ইউরোপের চিঠি-পেন্টাগনের বাজেট আসলেই কি কমেছে by পিটার কাস্টার্স

গত ৬ জানুয়ারি মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রবার্ট গেটস ও সামরিক বাহিনীর জয়েন্ট চিফস অব স্টাফসের চেয়ারম্যান মাইক মুলেন সামনের বছরে তাঁদের বাজেট পরিকল্পনা নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন। তাঁদের বক্তব্যের সার কথা হলো, পেন্টাগন ব্যয় সংকোচনে বাধ্য হচ্ছে আর ব্যয় সংকোচনের পরিমাণটাও বিশাল—প্রায় ৭০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।


ব্যয় সংকোচন পরিকল্পনা ব্যাখ্যা করতে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে প্রায় আধা ঘণ্টা সময় নিতে হয়েছে। গেটসের মতে, রিপাবলিকান কংগ্রেস সদস্যদের আশ্বস্ত করার জন্য এমন বিস্তারিত ব্যাখ্যা জরুরি ছিল। দশকজুড়ে ক্রমাগত পেন্টাগনের বরাদ্দ বাড়াতে বাড়াতে এবার হঠাৎ ‘সংযম’ দেখানো বড় সংবাদ। সংবাদটি পুরো পড়ার আগে মাঝপথে এসে কারও মনে হতে পারে, প্রেসিডেন্ট ওবামা তাঁর সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানদের হাত নিষ্ঠুরভাবে বেঁধে দিয়েছেন। কিন্তু সংবাদটির আরেকটু গভীরে ঢুকলেই বেরিয়ে আসে কিছুটা হলেও প্রকৃত সত্য। এ পর্যায়ে এসে জানা যায়, আসলে পেন্টাগন ২০১১-১২ সালে ৫৫৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করার পরিকল্পনা করেছে, যা বাজেট কমার কোনো ইঙ্গিত বহন করে না। বরং বর্তমান বাজেটের সাপেক্ষে ১৩ বিলিয়ন ডলার বেড়েছে। সংবাদটির শেষ পর্যন্ত পড়লে দেখা যায়, এই মাত্র যা বলা হলো তাতেও পুরো সত্য উঠে আসে না। ৫৫৩ বিলিয়ন ডলারের এই হিসেবের মধ্যে ধরা হয়নি মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুদ্ধের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ।
যুদ্ধব্যয়-সংক্রান্ত তথ্যের মধ্যে ওবামার শাসনামলের ছাপ ফুটে ওঠে। মার্কিনদের হয়তো মনে আছে, ওবামা নির্বাচনী প্রচারণায় আপাত ‘যুদ্ধবিরোধী’ অবস্থান নিয়ে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। ডেমোক্রেটিক প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বী হিলারি ক্লিনটনের চেয়ে তাঁকে অধিকতর জোরালো যুদ্ধবিরোধী মনে করা হতো। প্রেসিডেন্টের পদে আসীন হওয়ার আগে ওবামা যুদ্ধাবসানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। পেন্টাগনের যুদ্ধাস্ত্র ক্রয়নীতি সংস্কার আর সরকারি সামরিক ব্যয়ে আরও স্বচ্ছতা আনার অঙ্গীকারও করেছিলেন। ইতিমধ্যে ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধের ব্যয় সরকারি বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তবু মধ্যপ্রাচ্যীয় যুদ্ধে সার্বিক ব্যয়ের ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন আসেনি। পেন্টাগনের ২০১১ সালের ‘মৌলিক বাজেট’-এ বরাদ্দ ১৫৮ বিলিয়ন ডলার আর মোট সরকারি বাজেট ৭০০ বিলিয়ন ডলার। ওবামা আসলে পেন্টাগনের যুদ্ধ বাজেট কমাননি, বরং আফগান যুদ্ধের দিকে সম্পদ প্রবাহিত করেছেন। ২০০৭ সালের এক খসড়া প্রতিবেদনে রবার্ট পোলিন ও হেইডি গ্যারেট-পেলটিয়ের (ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির দুই অর্থনীতিবিদ) হিসাব-নিকাশ করে দেখিয়েছেন, ইরাক যুদ্ধ থেকে সম্পদ স্থানান্তর করে শিক্ষা ও জ্বালানি সংরক্ষণকাজে ব্যয় করলে ছয় লাখ থেকে ১০ লাখ পর্যন্ত মার্কিন নাগরিকের চাকরির সুযোগ বৃদ্ধি পাবে।
