মিসর-রক্ত ও বিপ্লবের রং by রবার্ট ফিস্ক

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রক্তের রং বাদামি হতে থাকে। বিপ্লবে তা হয় না। যে চিকিৎসক, যে আইনজীবী, যে তরুণী মুক্তি (তাহরির) ময়দানের শহীদ, তাঁর গায়ের শেষ ময়লা পোশাক এখন ময়দানের এক কোণে ঝোলানো। তাঁদের টি-শার্ট ও প্যান্টে মাটির রং লেগে আছে। মঙ্গলবার শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছে হাজারো মানুষ।


প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে এটা সবচেয়ে বড় প্রতিবাদ মার্চ। ঘামতে ঘামতে, ঠেলাঠেলি, চিৎকার-চেঁচামেচি করে, কান্নায় আর আনন্দে প্রতিবাদী জনতা অধৈর্য ও ভীত—বিশ্ববাসী হয়তো তাদের সাহস ও আত্মত্যাগের কথা ভুলে যাবে। ময়দানে ঢুকতে আমাদের তিন ঘণ্টা সময় লাগল। বের হতে থাকা জনসমুদ্রের বিপরীতে চলতে হলো দুই ঘণ্টা।
অভ্যুত্থান সময়সূচি মেনে ঘটে না। ৩০ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে জনরোষ ও হতাশা নবায়নের সেই দিনটির প্রতিশোধ নেওয়ার পথ খুঁজবেন মোবারক। কাজে ফেরা নতুন সরকার দুই দিন ধরে দেখানোর চেষ্টা করছে, মিসর এখন আগের স্বৈরতন্ত্রী অসাড় ব্যবস্থায় ফিরে চলেছে। গ্যাস স্টেশন খোলা, আগের মতোই যানজট, ব্যাংকে লেনদেন চলছে (যদিও অল্প পরিমাণে), দোকানে সতর্ক কেনাবেচা চলছে, আর রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেখা গেল, আরও পাঁচ মাসের জন্য রাজা মন্ত্রীদের উদ্দেশে বিশৃঙ্খলা থেকে বেরিয়ে আশার প্রয়োজনের ব্যাপারে নসিহত করছেন। বিশৃঙ্খলার যুক্তিই এখন ক্ষমতা আঁকড়ে পড়ে থাকার একমাত্র ঘোষিত যুক্তি।
কিন্তু ইসাম এতমান দেখিয়ে দিয়েছেন, এ যুক্তি ভ্রান্ত। আশপাশের হাজারো মানুষের ধাক্কায় চ্যাপ্টা হওয়ার দশা। তবু তিনি পাঁঁচ বছর বয়সী মেয়ে হাদিগাকে কাঁধে চড়িয়ে যোগ দিয়েছেন বিক্ষোভে। চিৎকার করে বললেন, ‘মেয়ের জন্যই আমি এখানে। তার মুক্তির জন্যই মোবারককে হটাতে চাই। আমি গরিব নই। একটি পরিবহন কোম্পানি ও একটি গ্যাস স্টেশনের মালিক আমি। সব এখন বন্ধ—এতে আমার ক্ষতি হচ্ছে, কিন্তু তাতে কী! নিজের পকেট থেকে কর্মচারীদের মজুরি দিচ্ছি। এটা মুক্তির মামলা। এ জন্য যেকোনো কিছুই ত্যাগ করা যায়।’ ইসাম এতমানের কাঁধে বসে পুরো সময়টা ছোট্ট মেয়ে বিস্ময়ে চেয়ে রইল সেই মহাকাব্যিক জনসমুদ্রের দিকে—এর সঙ্গে কোনো হ্যারি পটার মহা-আড়ম্বরের তুলনা চলে না।
