চারদিক-অটোগ্রাফে ভরা টি-শার্ট by নেয়ামতউল্যাহ

একই টি-শার্ট। একই ক্যাপ। শুধু বয়সের পার্থক্য অনেক অনেক! খোরশেদ আলম ছিলেন ভোলা সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্র। তাঁর তিন ছেলে মিঠু, শামীম ও ছোটনও পড়েছে এ স্কুলে। তাঁর নাতি প্রথমও এ স্কুলের ছাত্র। তিন প্রজন্মই এসেছে স্কুলের শতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে।


আজ যেন উপস্থিত সবার কাছে ঈদের আনন্দ। এ আনন্দে কোনো ভেদাভেদ নেই।

আহা, কী আনন্দ!
‘আহা! কী আনন্দ, আকাশে-বাতাসে/ শাখে শাখে পাখি ডাকে, কত শোভা চারিপাশে।/ আহা...পুরানো দিনের কথা মনে আসে, ফিরে আসে, আহা!...’। গানটি অনুপ ঘোষাল গাননি, গাইলেন সাবেক ধর্ম প্রতিমন্ত্রী মোশারেফ হোসেন শাহজাহান। ৫৭ বছর পর নিজ বিদ্যালয়ে এসে আবেগ ধরে রাখতে পারেননি তিনি। শত বছরের পুরোনো ভবনটি ঘুরে ঘুরে দেখেছেন। সেই শ্রেণীকক্ষ, সেই মাঠ, পুকুর, সেই সিঁড়ি—সবই তো আছে। শুধু তাঁর মতো বয়সের ভারে অকেজো হয়েছে সব। জীবন থেকে চলে গেল শত বছর! ২৯ জানুয়ারি ভোলা সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে এসে তাই গাইলেন এই প্রাক্তন ছাত্র। ভাঙা সুরে শুনিয়ে সবাইকে নিয়ে গেলেন তাঁর বিদ্যালয়বেলায়। তিনি স্মৃতি হাতড়ে বললেন, ‘আমাদের সময় স্কুলে দ্বিজাতিতত্ত্ব ব্যবহার হতো। এর উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো, স্কুলে দুটি পানির ভাঁড় ছিল। একটির পানি পান করত মুসলমান। তাদের গ্লাস ছিল সিলভার। আরেকটির জল পান করত হিন্দু। তাদের গ্লাস ছিল কাঁসার। কিন্তু ওই দুই ভাঁড়ের পানি বহন করে আনত এক হিন্দু দপ্তরি। তখনই বুঝেছি, এ দ্বিজাতিতত্ত্ব টিকতে পারে না। টেকেনি। এখন মুসলমানের রক্ত নিয়ে হিন্দু সুস্থ হচ্ছে। কবির বাণী যথার্থই সত্য, “সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই”।’

আক্ষেপ!
আড়াই মাস ধরে চলছে উদ্যাপন প্রস্তুতি। শহরজুড়ে অতিথিদের স্বাগত জানাতে একাধিক তোরণ বানানো হয়েছে। সকাল নয়টায় ভোলা শহরজুড়ে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। সবাই আনন্দমুখর। কত রং, কত ঢং! কত সাজন! যাঁরা এই স্কুলে পড়েছেন, তাঁরা গর্ব করে বলছেন, ‘আমি এই স্কুলের ছাত্র ছিলাম।’ যাঁর বয়স আজ শতবর্ষ! আর যে না পড়েছে, সে আক্ষেপ করেছে, ‘কেন পড়তে পারিনি!’ অতিথিদের কণ্ঠেও ছিল আক্ষেপ। কেন ভোলা সরকারি স্কুলের ছাত্র ছিলেন না। তাহলে সে গৌরবের ইতিহাসে তাঁরাও হতেন অংশীদার। এই দলে ছিলেন ভোলা-১ আসনের সাংসদ আন্দালিব রহমান পার্থ, ভোলা জেলা বিএনপির সভাপতি গোলাম নবী আলমগীর এবং অনুষ্ঠানের উদ্বোধক ও প্রধান অতিথি শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ।

বন্ধু, কী খবর বল!
সকাল থেকেই বহুদিন পর দেখা হওয়া বন্ধুটিকে দেখে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে বলছেন, ‘বন্ধু, কী খবর বল’, ‘কত দিন দেখা হয়নি’, ‘কোথায় আছিস, কেমন আছিস’, ‘বিয়ে করেছিস কি না’, ‘বাচ্চা-কাচ্চার খবর কী’, ‘তোর মুঠোফোনের নম্বরটা আগে দে’—নানান প্রশ্ন মুহূর্তেই করে ফেলেছেন। নাশতার টেবিলে একসঙ্গে, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে একসঙ্গে সমালোচনা, দুপুরের খাবারও এক টেবিলে, দুপুরের খাবার শেষে মাঠে সবাই গোল হয়ে বসেছেন। একেকজন একেক ব্যাচের। কত জমানো কথার খই ফুটছে! সুখ-দুঃখ-বেদনার কথায় সময় পার হয়ে যায়।

