শনিবারের সুসংবাদ-আতরে সমৃদ্ধির সুবাস by লিটন শরীফ

চন ধরলে গাছ নষ্ট হয়ে যায়_এটা জানা কথা। গাছের পচন রোধে আমাদের চেষ্টারও কমতি থাকে না। ঠিক এর উল্টো কাজটি করা হয় আগরগাছের ক্ষেত্রে। পচন ধরাতে এই গাছে পেরেক ঢুকানো হয়। এতে গাছ হয় ক্ষতবিক্ষত। আর যে গাছ যত বেশি ক্ষতবিক্ষত, সে গাছ তত বেশি অর্থকরী। কারণ আগরগাছের ক্ষতস্থান থেকেই তৈরি হয় সুগন্ধি আতর।\ মৌলভীবাজারের সবুজে ঘেরা বড়লেখার সুজানগরের মানুষের সঙ্গে আতরের পরিচিতি আজকের নয়।


বহু দিন ধরেই তাঁরা বিশেষ কায়দায় আগরগাছ থেকে আতর সংগ্রহ করে আসছেন। আর তা সমাদৃত হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য ছাড়িয়ে জাপান, এমনকি ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশেও। আয় হচ্ছে কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা।
সুগন্ধি আতর বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ব্যাপকভাবে সমাদৃত। এর সুবাদে মৌলভীবাজারে উৎপাদিত আতর সেখানে ধীরে ধীরে জায়গা করে নিয়েছে। ওই সব দেশে প্রবাসী বাংলাদেশিদের উদ্যোগে আতরের বড় বড় দোকান গড়ে উঠেছে। বাইরে বাজার সম্প্রসারিত হওয়ায় মুনাফার আশায় ক্রমেই মানুষ ঝুঁকছে এ শিল্পে। বর্তমানে বড়লেখা উপজেলার সুজানগর গ্রামের প্রায় পঁচিশ হাজার মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত এ কাজে। এখানে বছরে ২০ থেকে ৩০ কোটি টাকার আগরপণ্য উৎপাদিত হচ্ছে।
কিন্তু সম্ভাবনাময় এ কুটির শিল্পকে আজও 'শিল্প' হিসেবে ঘোষণা করা হয়নি। নেই পৃষ্ঠপোষকতা। ফলে মূলধন সংকট, যথাযথ মান নিয়ন্ত্রণ ও বাজারজাতকরণে প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হচ্ছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের। অথচ শিল্প হিসেবে ঘোষণার পাশাপাশি আতর শিল্পে সরকারি-বেসরকারিভাবে ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতার ব্যবস্থা করলে আগর-আতর শিল্প হতে পারে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের অন্যতম মাধ্যম। দাবি উঠেছে এলাকায় আগর-আতর গবেষণা ইনস্টিটিউট স্থাপনেরও।
আগর-আতরের ইউনিয়ন : বড়লেখা উপজেলার সুজানগর ইউনিয়নকে আগর-আতরের ইউনিয়ন বললে ভুল হবে না। মৌলভীবাজার-বড়লেখা সড়কের রতুলি নামক স্থান থেকে পশ্চিম দিকে সুজানগর ইউনিয়নে ঢুকলেই চোখে পড়ে পিচঢালা রাস্তার দুই পাশে সারি সারি আগরগাছ। এমন কোনো বাড়ি নেই, যার আঙিনায় কিছু আগরগাছ নেই। কোথাও বা এক-দুই বিঘা বা তারও বেশি জায়গা নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে আগরের বাগান।
