সরল গরল-র‌্যাবলিকস ও আমাদের আমেরিকাপ্রীতি by মিজানুর রহমান খান

পুরোনো কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন সময়ের দেবদূত জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ। ৩০ বছর পর সবকিছু কয়লা হয়ে যাওয়ার পর যা আমরা জানতে পারতাম, সেটা আমরা টাটকা জানলাম। থলের বিড়াল বাইরে বেরোল। বিষয়টি যে বিব্রতকর, সেটা মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি নিজেই স্বীকার করেছেন।


গত ৩ জানুয়ারি তিনি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে বক্তব্য দিতে গিয়ে উল্লেখ করেন, এ বিষয়ে কথা বলতে গেলে লোকেরা তাঁকে উইকিলিকসের কথা স্মরণ করিয়ে দেবে।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও নিষ্ঠুর নির্যাতন চালানোর দায়ে অভিযুক্ত র‌্যাবকে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের প্রশিক্ষণ দানের ঘটনা ফাঁস হওয়ার মধ্য দিয়ে ঢাকার মার্কিন দূতাবাস তথা আমাদের আমেরিকাপ্রীতির মুখোশটা ঈষৎ হলেও খসে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ঐতিহাসিকভাবে আমাদের পূর্বপুরুষদের চিন্তাভাবনা ও নির্ভরতায় মিশে আছে। প্রাক্-জন্মলগ্নেও মার্কিন মিশন ছিল। পূর্বপুরুষেরা এই দেশটির কাছেই নতুন রাষ্ট্র গঠনের জন্য তহবিল চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্য খুনি চক্র নির্ভরতা খুঁজে পায় মার্কিন দূতাবাসই। আবার বঙ্গবন্ধু পরিবারের, ঘনিষ্ঠদের কেউ প্রাণভয়ে আশ্রয় চান মার্কিন দূতাবাসের কাছেই। পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বর বিমানবাহিনীর একজন নিরাপদ আশ্রয় খুঁজলেন মার্কিন দূতাবাসেই। মোশতাক তো মার্কিন বিশেষ হেলিকপ্টারে পালাতে চেয়েছিলেন।
জেনারেল ইয়াহিয়া ও তাঁর দালালেরা সব সময় মনে রেখেছে, নিক্সন-কিসিঞ্জার, বাপ রে বাপ! তাঁরা মাথার ওপর ছাতা ধরে বসে আছেন। ইতিহাসের কী নির্মম পুনরাবৃত্তি! একাত্তরে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে জড়ায়নি। পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষায় নিক্সন-কিসিঞ্জার কখনোই যুদ্ধে জড়ানোর পরিকল্পনা করেছিলেন বলে জানা যায় না। অথচ পাকিস্তান তৃতীয় কোনো দেশের দ্বারা আগ্রাসনকবলিত হলে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক সহায়তা দেবে, এমন চুক্তি ছিল। সেই চুক্তি বাস্তবায়নে কেউ সক্রিয় হননি। এই ইতিহাস পেছনে রেখে পঁচাত্তরে মোশতাক-জিয়া-ফারুক-রশিদের চক্রটি নতুন করে জিকির তুলল। আসুন, ভুল শুধরে নিই। আসুন, আমাদের কেবলা আমেরিকামুখী করি। এরপর মঞ্চে আসেন জিয়াউর রহমান। ঢাকার মার্কিন দূতাবাসে সামরিক অ্যাটাশে প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবক হলেন তিনি। শুধু মোশতাক-জিয়াকে বলি কেন, পঁচাত্তরের পরের প্রতিটি শাসকগোষ্ঠী ওয়াশিংটনমুখী থাকতে মোটামুটি ধারাবাহিকতা বজায় রেখে চলেছে। সাম্প্রতিক ইতিহাসে মার্কিন দূতাবাসে দুই বড় দলের দৌড়াদৌড়ি সবারই জানা। বিউটি আপার (সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিসিয়া বিউটেনিস) চা চেখে দেখেছেন অনেকেই।
