মৃত্যুর পরও কি হেনারা রেহাই পাবে না?-ধর্ষণ, দোররা ও এজাহার

১৪ বছরের কিশোরী হেনাকে প্রথমে ধর্ষণ করেছে এক পাষণ্ড পুরুষ, তারপর তার আত্মীয়স্বজন মেয়েটিকে নির্মমভাবে প্রহার করেছে, পরদিন সালিসের নামে দোররা মেরে তাকে মৃত্যুমুখে পাঠানো হয়। ধর্ষণ ও মৃত্যু পর্যন্ত এই নৃশংসতা চালায় ধর্ষক পুরুষ ও গ্রামের সমাজপতিরা।


অপমান আর লাঞ্ছনার দ্বিতীয় পর্ব সম্পন্ন হয় পুলিশের হাতে। মামলার এজাহারে ধর্ষণের অভিযোগ এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে এবং ধর্ষককে দেখানো হয়েছে তার ‘প্রেমিক’ হিসেবে। এজাহারে উল্লেখ না থাকায় ময়নাতদন্তে ধর্ষণের প্রমাণ খোঁজার চেষ্টা হয়নি। হেনার বাবার অভিযোগ, এজাহার তাঁকে না শুনিয়েই টিপসই নেয় পুলিশ। সালিসকারীরা তড়িঘড়ি করে হেনাকে কবর দেওয়ার মাধ্যমে অপরাধটিকেই চাপা দেওয়ার চেষ্টা করে। হেনার জীবন ও মৃত্যুর পরের পরিণতির জন্য কেবল ধর্ষকই নয়, সমাজপতি, পুলিশ ও সিভিল সার্জনও দায়ী। প্রথম পক্ষ ধর্ষণের বিচার না করে কার্যত ধর্ষণের শিকারকেই শাস্তি দিয়েছে, দ্বিতীয় পক্ষ ধর্ষণের তদন্ত-প্রক্রিয়াকে করেছে বিপথগামী। মৃত্যুর পরও হেনা ও তার লাশ লাঞ্ছনার কবল থেকে রক্ষা পায়নি। সালিসকারীদের মতো পুলিশও ১৪ বছরের কিশোরীটির সঙ্গে চল্লিশোর্ধ্ব ধর্ষক পুরুষের ‘প্রেমের সম্পর্কের’ বানোয়াট গল্প চালু করে হেনার নারীত্বকেই অপমান করেছে।
এ অবস্থায়, হাইকোর্ট ডেইলি স্টার-এর প্রতিবেদন থেকে জ্ঞাত হয়ে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে হেনার লাশের আবার ময়নাতদন্তের নির্দেশ দেন। এটা জরুরি, কারণ ধর্ষকের আত্মীয়দের প্রহার এবং ৭০-৮০টি দোররার শিকার হেনার শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন না পাওয়া বিস্ময়কর। আরও ন্যক্কারজনক হলো ময়নাতদন্তে ধর্ষণের কোনো পরীক্ষা না করা। পুলিশের এজাহার আর শরীয়তপুরের সিভিল সার্জনসহ অন্য দুই চিকিৎসা কর্মকর্তার ত্রুটিপূর্ণ ময়নাতদন্তের মধ্যে যোগসাজশ থাকাও বিচিত্র নয়। দরিদ্র ও বিপন্ন হেনারা বেশির ভাগ সময় সমাজ, রাষ্ট্র ও প্রশাসনের আশ্রয় না পেয়ে কেন বৈরিতার শিকার হয়, সেটাও ভেবে দেখতে হবে। এখন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বিচারালয়ে হেনার বিষয়টি সুবিচারের অপেক্ষায়। বিচার হতে হবে সবার: ধর্ষক-নির্যাতকদের শাস্তির সঙ্গে সঙ্গে ফতোয়াবাজ সমাজপতি এবং অসাধু পলিশ ও চিকিৎসকদের ভূমিকাও তদন্ত করতে হবে।
আদালতের বিচার আদালত করবেন, কিন্তু যে সমাজ-সংস্কৃতি হেনার মতো ১৪ বছরের এক কিশোরীর জীবন ও সম্মান কেড়ে নিল, তার বিচার কে করবে? আর কত দিন আমরা আমাদের সমাজের এই নৃশংস অমানবিকতাকে সহ্য করব? আর কত ইয়াসমিন-নূরজাহান-হেনারা বর্বরতার শিকার হবে?

No comments

Powered by Blogger.