এলাকাবাসী জানায়, পঞ্চাশের দশকের আগ পর্যন্ত সুজানগরে এককভাবে সারা বিশ্বের প্রায় শতভাগ আগর তৈরি হতো। প্রথম দিকে পার্শ্ববর্তী পাথারিয়া পাহাড় ও ভারতের পাহাড়ি এলাকা থেকে আগর কাঠ সংগ্রহ করে এনে সুজানগরে আতর তৈরি হতো। ষাটের দশকের শেষদিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভারতীয় আগর কাঠ চোরাইয়ের অভিযোগে কারখানা মালিকদের ধরে নিয়ে যায়। তখন পেশার তাগিদে অনেক ব্যবসায়ী ও কারিগর ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি জমান। এতে এলাকায় আগর উৎপাদন ও বাণিজ্যে কিছুটা ভাটা পড়ে। তবে হারিয়ে যায়নি। বর্তমানে নানা প্রতিকূলতার মাঝেও তরুণরা এ শিল্পকে বাঁচাতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। নিজেরাই এখন গাছ লাগাচ্ছেন, বাগান করছেন। অনেকে আগর-আতর উৎপাদন করেন না। কেবল আগরগাছের বনায়ন করে উৎপাদনকারীদের কাছে গাছ বিক্রি করেন।
আতর উৎপাদন প্রক্রিয়া : আতর শিল্পে ব্যবহৃত আগরগাছ শুরুতে ছিল মূলত পাহাড়ে উৎপাদিত বৃক্ষ। কিন্তু চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় গাছ সংকটে একপর্যায়ে ঐতিহ্যবাহী শিল্পটি মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম হয়। এটা প্রায় ২০ বছর আগের চিত্র। এ অবস্থায় সুজানগরবাসী নিজেরাই উদ্ভাবন করলেন এক পদ্ধতি। তাঁরা আগরগাছের কাণ্ডে লোহার পেরেক পুঁতে আগর তৈরির প্রযুক্তি আবিষ্কার করলেন। পেরেক মারার কারণে গাছে কৃত্রিম ক্ষতের সৃষ্টি হচ্ছে। সেই ক্ষতস্থানের সম্প্রসারণ রোধে চারদিক থেকে কষ এসে স্থানটি ঘিরে ফেলছে। এভাবে কৃত্রিম ক্ষতই হয়ে উঠছে আতরের উৎস। বর্তমানে এ প্রযুক্তি খুবই জনপ্রিয়। তবে আরো একটি প্রযুক্তি সিএ (কেমিক্যাল অ্যাপ্লিকেশন) কীটও কৃত্রিম ক্ষত তৈরির জন্য ব্যবহার হচ্ছে। এ প্রযুক্তিতে গাছে গর্ত করে সেখানে ক্যাপসুল ঢুকিয়ে গর্তটি ঢেকে দেওয়া হয়।
জানা গেছে, আতর উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রথমে আগরের গাছ কাটা হয়। এরপর গাছটি কেটে টুকরো টুকরো করে গাছ চিরে শত শত পেরেক খোলা হয়। পেরেক খোলা হলে শ্রমিকরা ক্ষতচিহ্নিত অংশ (মাল) আলাদা করে পানির পাত্রে ১৫ থেকে এক মাস পর্যন্ত ভিজিয়ে রাখেন। সেই ভেজানো কাঠ চুলি্লর ওপর রাখা ডেকচিতে ৮ থেকে ১৫ দিন বা তারও বেশি সময় ধরে জ্বাল দেওয়া হয়। এ প্রক্রিয়ায় ডেকচি থেকে পানি এবং বাষ্পীয়ভাবে পাইপ দিয়ে একটি পাত্রে গিয়ে আতর জমা হয়। পাত্রে জমা হওয়া কষই হলো আতর। অন্যদিকে সিদ্ধ হওয়া কাঠের টুকরোও ফেলে দেওয়া হয় না। এটা ভূষি হিসেবে রপ্তানি হয়। মূলত আগরগাছের কিছুই বাদ যায় না।
জানা গেছে, ৪০ থেকে ৫০ কেজি ধারণক্ষমতার একটি ডেকচি থেকে পাঁচ থেকে সাত তোলা আতর পাওয়া যায়। ক্ষতের পরিমাণ বেশি হলে আতরের পরিমাণও বেশি হয়। প্রতি তোলা আতর সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা এবং প্রতি বস্তা ভূষি ৫০ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হয়ে থাকে। আনুমানিক হিসাবে, বর্তমানে এ এলাকায় বছরে ২০ থেকে ৩০ কোটি টাকার আগরপণ্য উৎপাদিত হচ্ছে।
উৎপাদক ও ব্যবসায়ীদের কথা : সুজানগরে আতরের ছোট-বড় প্রায় চার শ কারখানা রয়েছে। এ শিল্পে দেশে-বিদেশের ৫০ জন রপ্তানিকারক কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেন। বড়তল গ্রামের বাসিন্দা আগর উৎপাদনকারী ও বড়লেখা আতর ব্যবসায়ী বহুমুখী সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক রহিম বখত মুসা বলেন, 'এটা আমাদের পারিবারিক পেশা। বংশানুক্রমিকভাবে আমাদের ইউনিয়নের ৫০ ভাগ মানুষই কোনো না কোনোভাবে আতর ব্যবসায় যুক্ত।'