তবে আমাদের গণমাধ্যমের ভূমিকা দেখলে মার্কিন সাংবাদিকেরাও (এমবেডেড ছাড়া) লজ্জা পাবেন। ব্রিটেনের গার্ডিয়ান পত্রিকা র‌্যাবকে প্রশিক্ষণ দানে যুক্তরাজ্যের সংশ্লিষ্টতাকে সংগত কারণেই বড় করে দেখেছে। নিউইয়র্ক টাইমস কিংবা অন্য মার্কিন পত্রিকাগুলো র‌্যাবলিকস নিয়ে হইচই করেনি। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধে অনেকে ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রকে প্রতিবাদী কণ্ঠ হিসেবেই জানত। কিন্তু তলে তলে তারাই র‌্যাবের সঙ্গে দোস্তি গড়ে তুলেছে।
সন্ত্রাস দমনে র‌্যাবের মতো এলিট ফোর্স কোনো রাষ্ট্রের জন্য অপরিহার্য হতেই পারে। কিন্তু এই লেখার উদ্দেশ্য সে কথা বলা নয়, উদ্দেশ্য হলো এটা দেখানো, যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন তথা আমাদের অনেক উন্নয়ন অংশীদারের দৃষ্টিভঙ্গি। তারা কীভাবে তাদের জাতীয় স্বার্থে র‌্যাবের ভাবমূর্তি টিকিয়ে রাখে। তাকে কৌলীন্য দেয়, জাতে ওঠায়। একইভাবে তারা তাদেরই স্বার্থে কোনো সংস্থা, কোনো শাসক, তা হোক সাদ্দাম কিংবা হোসনি মোবারক—তাঁদের বুকে আগলে রাখে। গণ-অভ্যুত্থান বা অবস্থা বেগতিক না দেখলে তারা কুকর্মের জন্য ছাতা সরায় না। মমির দেশে আমরা কী দেখি? জান্তাতুল্য স্বৈরশাসক হোসনি, আপনি বুজরুকি ছাড়ুন। আপনি বলুন, ‘আমার ছেলে গামিল কিংবা পরিবারের কেউ মিসর শাসন করবে না। আমি আর নির্বাচনে দাঁড়াব না।’ এসব কথা কানে দেননি বা দেন না ওবামারা। এসব মন্ত্র তাঁরা কেন মিসর কিংবা বিশ্বের অন্যান্য দেশের কতিপয় নির্বাচিত স্বৈরশাসককে দেন না, জিজ্ঞেস করুন। কায়রো, ইসলামাবাদ কিংবা ঢাকা—সব মার্কিন রাষ্ট্রদূত হয়তো তোতা পাখির মতো গেয়ে উঠবেন: এটা অভ্যন্তরীণ বিষয়। এখন কিন্তু তাঁরা সে দেশে/অঞ্চলে মুখ্যত মার্কিন স্বার্থ রক্ষায় সচকিত। রাতারাতি গণতন্ত্রের মস্ত বড় চ্যাম্পিয়ন সেজে বলছেন, হোসনি তোমার দিন শেষ। নির্বাচন দাও। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনই ভরসা।
আমরা এখানে দেখব, কীভাবে ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও ব্রিটিশ হাইকমিশনার র‌্যাবের মতো একটি মেশিন জাতীয় স্বার্থে কাজে লাগানোর মওকা পেয়ে খুশিতে ডগমগ হয়ে ওঠেন। তখন কিন্তু নিজের দেশের আইন উপেক্ষায়ও তাঁদের সংবেদনশীলতা আমরা দেখি না। ভারতও র‌্যাবকে অবতার মানে। মরিয়ার্টি বলেন, র‌্যাব নিষিদ্ধ করা যাবে না। পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী (সাবেক ভারতীয় হাইকমিশনার) একমত হন।
সিনেটর প্যাট্রিক লেহি একজন প্রভাবশালী মার্কিন সিনেটর। ১৯৯৭ সালে তিনি একটি আইন করেছিলেন। সেটি লেহি ল হিসেবে সুখ্যাত। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের মতো বহু অনুন্নত রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বাহিনীকে সহায়তা দেয়। লেহি আইনে বলা হলো, কোনো দেশের সশস্ত্র বাহিনীর এক ব্রিগেড পরিমাণ সেনা যদি কোনো সংস্থা বা ইউনিটে থাকে এবং সেটা যদি মানবাধিকার লঙ্ঘন; বিশেষ করে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মতো অপরাধ করে থাকে, তাহলে সেই সংস্থা কোনো ধরনের মার্কিন সহায়তা পাবে না। যেমন—র‌্যাবের ইন্দোনেশীয় সহোদর লেহি আইনের আওতায় সাহায্য লাভে অযোগ্য ঘোষিত হয়েছে। সম্প্রতি নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার কথা মুখে আনতেই খোঁচা খান ওবামা। লোকটা বাবার দেশকে আনুকূল্য দিচ্ছেন!