মঙ্গলবার বিকেলে ময়দানে এত বিপুল জনগণের জমায়েত হলো যে প্রতিবাদী জনস্রোত নীল নদের সেতু ও মধ্য কায়রোর অন্যান্য ময়দানেও ছড়িয়ে পড়ল। অনেকেই এসেছে প্রথমবারের মতো। সেখানে উপস্থিত মিসরের থার্ড আর্মির সেনা সংখ্যার ৪০ হাজার গুণ মানুষ। সেনারা ট্যাঙ্ক ও সামরিক যানে বসে ছিল অনুগত ভঙ্গিতে। বয়স্ক ও তরুণ নারী-পুরুষ ট্যাঙ্কের পথে বসা, কেউ কেউ যানের ওপর ঘুমাচ্ছে, কারও মাথা বিরাট স্টিলের চাকায়—ভিন্নমতের জনবাহিনী নিবীর্য করে দিল সামরিক বাহিনীকে। কেন এখানে এলেন? তাঁরা এসেছেন কেননা তাঁরা আতঙ্কগ্রস্ত, কেননা তাঁদের ভয় এই লড়াই বিশ্ববাসীর মনোযোগ হারাচ্ছে, কেননা মোবারক এখনো তাঁর প্রাসাদ ছেড়ে যাননি, কেননা গত কয়েক দিনে জনতার উপস্থিতি কমেছে, কেননা কিছু কিছু ক্যামেরা-ক্রু চলে গেছে অন্য বিপর্যয় আর স্বৈরাচারের সন্ধানে, কেননা বাতাসে বেইমানির গন্ধ। মুক্তি প্রজাতন্ত্র (রিপাবলিক অব তাহরির) নিঃশেষ হয়ে গেলে জাতীয় জাগরণও শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু বিপ্লব জীবন্ত। প্রমাণ পেলাম মঙ্গলবার।
শাসন জিইয়ে থাকা, টিকে যাওয়া, শাসকের জন্য যন্ত্রণার কারণ হয়ে ওঠাদের ওপর আক্রমণ, ক্যামেরা বন্ধ করে দেওয়া, এসব মানুষের একমাত্র কণ্ঠস্বর সাংবাদিকদের হয়রানির আর বিপ্লবের পুরোনো শত্রু—পশ্চিমাদের পছন্দের ‘মধ্যপন্থীদের—প্ররোচিত করে প্রতিবাদী জনতার এক দফা দাবি থেকে মনোযোগ অন্যত্র সরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে শাসকগোষ্ঠীর সামর্থ্য অবমূল্যায়ন করাটা ছিল ভুল। বুড়ো লোকটা যদি সেপ্টেম্বর মাসে বিদায় নেয়, তাহলে আগামী পাঁচ মাসে কী ঘটবে? প্রতিবাদী জনতার পছন্দের তালিকায় সবচেয়ে সম্মানিত আমর মুসা। দেখা যাচ্ছে, তিনিও মোবারককে মেয়াদ পূর্ণ করতে দিতে চান। আর শোচনীয় হলো, সরলমতি, রাজনৈতিক শিক্ষাহীন জনতার রাজনৈতিক বোঝাপড়া।
সব শাসন সমাজের ভেতর লৌহকঠিন শেকড় প্রোথিত করে। সিরিয়া ২০০৫ সালে লেবানন ত্যাগ করলে লেবাননি জনগণ ভেবেছিল মাথা ছেঁটে ফেলা, দেশ থেকে গোয়েন্দা কর্মকর্তা ও সেনা বের করে দেওয়াই যথেষ্ট। কিন্তু আমার মনে পড়ছে, সিরিয়ার হাত কত গভীরে. তা দেখে আমরা কতটা বিস্মিত হলাম। লেবাননের কত গভীরে ঢুকে আছে সিরিয়া। একের পর এক গুপ্তহত্যা চলতে থাকে। মিসরের অবস্থাও তেমনই। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পান্ডা, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা পুলিশ আর যে স্বৈরাচারের নির্দেশে তারা চালিত, সবাই এখনো বহাল তবিয়তে আছে। এক মাথা গুটিয়ে নিতে হলে আরও বহু মাথা গজিয়ে যাবে—চেনাজানা চেহারার বদলে নতুন চেহারায় পথে নেমে তারা তাণ্ডব চালাবে।
মিসরে সত্যি সত্যি গণতন্ত্রের সংগ্রামের সমর্থক কিছু কিছু সম্পদশালী মানুষ আছেন, যাঁরা মোবারকের বিদায় চান, কিন্তু ভয় পাচ্ছেন তিনি সরে গেলে সংস্কারের ব্যাপারে আলোচনার আগেই সেনাবাহিনী নিজস্ব জরুরি আইন জারি করতে সক্ষম হবে। এমন একজনের সঙ্গে মঙ্গলবার রাতে কথা হলো। তিনি বললেন, ‘মোবারকের বিদায়ের আগেই সংস্কার চাই। এখনই যদি তাঁর বিদায় ঘটে, তবে সংস্কারের কোনো বাধ্যবাধকতা নতুন