বাইক্কা বিল-রিং পরে উড়ছে পরিযায়ী by বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন

চারপাশে কেবলই পাখি আর পাখি। ওদের সরব উপস্থিতি সবুজ প্রকৃতিতেও যেন এনেছে নিবিড় সতেজতা। মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের বাইক্কা বিলটি যেন পুরোপুরি দখল করে নিয়েছে পরিযায়ী পাখিরা। ওদের কিচিরমিচির শব্দে পুরো প্রকৃতিতে ছড়িয়ে পড়েছে যেন অন্য জগতের এক আবহ। এর মধ্য দিয়ে পরিবেশের ভারসাম্যের দায়ভারটুকুও যেন বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ এই জীব নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা ও


সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে বাইক্কা বিলে পাখিদের পায়ে পরানো হয়েছে রিং। এবারই প্রথম ৩ নভেম্বর বাইক্কা বিল অভয়াশ্রমে পাখিদের পায়ে পরানো হয় আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বাংলাদেশের রিং। রিংয়ে ক্ষুদ্রাকারে লেখা রয়েছে_জিপিও বক্স ২৬২৪, ঢাকা। এর নিচে আছে ই০০০০৫০ অনুরূপ একটি ক্রমিক নম্বর। প্রতিটি রিংয়ের দৈর্ঘ্য আধা সেন্টিমিটার থেকে দেড় সেন্টিমিটার পর্যন্ত। প্রতিটি রিংয়ের গায়েই লেখা রয়েছে আলাদা নম্বর। যাতে একটি অন্যটির সঙ্গে মিলে না যায়। বাইক্কা বিলে ৩ ডিসেম্বর শুরু হয়ে এই কার্যক্রম, চলে ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
পাখিদের পায়ে রিং পরানোর কার্যক্রমে গবেষকদের জালে ৭ ডিসেম্বর ধরা পড়েছে 'বড় ঠুঁটি-চুটকি' নামের বিরল প্রজাতির এক পরিযায়ী পাখি। পাখিটি মেটে রঙের। ওজন মাত্র ১০ গ্রাম। ইংরেজি নাম লার্জ বিল্ড ওয়ারব্লার (খধৎমব-ইরষষবফ ডধৎনষবৎ) এবং বৈজ্ঞানিক নাম অ্যাক্রোসেফালাস ওরিনাস (অপৎড়পবঢ়যধষঁং ঙৎরহঁং)। পাখি গবেষকরা জানিয়েছেন, পৃথিবীব্যাপী এটি মহাবিপন্ন প্রজাতির পাখি। গত ১০০ বছরে মাত্র কয়েকবার পাখিটির দেখা মিলেছে। বাংলাদেশে এই প্রথম বাইক্কা বিলে এর সন্ধান মিলেছে।
সমন্বিত সংরক্ষিত এলাকা সহব্যবস্থাপনা প্রকল্প (আইপ্যাক) ও বাইক্কা বিল বড়গাঙ্গিনা সম্পদ ব্যবস্থাপনা কমিটির সহায়তায় বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব ছয় দিনব্যাপী এ কার্যক্রম চালায়। ছয় সদস্যের এই দলের নেতৃত্ব দেন বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সভাপতি পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হক। কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করেন প্রখ্যাত দুই পাখি বিশেষজ্ঞ নিক ডায়মন্ড ও ড. ফিলিপ রাউন্ড। এ ছাড়া রয়েছেন তরুণ পাখিপ্রেমী সামিউল মোহসেনিন, সায়েম চৌধুরী ও ফয়সল।
ইনাম আল হক কালের কণ্ঠকে জানান, ৩১ প্রজাতির ২০৩টি পাখির পায়ে রিং পরানো হয়েছে। এর মধ্যে ১৫৩টি পরিযায়ী পাখি এবং ৫০টি দেশি পাখি। রিং পরানো ১৭ প্রজাতির পরিযায়ী পাখির মধ্যে রয়েছে_মেটে লাটরা, টাইগা চুটকি, হলদে ভ্রু চুটকি, ধলা লেজ চুনিকণ্ঠী, সাইবেরীয় চুনিকণ্ঠী, বাচাল ফুটকি, মোটা ঠোঁট ফুটকি, কালা ভ্রু ফুটকি, কালচে ফুটকি, সবুজ ফুটকি, উদয়ী নলফুটকি, পালাসি ফড়িং ফুটকি, বন বাটান প্রভৃতি। অন্যদিকে বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী ১৪ প্রজাতির পাখির পায়ে রিং স্থাপন করা হয়েছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে_তিলা ঘুঘু, করুণ কোকিল, খয়েরি শিকরেপেঁচা, পাতি মাছরাঙা, সবুজ সুইচোরা, বাংলা বুলবুল, লেঞ্জা লাটুরা, বাটি শালিক, পাকরা শালিক প্রভৃতি।
ইনাম আল হক আরো বলেন, 'পাখি কোথা থেকে আসে, কোথায় যায়, কোথাও স্থির থাকে কি না_মূলত পাখির চলাচল পর্যবেক্ষণ করাই রিং পরানোর উদ্দেশ্য। ধরুন, আমাদের রিং পরানো কোনো পাখি রাশিয়ায় গিয়ে ধরা পড়ল বা মরে পড়ে থাকল। ওই দেশের কোনো পাখিপ্রেমী বা গবেষক পাখিটি পাওয়ার তথ্য রিংয়ের গায়ে লেখা ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলেই আমরা পেয়ে যাব। তখন আমরা জানতে পারব যে পাখিটি বাংলাদেশ থেকে রাশিয়ায় গিয়েছিল। ঢাকার প্রধান ডাকঘরে জিপিও-২৬২৪ বাঙ্টি এ-সংক্রান্ত তথ্যের জন্যই খোলা হয়েছে।'
ফেব্রুয়ারিতে আবারও বাইক্কা বিলে পাখির পায়ে রিং লাগানোর কথা জানিয়ে ইনাম আল হক বলেন, 'পৃথিবীর অন্যান্য দেশ এক শ বছর ধরে বার্ড রিংগিং করে আসছে। আর আমরা মাত্র দু-বছর হয় এ পদ্ধতি শুরু করলাম। গত বছরের ২২ নভেম্বর কঙ্বাজারের সোনাদিয়া দ্বীপে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো বার্ড রিংগিং ক্যাম্প অনুষ্ঠিত হয়। গত মার্চে বাইক্কা বিলে প্রথম পাখির পায়ে রিং পরানো হয়।'
সামিউল মোহসেনিন ও সায়েম চৌধুরী বলেন, 'আমরা আগের দিন জালটা পেতে রেখে আসি। প্রতিদিন ভোরে গিয়ে অন্ধকার থাকতে থাকতে জালটা খুলে দিই। ১০-১৫ মিনিট অন্তর আটকে পড়া পাখিগুলোকে খুব যত্নে ধরে এনে স্কেল, ডিজিটাল স্প্রিং নিক্তি, স্লাইড ক্যালিপার্স প্রভৃতি যন্ত্রের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের মাপজোখ নিই। এরপর যত দ্রুত সম্ভব তাদের পায়ে রিং পরিয়ে আবার ছেড়ে দিই।'

No comments

Powered by Blogger.