গত ২২ ডিসেম্বর চ্যানেল আইয়ে আমি বললাম, ‘বাংলাদেশে লেহি আইনের লঙ্ঘন কিংবা তাকে কুরে কুরে খাওয়ার ঘটনা ঘটল কি না, সেটা তদন্তযোগ্য। এ জন্য ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের উচিত এর ব্যাখ্যা দেওয়া। পরদিন শীর্ষস্থানীয় দৈনিকগুলোর খবর প্রকাশের ধরন দেখে আমার চোখ ছানাবড়া। ইত্তেফাক তো ঠাকুর ঘরে কে রে, আমি কলা খাই না—সেই প্রবাদবাক্য স্মরণ করিয়ে দিল। কারণ, পত্রিকাটি লাল হরফে শীর্ষ শিরোনাম করল, ‘র‌্যাবকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র দেয়নি’। দুঃখজনকভাবে প্রথম আলোয়ও ছিল একই সুর। তার শিরোনাম ‘র‌্যাব: যুক্তরাজ্যে প্রশিক্ষণ, যুক্তরাষ্ট্রের “না”।’ ডেইলি স্টারও উপশিরোনাম করেছে ‘র‌্যাবকে প্রশিক্ষণ দিতে যুক্তরাষ্ট্রের অস্বীকৃতি’। অথচ মরিয়ার্টি বলেছেন, ‘মার্কিন সরকার র‌্যাবকে মানবাধিকার প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেছে। এ কাজে ব্রিটেনকে আমরা সমর্থন দিয়েছি।’
র‌্যাবলিকস অবশ্যই লেহি আইনের নিরিখে খতিয়ে দেখার দাবি রাখে। মরিয়ার্টি লেহি আইনের দোহাই দিয়ে প্রশিক্ষণ দানে বাধার কথা বলেছেন বটে। কিন্তু আমরা বুঝতে অক্ষম, যে সংস্থা খুন করে বেড়ায়, মিথ্যা বিবৃতি দেয়, সেই সংস্থাকে ‘মানবাধিকারের প্রশিক্ষণ’ দেওয়া কী করে হালাল হতে পারে। মার্কিন সিনেটের উচিত, বিষয়টি তদন্ত করা। আমরা বুঝতে চাই, ইঙ্গ-মার্কিন মানবাধিকার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার পর র‌্যাবের মধ্যে কী কী পরিবর্তন ঘটল। দুই বছর আগে মরিয়ার্টি লিখেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের কর্মকর্তারা র‌্যাবকে একটি অধিকতর স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও মানবাধিকার মান্যকারী আধাসামরিক বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে রিভিউ করছেন। অথচ গত দুই বছরে র‌্যাব শতাধিক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।
গার্ডিয়ান-এর সাম্প্রতিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন এ সংশয় আরও তীব্র করেছে যে জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে র‌্যাব যে ধরনের কলাকৌশল ব্যবহার করে, তা যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন তাদের শিখিয়েছে কি না। কারণ, মরিয়ার্টি লিখেছেন, ১৮ মাস ধরে ব্রিটিশরা র‌্যাবকে শিখিয়েছে, কী কলাকৌশলে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হয়। শিখিয়েছে রুলস অব এনগেজমেন্ট (শক্তি প্রয়োগের পদ্ধতি)। মরিয়ার্টি তাঁর পরিকল্পনাও তুলে ধরেছিলেন। দুজন মার্কিন মার্শাল তিন মাস র‌্যাবের সঙ্গে থাকবেন। তাঁরা র‌্যাবকে শক্তি প্রয়োগের কলাকৌশল শেখাবেন। এই বিষয়ে ঢাকার ব্রিটিশ হাইকমিশনার ইভান্স তাঁর কল্পনাশক্তি আরও প্রখর করলেন। বলেন, ওই মার্শালরা আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে এপারে এসে একটু জিরিয়ে নেবেন। বাংলাদেশে যাওয়ার আগে তাঁরা খোশগল্প করে নেবেন ব্রিটিশ পুলিশের সঙ্গে। কারণ, তাঁরাই র‌্যাবকে মানবাধিকার প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। মরিয়ার্টি লিখেছেন, এই প্রস্তাব তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমর্থন করেন। এর একটাই অর্থ দাঁড়ায়, দক্ষিণ এশিয়ায় ইঙ্গ-মার্কিন সংজ্ঞায়িত সন্ত্রাস দমনে র‌্যাব এখন এক মহার্ঘ হাতিয়ার।
সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর, প্রতিরক্ষা ও বিচার মন্ত্রণালয়ের পদস্থ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত একটি আন্তমন্ত্রণালয় প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করে। দলটির নেতা ছিলেন রাষ্ট্রদূত ডেল ডেইলে। নিউইয়র্কভিত্তিক হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বহু আগেই র‌্যাবের নামকরণ করেছে ‘বাংলাদেশের ডেথ স্কোয়াড’। তদুপরি ওই প্রতিনিধিদল কিন্তু এর সত্যতা যাচাই করতে ঢাকায় আসেনি। তাদের লক্ষ্য ছিল র‌্যাবকে কীভাবে, কখন যুক্তরাষ্ট্র সরকার নিজেদের কাজে লাগাতে পারে। মনের গহিনে এটা রেখেই তারা র‌্যাব সম্পর্কে একটি ‘ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি’ পেতে চায়। ঢাকার পক্ষপাতদুষ্ট ও বিভক্ত সুশীল সমাজের সঙ্গে তারা কথা বলে।
যুক্তরাষ্ট্র সারা বিশ্বে র‌্যাবের মতো মিত্র আবিষ্কারে বেরিয়েছে। সে জন্য তারা ‘কো-অর্ডিনেটর ফর কাউন্টারটেররিজম’ নামে একটি প্রকল্প খুলেছে। এরই প্রধান রাষ্ট্রদূত ডেইলে। তিনি আমাদের সুশীল সমাজের ‘অনেক প্রবক্তার কাছ থেকে শক্তিশালী বার্তা পান যে গত দশকের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে ভীতসন্ত্রস্ত জনগোষ্ঠী র‌্যাবকে বিরাট শ্রদ্ধা ও অনুরাগ দেখিয়ে থাকে। উপরন্তু পুলিশের অন্যান্য অংশের (এর মানে র‌্যাব পরশপাথর। এর স্পর্শধন্য পুলিশ মানেই ধোয়া তুলসী পাতা) অব্যাহত দুর্নীতি এবং অকার্যকারিতার প্রেক্ষাপটে অনেকের কাছে র‌্যাব পরিণত হয়েছে শ্রেয়তর বিকল্পে।’ এরপর মরিয়ার্টি ওয়াশিংটনকে যা লিখেছেন, তা রীতিমতো ভয়ংকর। তাঁর এই বক্তব্যের সঙ্গে আমরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের মন্তব্যের যোগসূত্র খুঁজে পাই। বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ড অব্যাহত থাকার পরও সাহারা খাতুন অবলীলায় বললেন, আওয়ামী লীগের আমলে বিচারবহির্ভূত কোনো হত্যাকাণ্ড ঘটেনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘রাতারাতি বন্ধ করা যাবে না।’ তার মানে রাষ্ট্র এখন রক্তপিপাসু। রক্তপানে তার আসক্তি এসেছে। কোনো নেশাই সম্ভবত রাতারাতি ছাড়া যায় না। মরিয়ার্টি তা আরও উসকে দেন। তাঁর কথায়, ‘মার্কিন প্রতিনিধিদল (ডেইলের নেতৃত্বাধীন) উল্লেখ করেছে যে র‌্যাব ও সুশীল সমাজের অনেক প্রতিনিধি দৃশ্যত এটা মেনে নিতে প্রস্তুত রয়েছেন যে কতিপয় কুখ্যাত ব্যক্তি র‌্যাবের সঙ্গে এনকাউন্টারে মারা যাবেই এবং সুশীল সমাজ ওই আউটকাম অর্থাৎ হত্যাযজ্ঞ দৃশ্যত মেনে নেবে।’
