরথ স্বর্গ (আসলে গঙ্গোত্রী) থেকে গঙ্গাকে মর্ত্যে নিয়ে আসেন। তখন তো গঙ্গার গতিপথ অপ্রতিরোধ্যই ছিল। সেই গঙ্গারই আসল ধারা বুঝি আজকের পদ্মা ও গড়াই। কারণ গঙ্গা আয়তনে-ব্যক্তিত্বে পদ্মা-গড়াইয়ের মতো বিশাল না হয়ে পারে না। তবে ভগীরথের কৃতিত্বকে অস্বীকার করেননি মা গঙ্গা। কারণ সে যে তাঁর প্রকৌশলী। তাই ভগীরথকে কিছু ভাগ দিয়েছিলেন। সেটাই বুঝি ভাগীরথী। যাহোক, সেই পূত-পবিত্র মা গঙ্গায় বাঁধ দিয়ে দেয় ভগীরথের পরবর্তী প্রজন্মের প্রকৌশলীরা। এ কাজ করার আগে কখনোই তাঁদের মনে হয়নি, সগর রাজের উদ্ধার পাওয়া অধঃস্তন পুরুষদের আবার না জানি কী গতি হয়? যাহোক, বলছিলাম ইলিশের কথা। কুমার-নবগঙ্গা-কালীগঙ্গায়ও একসময় ইলিশ ধরা পড়ত। কারণ এরা কোনো না কোনোভাবে গড়াইয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। মোটকথা, বাংলাদেশের সুন্দরবনের এপাশ-ওপাশ এবং ভেতর দিয়ে যত নদী, সবই গড়াইয়ের জল খেয়ে তবেই নদী। গড়াই ছিল সারা বছরের স্রোতস্বিনী নদী। এই স্রোত প্রবাহের কারণেই সাগরের লোনা পানিকে একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে বেঁধে রাখা সম্ভব হয়েছে যুগ যুগ ধরে। বলা যায়, এর ফলেই সুন্দরবন এবং তার জীববৈচিত্র্য। অথচ সেই প্রবাহ আজ নেই। আজকের গড়াইয়ে ইলিশ নেই। ইলিশ মাছ সাগরের মাছ। জীবনের বেশির ভাগ সময় সাগরেই থাকার কথা। কিন্তু তাদের স্রোতের উজান বাওয়ার স্বভাব আছে। শ শ কিলোমিটার উজান বেয়ে চলে যায় এবং তা জীবনেরই প্রয়োজনে। কারণ মিঠা পানিতে ডিম ছাড়ার দরকার হয়। উজান বাইতে গিয়ে মাঝেমধ্যে বোধ হয় দিগ্ভ্রান্ত হওয়ার একটা ব্যাপার হয়ে থাকে। এক মাৎস্যবিজ্ঞানীর কাছে শুনেছি, বঙ্গোপসাগরে ট্যাগ করা মাছ পারস্য উপসাগরের কোনো এক নদীতে গিয়ে ধরা পড়েছে। অবশ্য পারস্য উপসাগর সংশ্লিষ্ট কিছু নদী, আরব সাগর সংশ্লিষ্ট সিন্ধু নদ এবং নর্মদা নদীতেও ইলিশ পাওয়া যায়।
আজ আমাদের ইলিশের বড়ই আকাল। নিকট অতীতের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ১৯৮৯-৯০ সালে সারা দেশে ইলিশের উৎপাদন ছিল ৭৭ হাজার ৩২৫ টন। এর পরই তা কমে প্রায় অর্ধেকে গিয়ে দাঁড়ায়। এখনো বোধ করি উৎপাদন খুব একটা ভালো পর্যায়ে আসতে পারেনি। এর কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে কারেন্ট জাল দিয়ে জাটকা নিধন। নিধনকৃত জাটকার পরিমাণ বছরে প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার টন। এই পরিমাণ জাটকা যদি বেঁচে যেত, তাহলে ধরে নেওয়ার কারণ আছে, দেশে ইলিশের বিরাট ঘাটতির অনেকটাই পূরণ হয়ে যেত। কিন্তু সেটাই বা কিভাবে সম্ভব, পদ্মার প্রবাহ আগের মতো নেই। গড়াই যেখানে প্রায় বর্ষায়ও রুগ্ণ প্রবাহ নিয়ে কোনো রকমে আছে, সেখান দিয়ে ইলিশের ঝাঁকের উজান বাওয়ার সম্ভাবনা কতখানি? মাৎস্যবিজ্ঞানীরা এ ব্যাপারে বলতে পারবেন। তবে আমি জোর দিয়ে বলতে চাই, শুধু জাটকা বাঁচিয়ে রাখলেও আমাদের ইলিশের আকাল মিটবে না। কারণ ওই বেঁচে যাওয়া ইলিশগুলো তাদের গতিপথ বদলে নেবে। হয়তো পদ্মা-গড়াইয়ের ইলিশ ইরাবতী, দজলা, ফোরাত, নর্মদা বা সিন্ধুতে চলে যাবে। কালে কালে বঙ্গোপসাগরের ইলিশের যে আস্তানা, তাও একদিন সরে যাবে। তাই আমাদের ইলিশ ধরে রাখতে হলে আমাদের নদীর প্রবাহ বাড়ানো চাই। আর নদীর প্রবাহ কি শুধু ইলিশের জন্যই চাই? একটু আগেই বলেছি, সুন্দরবনের প্রাণ প্রতিষ্ঠার অন্যতম কারণ হলো গড়াইয়ের প্রবাহ। গড়াইয়ের প্রবাহ না থাকায় সুন্দরবনের স্বাভাবিক লবণাক্ততা বেড়ে যাচ্ছে। ফলে কিছুটা কম লবণ সহনশীল সুন্দরী গাছের টিকে থাকা দায়। এমন হতে পারে, তার জায়গায় কম দামি এবং বেশি লবণ সহনশীল কেওড়াগাছ জায়গা করে নেবে। ফলে উঁচু গাছের সংখ্যা কমে যাওয়ার সম্ভাবনা বিদ্যমান।
লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে সুন্দরবনের সাম্প্রতিক কিছু পরিবর্তনের কথা বিজ্ঞানীরা বলছেন। যেমন_৪০ শতাংশের বেশি সুন্দরী গাছ আগামরা সমস্যায় আক্রান্ত। এ ছাড়া অন্যান্য প্রজাতির উল্লেখযোগ্য পরিমাণ গাছ হার্টরট, কাচপোকা ইত্যাদির আক্রমণের শিকার। গেল বছর সুন্দরবন এলাকার আইলা আক্রান্ত হতদরিদ্র কিছু মানুষের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তারা নিজেদের দুর্দশার পাশাপাশি সুন্দরবনের দুর্দশারও কিছু চিত্র তুলে ধরেছে। তাদের বর্ণনার সঙ্গে মিলে যায় ওপরের বর্ণনা। আমরা গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের কারণে সাগরের উচ্চতা বাড়ার কথা শুনছি। তার প্রতিফল ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে যাওয়ার কথা। তবে তা শুরুতেই এতটা জোরালোভাবে আসবে, তা তো ভাবা যায়নি। নাকি সাগরের ঢেউ প্রায় আগের মতোই আছে। শুধু তা প্রতিরোধ করার বেড়াস্বরূপ যে সুন্দরবন, তা-ই বোধ হয় দুর্বল হয়ে গেছে। এ কারণেই সাগরের ঢেউ বনের বাধায় আর ভেঙে খান খান হওয়ার সুযোগ পায় না। এ জন্য গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের আগে গড়াইয়ের দুর্বল ধারাকেও দায়ী করা যায় বোধ হয়। আর এগুলোর জন্য দায়ী কে? প্রকৃতি, নাকি মানুষ নিজেই।
পুনশ্চ : আজ (যেদিন ইলিশ নিয়ে নতুন করে ভাবছি) ২০১১ সালের ৯ এপ্রিল মোতাবেক ২৬ চৈত্র, ১৪১৭। পত্রিকার পাতায় ইলিশ বাঁচানোর বিজ্ঞাপন দেখলাম। জাটকা বাঁচিয়ে দেশে ইলিশের উৎপাদন চার লাখ টনে উন্নীত করতে হবে। অর্থাৎ দেশে ইলিশের অভাব চলছে। এবারও পহেলা বৈশাখে আমাদের ইলিশ খাওয়া হবে না। হাজার-বারো শ টাকা দরে ইলিশ কেনা সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। গ্রামগঞ্জের সাধারণ মানুষ তো স্বপ্নেও ভাবতে পারে না। এমনটি ইলিশসহ অন্য জীবজন্তুর জন্য বিপদাশঙ্কা।

লেখক : মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বিভাগীয় প্রধান, উদ্ভিদ ও শারীরতত্ত্ব বিভাগ, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর, biswas.jiban@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.