পর্যটন শিল্পের বিকাশে কিছু প্রস্তাবনা by মোহাম্মদ নূরুল আমিন

পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটিয়ে বিশ্বের বহু দেশ বিপুল অংকের বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে। মালদ্বীপ, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, দুবাই, সিঙ্গাপুর, হংকং ও কোরিয়ার নজির যেমন রয়েছে এশিয়ায়, তেমনি আমেরিকা বা ইংল্যান্ডেরও রয়েছে বেশকিছু অভিজ্ঞতা।

তাদের অনুসরণ করে বাংলাদেশও পর্যটন খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে। দেশি-বিদেশি বেসরকারি খাতকে এই শিল্পের প্রসারে সঠিক দিকনির্দেশনার মাধ্যমে বিনিয়োগের সুযোগ করে দিয়ে সরকার বিপুল রাজস্ব আয় করতে পারে। দেশ অর্জন করতে পারে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা। আমাদের দেশকে আমরা তুলে ধরতে পারি বিশ্ববাসীর সামনে।
বর্তমান সরকার, প্রধানমন্ত্রী ও পর্যটন মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগ নিতে হবে। সাধারণ প্রক্রিয়ায় আমাদের বিপুল সম্ভাবনাময় পর্যটন খাতের উন্নয়ন আশা করা যায় না। এ জন্য দরকার বিশেষ উদ্যোগ। দরকার দ্রুত ও ব্যাপক মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন। মন্ত্রিসভার সদস্য, সংসদ সদস্য এবং দেশের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এ লক্ষ্যে পর্যটন খাতে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী বেসরকারি উদ্যোক্তাদের নিয়ে বিশেষ বৈঠক করা যেতে পারে। বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে বাংলাদেশে কর্মরত ৫০টি দেশের রাষ্ট্রদূতকে সঙ্গে নিয়ে কক্সবাজার, রাঙামাটি, কুয়াকাটা, জাফলংসহ সম্ভাবনাময় পর্যটন স্পটগুলো পরিদর্শনে গিয়ে তাদের এ খাতে বড় আকারের বিনিয়োগে উত্সাহিত করা যেতে পারে। পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিশেষভাবে আমন্ত্রণ জানিয়ে সঙ্গে করে নিয়ে এসে তাদের পর্যটন স্পটগুলো ব্যাপকভাবে ঘুরে দেখানোর উদ্যোগ নেয়া উচিত।
বিশ্বের উল্লেখযোগ্য শহর ও পর্যটন নগরীগুলো অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হয়েছে। আমাদের এখানেও তেমনভাবে গড়ে তোলা দরকার। বিভিন্ন দেশের শহর ও পর্যটন এলাকার অবকাঠামোর আদলে আমাদের দেশেও একই ধরনের অবকাঠামো গড়ে তোলা প্রয়োজন। ওইসব দেশে সুপরিকল্পিতভাবে তারা যেভাবে পর্যটন-সংশ্লিষ্ট স্থাপনা গড়ে তুলেছে, তার অনুকরণে আমরাও এখানে স্থাপনা গড়ে তুলতে পারি। আমেরিকা, ইংল্যান্ড, হংকং, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, দুবাই, কোরিয়া এবং বিশ্বের আরও কিছু দেশ তাদের নদী ও সমুদ্র তীরবর্তী এলাকাতে পরিবেশ রক্ষা করে পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে পেরেছে। তাদের অবকাঠামোগুলো কীভাবে তৈরি করা হয়েছে এবং মানুষকে তারা কীভাবে স্বাস্থ্যসম্মত, গুণগতমান রক্ষা করে আধুনিক শহর ও পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটিয়ে দেশের উন্নতি করেছে; সংশ্লিষ্টদের তা ভেবে দেখার অনুরোধ করছি। উন্নত দেশগুলো নদীর দু’পাড়ে এবং সমুদ্রপাড়ে পরিকল্পিত শহর গড়ে তুলে নদী ও সমুদ্রকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছে। সেদিকেও আমাদের নজর রাখা দরকার।
পর্যটন নিয়ে যারা ভাবছেন, তাদের অনুরোধ করব, ভেবে দেখতে মধ্যপ্রাচ্যের দুবাইতে সমুদ্রের মধ্যে বহুতল ভবন এবং পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ হোটেল তৈরি করে তারা কীভাবে কোটি কোটি ডলার আয় করছে। সেটা তো পরিবেশবান্ধবভাবেই তৈরি করা হয়েছে। তার বিপরীতে আমাদের এখানে পর্যটনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক উপাদান থাকা সত্ত্বেও আমাদের দেশের শহর ও পর্যটন নগরীগুলোর অবস্থা দেখে মনে হয় না, আমরা একবিংশ শতাব্দীতে বাস করছি।
আজ যারা দেশে সুন্দর আবাসন ও স্থাপনা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছেন, তারা অনুকূল পরিবেশ পেলে দেশে সুন্দর শহর ও পর্যটন শিল্পের সমৃদ্ধির লক্ষ্যে, সুন্দর ও ভালো অবকাঠামো স্থাপন করতে পারেন।
ময়লা-আবর্জনা, বস্তির দুর্গন্ধ, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ দেখলে বিদেশিদের আর ঢাকা শহর ও পর্যটন নগরীতে যেতে ইচ্ছে হয় না। রাস্তার পাশের বর্জ্য, ময়লা-আবর্জনার গন্ধ যাতে আর না থাকে, তা অনেকেই চান না। কারণ তারা চান দেশ অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাক এবং দেশের উন্নতি না ঘটুক।নদী ও সমুদ্রের পাড়ে পরিবেশবান্ধব সুন্দর সুন্দর বহুতল ভবন তৈরি করারও প্রয়োজন আছে। দেশের রাস্তাঘাট, নদী, শহর ও পর্যটন নগরীগুলোকে কী করে সুন্দরভাবে সাজানো যাবে, তার দিকে নজর দিতে হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আছে সমুদ্র ও নদীর পাড়ে বহুতল ভবন। এসব স্থাপনা নির্মাণ করে তারা যেমন সমুদ্র ও নদীকে রক্ষা করছে, তেমনি রক্ষা করছে পরিবেশও। কারণ বহুতল ভবনে বসবাসকারীরা কেউ নদীর পানি দূষিত করে না। দেখা যায়, বস্তিতে বসবাসকারীরা জড়িয়ে পড়ছে অবৈধ মাদক ও অস্ত্র ব্যবসাসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। এতে বেড়ে যাচ্ছে সামাজিক অস্থিরতা। আইনশৃঙ্খলার অবনতি হচ্ছে। এ থেকে রক্ষা পেতে দরকার সুষ্ঠু ও সুন্দর আবাসন ব্যবস্থা।
পরিশেষে আমি বলতে চাই, আবাসন শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের হয়রানি না করে তাদের ভুলত্রুটি থাকলে তা সংশোধন করা জরুরি। তাতে আবাসন শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। উদ্যোক্তাদের হয়রানি করলে অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে। সরকারের কাজ হলো সহযোগিতা করা। সহযোগিতা পেলে দেশে বিনিয়োগ বাড়বে। বিনিয়োগ বাড়লে অর্থনৈতিক মুক্তি আসবে। এখানে উদ্যোক্তাদের বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। তাই ইন্টারনেট সার্চ করে, উন্নত বিশ্বের চিত্র ধারণ করে দেশব্যাপী প্রচারণা শুরু করা উচিত। তাতে উদ্যোক্তারা আরও উদ্বুদ্ধ হয়ে আবাসন ও পর্যটন শিল্পে বিনিয়োগ করবেন এবং সচেতন হবেন।
দেশে দিন দিন জনসংখ্যা বেড়েই চলছে। জমির ব্যবহারও আনুপাতিক হারে কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে আবাসনের চাহিদাও বেড়ে চলেছে। এ অবস্থায় আবাসন শিল্প গড়ে না উঠলে মানুষ কোথায় মাথা গুঁজবে? কোথায় থাকবে? কী হবে তাদের জীবন ব্যবস্থা? সুষ্ঠু ও সুন্দর আবাসন শিল্প গড়ে উঠলে জাতি পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে গড়ে তুলতে হবে পরিকল্পিত আবাসন ব্যবস্থা। যার মাধ্যমে মানুষ পাবে তার নিশ্চিত নিরাপত্তা ও আর্থিক সচ্ছলতা।
সমুদ্র ও নদীর তীরবর্তী এলাকায় কীভাবে পরিকল্পিত আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায় সে জন্য আমরা উন্নত বিশ্বের কারিগরি সহায়তা গ্রহণ করতে পারি। তাহলে বিদেশিরাও দেখতে পাবে বাংলাদেশের অপার সৌন্দর্য। এতে বেড়ে যাবে পর্যটকদের আগমন। প্রাণ ফিরে পাবে আবহমান বাংলার স্রোতস্বিনী নদীর ধারা এবং সঙ্গে থাকবে স্বচ্ছ পানির ঢেউয়ের মনমাতানো খেলা। যা দেখে পর্যটকরাও হবে বিমুগ্ধ এবং পুলকিত।
উন্নত বিশ্বের আদলে আমাদের দেশে শহর ও পর্যটন নগরী গড়ে তুলে আবাসন শিল্পকে সহযোগিতা করার জন্য প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদের সব সদস্য, বিরোধীদলীয় নেত্রী, সংসদ সদস্য, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিসহ দেশের সব ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার সাংবাদিকদের প্রতি আমার অনুরোধ—আপনারা প্রয়োজনীয় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিন। আপনাদের সহযোগিতার হাত গড়ে তুলতে পারে আধুনিক শহর ও পর্যটন শিল্প সমৃদ্ধ বাংলাদেশ।
লেখক : চেয়ারম্যান, গ্রিন ডেল্টা হাউজিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (প্রা.) লিমিটেড

No comments

Powered by Blogger.