চট্টগ্রামে গুম: চারজন আওয়ামী লীগের, একজন বিএনপির-সন্ধান মেলেনি পাঁচজনের by একরামুল হক

২০০৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে ২০১০ সালের ৭ নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় ২৩ মাসে চট্টগ্রামে পাঁচ ব্যক্তি গুম হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে একজন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যানসহ চারজনই রাউজানের বাসিন্দা। অন্যজন বোয়ালখালীর ইউপি চেয়ারম্যান ও বিএনপির নেতা।


রাউজানের চারজনই সরাসরি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
গুম হওয়া ব্যক্তিরা হলেন রাউজানের বাগোয়ান ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ জাফর, নোয়াপাড়ার আজিমউদ্দিন মাহমুদ ও বদিউল আলম এবং বড় ঠাকুরপাড়ের নুরুল আজিম। অন্যজন হলেন বোয়ালখালী উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও করলডেঙ্গা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম ওরফে বাচা চেয়ারম্যান।
এই পাঁচজনকে গুম করার পর মেরে ফেলা হয়েছে বলে নানা আলোচনা রয়েছে। তবে সে সম্পর্কে কারও কাছে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। গুম হওয়া সবাই একাধিক মামলার আসামি ছিলেন বলে জানা গেছে। তাঁদের মধ্যে নজরুল ইসলাম বোয়ালখালী পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী। আজিমউদ্দিন নগরের হাজারী গলির বাসিন্দা শ্রীকান্ত রক্ষিত হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডাদেশের আসামি ছিলেন। তবে উচ্চ আদালত থেকে তিনি বেকসুর খালাস পান। একইভাবে বাগোয়ানের চেয়ারম্যান জাফরের বিরুদ্ধে অস্ত্রসহ বিভিন্ন অপরাধের মামলা ছিল।
স্থানীয় সূত্র জানায়, বাগোয়ান ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাফর দক্ষিণ রাউজান ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। পরে ১৯৯৯ সালে তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। ২০০১ সালে জাতীয় নির্বাচনের পর তিনি দলবদল করে বিএনপিতে যোগ দেন। আবার ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনের পর তিনি বিএনপির সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে ফিরে আসেন আওয়ামী লীগে।
জাফর চেয়ারম্যানসহ চারজনই নগর এলাকা থেকে গুম হন বলে সংশ্লিষ্ট পরিবারের সদস্যদের পক্ষ থেকে অভিযোগ ওঠে। যেমন নগরে ২০১০ সালের ২৭ মার্চ উধাও হয়ে যান সৈয়দ মোহাম্মদ জাফর। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও তাঁর সন্ধান মেলেনি। শ্রীকান্ত রক্ষিত হত্যা মামলার আসামি আজিমউদ্দিন মাহমুদ ২০০৯ সালের ৪ এপ্রিল নগর এলাকা থেকে গুম হন। এর আগে ২০০৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর গুম হন নুরুল আজিম। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে গুম হন বদিউল আলম।
আজিমউদ্দিন ও বদিউল আলম সম্পর্কে নোয়াপাড়ার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দিদারুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওরা গুম হয়েছে বলে শুনেছি। এখন বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে তা আমাদের জানা নেই। কারা গুম করেছে সে সম্পর্কেও আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই।’
জানা গেছে, ২০১০ সালের ২৭ মার্চ নগরের খুলশি থানাধীন ভূঁইয়া গলির মুখ থেকে মাইক্রোবাস আরোহী পাঁচ-ছয় ব্যক্তি জাফরকে গাড়িতে তুলে অজ্ঞাত জায়গায় নিয়ে যায়। এরপর তাঁর স্বজনেরা র‌্যাব কার্যালয়ে যান। কিন্তু জাফরের অবস্থান সম্পর্কে র‌্যাব কর্মকর্তারা পরিষ্কার কোনো ধারণা দিতে পারেননি।