মরিয়ার্টির জবানিতে আমরা অসহায়ত্ব খুঁজে পাই। সেই অসহায়ত্ব, সেই ভোঁতা অনুভূতি হয়তো আমাদের সমাজেরই। কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মাথাব্যথা আর মরিয়ার্টি ও ইভান্সের মাথাব্যথা এক হওয়ার নয়। বোধগম্য কারণেই তাঁরা তাঁদের জাতীয় স্বার্থ ঊর্ধ্বে তুলে ধরবেন। আমাদের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে তাঁদের জাতীয় স্বার্থের অসামঞ্জস্য হলে, সংঘাত হলে, আমাদের জাতীয় স্বার্থের ওপর তাঁদের জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেবেন। তবে মরিয়ার্টি ও মার্কিন প্রতিনিধিদলের মূল্যায়নের সীমাবদ্ধতা কিংবা যুক্তির মূল ভিত্তি হচ্ছে এটা ধরে নেওয়া যে বাংলাদেশের পুলিশ দিয়ে আর সন্ত্রাস দমন হবে না। বাংলাদেশের আদালত দিয়ে সন্ত্রাসীদের শাস্তি দেওয়া যাবে না। মরিয়ার্টির কথায়, ‘কুখ্যাত ব্যক্তিরা এনকাউন্টারে মরবে, কারণ বর্তমানে বাংলাদেশের অকার্যকর এবং মামলার স্তূপ জমে থাকা আদালতব্যবস্থায় দোষীদের পার পেয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকছেই।’ মার্কিন রাষ্ট্রদূতের ক্ষোভ: ‘র‌্যাব আমাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে শক্ত সমর্থন দিচ্ছে। কিন্তু বাগড়া দিচ্ছেন বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অল্প কিছুসংখ্যক অনাগ্রহী আমলা। তাঁরা যাতে আমাদের পরিকল্পনা ব্যর্থ করতে না পারেন।’ বিষয়টি এই রাষ্ট্রের তিনটিকে নয়, চতুর্থ স্তম্ভকেও ভাবতে হবে।
গত ৩১ জানুয়ারি ব্রিটেনের হাউস অব লর্ডসের মানবাধিকার-বিষয়ক সভাপতি লর্ড এরিক এল এভাবেরি, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের আব্বাস ফয়েজ এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ব্রাড অ্যাডামস প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে লন্ডনের হোটেলে প্রায় এক ঘণ্টা কথা বলেন। তাঁরা র‌্যাবের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে সরকারের ঔদাসীন্যে হতাশা ব্যক্ত করেন। কিন্তু আমাদের বাসস যথারীতি খবর প্রকাশ করেছে যে তারা বাংলাদেশের বিদ্যমান মানবাধিকার পরিস্থিতিতে সন্তোষ প্রকাশ করেছে। এটা ছিল সত্যের অপলাপ। শুনেছি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি গতকাল তা একপ্রকার স্বীকার করেন। তবে সেদিন গণভবনে দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সঙ্গে সুর মিলিয়ে গতকাল তিনি বললেন, ‘বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ড প্রায় আমাদের পদ্ধতির অংশে পরিণত হয়েছে। রাতারাতি দূর করা যাবে না।’