নেতৃত্বের থাকবে না। এখনই সংস্কারের ব্যাপারে মতৈক্যে পৌঁছাতে হবে আর দ্রুতই তা সম্পন্ন করতে হবে। আইনসভা, বিচার বিভাগ, সাংবিধানিক পরিবর্তন, প্রেসিডেন্ট থাকার মেয়াদসংক্রান্ত সংস্কার এখনই হতে হবে। মোবারক চলে যাওয়া মাত্র সেনাবাহিনী বলবে, “খেল খতম, এবার বাড়ি ফের”। আর তখন আসবে পাঁচ বছর মেয়াদি সামরিক পরিষদ। তাই বুড়ো মানুষটা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত থাকুক।’
হাজার হাজার গণতন্ত্রকামী মানুষের কাঁচা, সরলমতি, ইন্টারনেট-ফেসবুকে অতিনির্ভরশীল বলে অভিযুক্ত করা সহজ। সত্যি সত্যি দিনে দিনে সাক্ষ্য মিলছে, ‘ভার্চুয়াল রিয়ালিটি’ মিসরের তরুণদের কাছে বাস্তব হয়ে উঠেছিল, তারা রাজপথের বদলে স্ক্রিনকেই বিশ্বাস করত—আর যখন তারা রাজপথে নেমে এল, তখন রাষ্ট্রীয় বল প্রয়োগ আর শাসকদের অব্যাহত নির্মম, শারীরিক শক্তি দেখে তারা গভীর মর্মাহত। তবু নতুন মুক্তির এই স্বাদ অভিভূতকর। যে মানুষেরা এত দীর্ঘ সময় স্বৈরতন্ত্রের অধীনে বাস করল, তারা কী করে বিপ্লবের পরিকল্পনা করতে পারে? পশ্চিমের বাসিন্দারা এটা ভুলে যায়। পশ্চিমারা এতটাই প্রাতিষ্ঠানিকীকৃত যে তাদের ভবিষ্যতের পুরোটাই ক্রমবদ্ধ। মিসরের ঘটনা বজ্রপাতের মতো, কোনো দিশা নেই। জনতার অভিব্যক্তির এই প্লাবন পশ্চিমের বিপ্লবের ইতিহাস গ্রন্থে কিংবা রাজনৈতিক আবহবিদ্যায় পরিপাটিভাবে খাপ খায় না।
সব বিপ্লবেরই আছে নিজস্ব ‘শহীদ’। আহমেদ বাসিউনি আর তরুণ সালি জাহরানি ও মোয়াহমুদ মোহামেদ হাসানের মুখ বিলবোর্ডে ছেয়ে গেছে ময়দানের চারপাশ। পাশাপাশি কতগুলো আঘাত-জর্জরিত মাথার ভয়ানক ছবি, পাশে লেখা ‘অজ্ঞাত’। জনতা এখন তাহরির ময়দান ত্যাগ করলে তা হবে এই শহীদদের সঙ্গে বেইমানি। সত্যি সত্যি যদি আমরা মোবারক নয়তো বিশৃঙ্খলা তত্ত্বে বিশ্বাস স্থাপন করি (ওয়াশিংটন, লন্ডন, প্যারিসে এখনো যা শক্তিশালী মত), তাহলে সেক্যুলার, গণতান্ত্রিক, সভ্য বৈশিষ্ট্যের এই বিশাল প্রতিবাদও বেইমানির শিকার হবে।
তৃতীয় সপ্তাহ—১৬তম দিন। রোমাঞ্চ আর দুর্বার ক্রোধের দিবসের ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পান্ডাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অঙ্গীকারের ঘাটতি আছে। এভাবেই ষষ্ঠ সপ্তাহ—৩২তম দিন কি আসবে? তখনো কি থাকবে ক্যামেরা? জনগণ? আমরা? মঙ্গলবার আবারও আমাদের অনুমান ভুল প্রমাণিত হলো। কিন্তু তাদের মনে রাখতে হবে যে, এই শাসনের লৌহকঠিন নখদন্ত বহু আগেই মাটির গর্ভে বেড়ে উঠেছে, পিরামিডের চেয়েও গভীর, মতাদর্শের চেয়েও শক্তিশালী। এই জন্তু কিংবা তার প্রতিহিংসার দর্শন এটাই শেষ নয়।
ব্রিটেনের দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
রবার্ট ফিস্ক: ব্রিটিশ সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.