সুজানগর ইউনিয়নের শালদিঘার বেঙ্গল পারফিউমারির মালিক আবদুল কুদ্দুছ জানান, সৌদি আরব, ব্যাংকক, মালয়েশিয়া, কুয়েত ও দুবাইতে এ অঞ্চলের মানুষের আগর-আতর কারখানা রয়েছে। জাপানও এখন আতরের বড় ক্রেতা। তিনি জানান, এ অঞ্চলের আতর নিয়ে কোনো গবেষণা হয়নি। মান নিয়ন্ত্রণে এলাকায় একটি আগর-আতর গবেষণা ইনস্টিটিউট দরকার।
সমস্যা : ব্যবসায়ী আনসারুল হক জানান, আতর উৎপাদন ও ব্যবসা নিয়ে তাঁদের বিভিন্ন সময় নানা ঝামেলায় পড়তে হয়। অন্যান্য গাছের মতো আগরগাছ পরিবহনেও পাস লাগে। বন বিভাগের টিপি (ট্রানজিট পারমিট) বিধি-নিষেধের কারণে আগরপণ্য উৎপাদন, পরিবহন ও রপ্তানি ব্যাহত হচ্ছে। এই পাস সংগ্রহ সময়সাপেক্ষ ও জটিল। তিনি জানান, রপ্তানির ক্ষেত্রে আগরকেও সাইটিস (কনজারভেশন অব ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড অব এনডেঞ্জার স্পেসিস অব ওয়াইল্ড ফ্লোরা অ্যান্ড ফোনা) তালিকাভুক্ত উদ্ভিদ প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই তালিকাভুক্ত উদ্ভিদ বা তার অংশ থেকে সৃষ্ট পণ্য রপ্তানিতে প্রধান বন সংরক্ষকের কাছ থেকে সাইটিস ছাড়পত্রের প্রয়োজন হয়। এ ছাড়পত্র সময়মতো না পাওয়ায় ব্যবসায়ী ও কারিগরদের ক্ষতি হচ্ছে।
জানা গেছে, সাইটিস ছাড়পত্রের জটিলতার কারণে সরকারিভাবে আগর-আতর রপ্তানি হচ্ছে না। বিদেশ যাওয়ার সময় বোতল বা অন্য কোনো পাত্রে ঘোষণা না দিয়ে আতর নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
অন্যদিকে আগর-আতর একটি সম্ভাবনাময় কুটির শিল্প হলেও আগর-আতরকে এখনো শিল্প হিসেবে ঘোষণা করা হয়নি। এতে করে ব্যাংকঋণ এবং বিদ্যুৎ ও গ্যাসের ক্ষেত্রে উৎপাদনকারীরা শিল্প সুবিধা পাচ্ছেন না। ফলে এখনো আগর উৎপাদন ও ব্যবসা-বাণিজ্য চলছে ঐতিহ্যগতভাবে। আতরকে শিল্প হিসেবে ঘোষণার দাবি উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ীদের।
উৎপাদকরা জানান, বাণিজ্যিক হারে গ্যাস বিল বেশি হওয়ায় তারা কাঠ কম দিন জ্বাল দিচ্ছেন। এতে উৎপাদন কম হচ্ছে। সহজ শর্তে ঋণ বা বিনিয়োগের ব্যবস্থা এবং গাছ পরিবহন ও রপ্তানিপ্রক্রিয়া সহজ হলে এই আগর একটি অতি লাভজনক কৃষি শিল্প হিসেবে বিশ্ববাজার ধরে রাখতে সক্ষম হবে।
সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবুল বাশার মিয়া কালের কণ্ঠকে জানান, আগর বনায়ন প্রকল্পে সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে মৌলভীবাজারের বড়লেখা, জুড়ী ও কমলগঞ্জ; সিলেট সদর ও হবিগঞ্জের রাজকান্দি ও রঘুনাথ এলাকায় প্রায় এক হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে আগরগাছ রোপণ করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতাসহ সার্বিক সহযোগিতা পেলে আতর শিল্পে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে নতুন দ্বার উন্মোচন হবে।

No comments

Powered by Blogger.