আমরা বুঝে নেব, যদি যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও বাংলাদেশি শাসকগোষ্ঠীর স্বার্থ ভিন্নতর কারণে হলেও তা র‌্যাবকেন্দ্রিক হয়, তাহলে বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চলতেই থাকবে, শুধু আমরা যেন খামোকা কল্পনা ভাইরাসে আক্রান্ত না হই। ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের মুখপাত্র যদিও বলেছেন, র‌্যাবের নির্যাতনবিষয়ক তদন্ত হবে। তবে উত্তরায় কী ঘটেছিল, সেটা অন্তর্ভুক্ত হবে কি না, সে সিদ্ধান্ত নেবেন বিচারপতি পিটার গিবসন। ঢাকায় ইভান্স যদিও গার্ডিয়ান-এর প্রতিবেদনকে সঠিক নয় বলেই সতর্ক মন্তব্য করেছেন। কিন্তু এও সত্য, তাঁরা তাঁদের সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের হদিস পেতে র‌্যাবের রমরমা সেবা নিয়েছেন। র‌্যাব কেন ঘাতক হলো, কোন হতাশা থেকে দুর্বৃত্তদের হত্যার বিষয়টি একটা গ্রহণযোগ্যতা পেল, তার সুলুক সন্ধানে ব্রতী হওয়া কোনো বিদেশি রাষ্ট্রদূতের কম্ম নয়। তাদের চাই সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের চৌকস মিত্র। ব্রিটেনে গার্ডিয়ান পত্রিকা র‌্যাব নিয়ে যে ঝড় তুলেছে, তাতে কমন্স নীরব। টেমসের পানি একটুও তরঙ্গায়িত হয়নি। মরিয়ার্টি ও ইভান্সরা র‌্যাবকে মানুষ করার যে যুক্তি দিচ্ছেন, এর সঙ্গে তাঁদের সেনাশাসন-সেবার মিল আছে। তখনো তাঁরা ‘গণতন্ত্রে উত্তরণ’সংক্রান্ত যুক্তি দেন।
যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, পশ্চিমা শক্তি—কেউই তাদের আশু জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার না দিয়ে আমাদের মাথায় ছাতা ধরবে না। বৃষ্টিতে ভেজা থেকে আমাদের বাঁচাবে না। শুধু র‌্যাব বলেই নয়, প্রায় সব ক্ষেত্রেই আমাদের তা স্মরণ রাখতে হবে।
পুনশ্চ: লন্ডনের মার্কিন দূতাবাসের সদ্য প্রকাশিত (৪ ফেব্রুয়ারি) একটি তারবার্তা নজরে এল। তাতে দেখি, ঢাকা সফরকারী ওই যে ডেইলে সাহেব ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা রবার্ট হ্যানিগান ও পররাষ্ট্র দপ্তরের সন্ত্রাস দমন বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে লন্ডনে বৈঠক করেন এবং সেখানে তাঁরা দক্ষিণ এশিয়া ও পূর্ব আফ্রিকায় কাউন্টার টেররিজমবিষয়ক নীতিনির্ধারণী মতবিনিময় করেন। সুতরাং এই কেবলটিও সাক্ষ্য দেয় র‌্যাব বিষয়ে ইঙ্গ-মার্কিন গন্তব্য অভিন্ন। ৩ ফেব্রুয়ারি লন্ডন থেকে টেলিফোন পাই একজন মানবাধিকার নেতার তরফে। আমাদের গণমাধ্যমে আমেরিকাপ্রীতির কথা তাঁকে বললাম। তিনি সহাস্যে বললেন, র‌্যাবলিকসের দিনে ঢাকা থেকে মিডিয়ার অনেক ফোন পান। আচ্ছা বলুন তো, যুক্তরাষ্ট্র কি র‌্যাবকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে? তিনি বলেছেন, ‘এখনই হ্যাঁ বা না বলা যাবে না।’ আমাদের এ রকম অতি উৎসাহী ও অন্যায্য আমেরিকাপ্রীতি পরিত্যাজ্য।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.