মার্কিন সামরিক ব্যয়কে বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনা করা কাজের হতে পারে। রবার্ট গেটস ও পেন্টাগনের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারাও তেমনই দেখাতে চেয়েছেন। কেননা, তাঁদের মনোজগৎ দখল করে আছে চীনের সম্ভাব্য ক্রমবর্ধমান ‘সামরিক হুমকি’। এ ব্যাপারে তাঁদের নানা যুক্তির মধ্যে অন্যতম হলো, চীনা নেতৃত্বের মধ্যে খোলামেলা ভাবের ঘাটতি আছে, আর দেশটির সামরিক বাহিনীর প্রকৃত আকার এক রহস্য। চীনের এমন মনোভাব হয়তো সত্য, কিন্তু চীন ও মার্কিন সামরিক ব্যয়ের তুলনাকে তা মৌলিকভাবে প্রভাবিত করে না। আসলে, পেন্টাগনের নিজস্ব বাজেট কতগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আড়াল করে। মার্কিন বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষায়তনিক পণ্ডিতেরা সাম্প্রতিককালে পেন্টাগনের বাজেট কম করে দেখানোর ব্যাপারে সরব হয়ে উঠেছেন। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বাইরে বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ে প্রতিরক্ষাসংশ্লিষ্ট বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রের অন্তহীন যুদ্ধে আহত সেনাদের জন্য চিকিৎসা বরাদ্দ ও অবসর তহবিলের অর্থ, অর্থাৎ সেনাবাহিনীতে কাজ করেছেন এমন ব্যক্তিদের পেনশনের কথা বলা যায়। ২০০৯ সালে এই দুই খাতে বরাদ্দের পরিমাণ ১৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছায়। কোনো কোনো পণ্ডিত পেন্টাগন প্রদর্শিত বাজেটের অঙ্কের সঙ্গে আরও যোগ করেন সামরিক ব্যয় থেকে ঋণ দেওয়া অর্থের ওপর পাওয়া সুদ। মার্কিন বাজেট ঘাটতি মেটাতে মাঝেমধ্যেই সামরিক ব্যয় থেকে অর্থ নিতে হয়। ঋণের সুদ থেকে প্রতিবছর পাওয়া অর্থের পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। আসলে, সব দিক বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্র তার সামরিক শক্তি বজায় রাখতে প্রায় এক ট্রিলিয়ন অর্থাৎ এক হাজার বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে।
তাহলে মার্কিন সামরিক ব্যয় নিয়ে বৈশ্বিক প্রেক্ষিতটি কী? মার্কিন সামরিক ব্যয়ের সঙ্গে বৈশ্বিক সামরিক ব্যয়ের তুলনা কী করে হবে? বৈশ্বিক সামরিক ব্যয়ের কত ভাগ যুক্তরাষ্ট্র ব্যয় করে তার একটি তুলনামূলকভাবে ছোট অনুপাত হাজির করেছে স্টকহোমভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট। সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, ২০০৯ সালে বিশ্বের সর্বমোট সামরিক ব্যয়ের ৪৩ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্র একাই