নাচলেন এবং গাইলেন
২৯ জানুয়ারি রাত আটটা। শতবার্ষিকী উদ্যাপন মঞ্চে গান গাইতে এসেছেন ফাহমিদা নবী ও দলছুটের বাপ্পা মজুমদার। মঞ্চে উঠেই শ্রোতাদের কাতার থেকে ডাকলেন সাবেক সচিব ও বিনিয়োগ বোর্ডের চেয়ারম্যান এম মোকাম্মেল হক, ভোলা-২ আসনের সাংসদ ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য তোফায়েল আহমেদ, সাবেক ধর্ম প্রতিমন্ত্রী, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার মোশারেফ হোসেন শাহজাহানসহ বয়সে সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ নামজাদাদের। তাঁরা মঞ্চে এলেন, নাচলেন, গাইলেন, রসিকতা করলেন। দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের দুই নেতাকে একসঙ্গে হাত ধরে বুকে বুক মিলিয়ে নাচ-গান করতে দেখে কে বলবে রাজনৈতিক মাঠে তাঁরা সব সময় ঝগড়ায় ব্যস্ত থাকেন। উপস্থিত লোকজন বললেন, সব হিংসা, ক্ষোভ-লোভ হারিয়ে তাঁরা গেছেন শৈশবে।

নিরঞ্জন রোদ্দুর হতে চেয়েছিল
শতবর্ষী ভোলা সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে যাঁরা পড়েছেন, আজ তাঁরা অনেকেই দেশের তারকা। নামজাদা কবি, লেখক, রাজনীতিবিদ, চিকিৎসক, প্রকৌশলী ইত্যাদি। আবার কেউ ভবঘুরে বাউণ্ডুলে হয়ে সংসারের অন্ন ধ্বংস করছেন। শতবার্ষিকী উদ্যাপনে তাঁদের অনেকে এসেছেন। অনেকে বয়সের ভারে, কাজের চাপে আসতে পারেননি। অনেকে চলে গেছেন পৃথিবী ছেড়ে। যাঁরা এসেছেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য: সাবেক সচিব ও বিনিয়োগ বোর্ডের চেয়ারম্যান এম মোকাম্মেল হক, ভোলা-২ আসনের সাংসদ ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য তোফায়েল আহমেদ, সাবেক ধর্ম প্রতিমন্ত্রী, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার মোশারেফ হোসেন শাহজাহান, আতিকুল হক চৌধুরী, বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ফজলুল কাদের, বুয়েটের অধ্যাপক মাকসুদ হেলালী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারম্যান রাজীব মীর, প্রকৌশলী শামীমের মতো শত শত স্বনামখ্যাত ব্যক্তিত্ব।
সাইফুল আলম বাপ্পীর সব ক্লাসফ্রেন্ড প্রতিষ্ঠিত চাকুরে। কিন্তু বাম রাজনীতি আর সংস্কৃতি আজও তাঁকে ভবঘুরে বানিয়ে রেখেছে। নাটকপাগল বাঁধনের অবস্থাও তা-ই। উৎপল দেবনাথ পেশায় ফটোগ্রাফার। মেধাবী। কিন্তু অভাবের কারণে এসএসসি পাস করা হয়নি। এ রকম শত শত নিরঞ্জনের সঙ্গে দেখা হয়েছে, যাঁরা ভোলা সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন, কিন্তু তাঁরা তাঁদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেননি। তাঁদের স্মৃতিকথা শোনার জন্য মঞ্চেও ডাক পড়েনি। তবে এ মানুষগুলো সমাজের বিশিষ্ট কেউ হতে না পারলেও ভালো মানুষ হয়েছেন। তাই হয়তো স্কুলের বর্তমান ছাত্রদের কাছে প্রাক্তন সবাই স্টার। তারা তাদের টি-শার্টে, ক্যাপে সব ব্যাচের ছাত্রদের অটোগ্রাফ নিয়েছে। বড়দের অটোগ্রাফ দেওয়া টি-শার্ট ছোটদের কাছে আশীর্বাদের দলিল।

No comments

Powered by Blogger.