জাফরের খালাতো ভাই গিয়াসউদ্দিন এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আজও আমরা জাফর ভাইয়ের জন্য অপেক্ষায় আছি। তিনি বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন তা আমরা জানি না। আমরা তাঁর অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে র‌্যাবের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা বলেছিলেন, ‘আপনার ভাই পায়ে হেঁটে যেভাবে ঘর থেকে বের হয়েছেন। একইভাবে পায়ে হেঁটে বাসায় ফিরবেন।’
প্রসঙ্গত, ২০০৭ সালে পিস্তলসহ একবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন সৈয়দ মোহাম্মদ জাফর। এরপর তিনি দীর্ঘদিন কারাভোগ করেন। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনের সময় তিনি জামিনে মুক্তি পান।
বোয়ালখালী উপজেলা বিএনপির সভাপতি নজরুল ইসলাম গুম হন ঢাকা থেকে। জানা যায়, নজরুল ২০১০ সালের ৭ নভেম্বর রাত পৌনে আটটার দিকে রাজধানী ঢাকার ফার্মগেট থেকে গাজীপুরের উদ্দেশে রওনা হন। জয়দেবপুরের বাগড়া বিকল্প সড়কের চৌরাস্তা মোড়ে তাঁর গাড়িটি যানজটে আটকে পড়ে। এ সময় অজ্ঞাতপরিচয় চার-পাঁচজন লোক নজরুলকে অস্ত্রের মুখে অন্য একটি মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়। এর পর থেকে তাঁর কোনো খবর পাওয়া যায়নি। বিএনপির নেতা-কর্মীরা এ জন্য র‌্যাবকে দায়ী করে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন। মামলাসংক্রান্ত কাজে নজরুল ইসলাম ঢাকা হাইকোর্টে গিয়েছিলেন।
বিএনপির অভিযোগ প্রসঙ্গে র‌্যাব-৭-এর তৎকালীন অধিনায়ক লে. কর্নেল সাজ্জাদ হোসাইন ওই সময় বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর এই বক্তব্য ওই সময় প্রথম আলোতে প্রকাশিত হয়।
নজরুলকে গুম করার প্রতিবাদে স্থানীয় বিএনপি ২০১০ সালের ৯ নভেম্বর সন্ধ্যায় চান্দগাঁও র‌্যাব কার্যালয় ঘেরাও করে। সড়ক অবরোধ করে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দিয়েছিলেন বিএনপির কর্মীরা। এরপর স্থানীয় বিএনপি নগরে ও বোয়ালখালীতে নানাভাবে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে।
জানা গেছে, নজরুলের বিরুদ্ধে খুন, ধর্ষণ, অস্ত্র আইন, চাঁদাবাজিসহ ১৯টি মামলা ছিল। তিনি বোয়ালখালী থানা পুলিশের এক নম্বর তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী বলে তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবদুল মালেক মিয়া জানিয়েছিলেন, যা প্রথম আলোতে প্রকাশিত হয়।
দক্ষিণ জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাংসদ জাফরুল ইসলাম চৌধুরী এ প্রসঙ্গে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারের লোকজন নজরুল ইসলামকে গাজীপুর থেকে গুম করে। তাঁকে ফিরিয়ে দিতে আমরা সরকারের কাছে বারবার দাবি জানিয়ে আসছি। ইতিপূর্বে আমাদের একাধিক কর্মসূচি পালন হয়েছে, যার মধ্যে মানববন্ধন, প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ সমাবেশ ছিল। আমরা এখনো কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছি। আসলে নজরুল বেঁচে আছেন নাকি তাঁকে মেরে ফেলা হয়েছে তা আমাদের জানানো উচিত। নইলে কর্মসূচি চলতে থাকবে।’
চট্টগ্রাম জেলার কোনো এলাকা থেকে কেউ গুম বা অপহরণ হলে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তার দায় আসে জেলা পুলিশের ওপর। কিন্তু রাউজান ও বোয়ালখালী থেকে বিভিন্ন সময় গুম হওয়া ব্যক্তিরা জীবিত না মৃত সে সম্পর্কে কেউ কিছু জানে না। এ ব্যাপারে জেলা পুলিশ সুপার জেড এ মোরশেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি চট্টগ্রামের এসপি (পুলিশ সুপার) হিসেবে যোগ দেওয়ার অনেক আগেই এসব গুমের ঘটনা ঘটেছে। আগের প্রশাসন কী করেছে, আমার জানা নেই।’
গুম হওয়া ব্যক্তিদের অবস্থান সম্পর্কে তাঁর ধারণা কী, জানতে চাইলে জেড এ মোরশেদ বলেন, ‘এসব তো অনেক পুরোনো বিষয়। আমি ঘটনাগুলো সম্পর্কে আসলে তেমন কোনো খোঁজখবর নিইনি।’

No comments

Powered by Blogger.