ব্যয় করে। এসব উপাত্তের আরও অনেক নমুনা হাজির করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, এক মার্কিন চিন্তাশালা বিশ্বের সামরিক ব্যয়ের মোট অংশের সঙ্গে স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে মার্কিন সামরিক ব্যয়ের তুলনা করেছে। সেই সময় বিশ্বের মোট সামরিক ব্যয়ের ২৬ শতাংশ করত যুক্তরাষ্ট্র। গত দুই দশকে মার্কিন অংশদারি ব্যাপকভাবে বেড়েছে। অতীতে মার্কিন সামরিক বাহিনী এত বিপুল অর্থ ব্যয়ের যুক্তি হিসেবে সামনে আনত শক্তিধর প্রতিপক্ষ সোভিয়েত ইউনিয়নকে। আর যদিও প্রতিপক্ষের সমরাস্ত্রে ব্যয়ের পরিমাণ নিয়ে বিতর্কের কোনো শেষ ছিল না, তবু দুই পরাশক্তির তুলনামূলক সামরিক শক্তি থাকার বিষয় তুলে ধরা সম্ভব ছিল। তবে আজকের দিনে মার্কিন সামরিক বাহিনীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কুলাতে পারার মতো কোনো প্রতিপক্ষ নেই। একা বা অন্য প্রতিপক্ষ বা সম্ভাব্য প্রতিপক্ষদের সঙ্গে নিয়ে যৌথভাবে মার্কিনদের ধারেকাছে পৌঁছতে পারে তেমন শক্তি নেই। সামরিক ব্যয় বলুন কিংবা সামরিক শ্রেষ্ঠতা সুরক্ষিত করার প্রযুক্তি উদ্ভাবনের কথাই বলুন—কোনো দিক থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের আশপাশে কেউ নেই।
তাই গেটস ও মুলেনের সামরিক ব্যয় কমানোর বুলিকে কেবল প্রশ্ন করাই যথেষ্ট নয়, অব্যাহতভাবে পেন্টাগনের বেড়ে চলা সামরিক ব্যয়কে ন্যায্যতা দিতে পেন্টাগন যেসব যুক্তি খাড়া করে, সেসবকেই আমাদের প্রশ্ন করা দরকার। মার্কিন পণ্ডিতেরা যথার্থভাবেই দেখিয়েছেন, সামরিক ব্যয়কে ডলারের স্থিরমূল্যে হিসাব করলে তা অতীতে যুদ্ধকালীন (কোরিয়া ও ভিয়েতনাম যুদ্ধকালে) সর্বোচ্চ ব্যয়ের শিখর ছুঁয়ে ফেলে। কেন বৈশ্বিক আধিপত্য বজায় রাখতে এক ট্রিলিয়ন ডলার অপচয় করতে হবে, তার কোনো দূরতম ব্যাখ্যাও পাওয়া যায় না। এ কারণেই সামরিক ব্যয়ের সামষ্টিক অর্থনৈতিক তাৎপর্য অর্থাৎ সার্বিকভাবে মার্কিন অর্থনীতির ক্ষেত্রে এর তাৎপর্যের প্রতি মনোযোগ দেওয়া দরকার। বিংশ শতাব্দীর প্রধানতম অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ড কেইনসের ভাষায়, যুদ্ধবিমান, ক্ষেপণাস্ত্র ও সাবমেরিন প্রস্তুত করা হলে তার প্রভাব হয় গুনিতকের মতো। আর অত্যন্ত বেশি সামরিক ব্যয় কৃত্রিমভাবে বজায় রাখার মাধ্যমে মার্কিন সরকার নিশ্চিত করে, এই ব্যয়ের প্রভাব সার্বিক অর্থনীতি (১৫ ট্রিলিয়ন ডলারের মার্কিন অর্থনীতি) পর্যন্ত প্রসারিত থাক। কেইনস এ ধরনের নীতি প্রণয়নের বিরোধী ছিলেন না, কিন্তু তিনি স্বীকার করেছিলেন এটা অপচয়ের কারবার। এভাবে প্রাকৃতিক ও মানবিক সম্পদের যে বিপুল অপচয় পেন্টাগন করে চলেছে, মানুষের অস্তিত্বের স্বার্থে তাকে প্রশ্ন করার এটাই কি উপযুক্ত সময় নয়?
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
ড. পিটার কাস্টার্স: গবেষক, বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞ ও প্রথম আলোর ইউরোপ প্রতিনিধি।

No comments

Powered by Blogger.