ডিসিসির কার্যালয় বন্ধ দুর্ভোগে নগরবাসী by অমিতোষ পাল

মিরপুরের ১২৩/১ পূর্ব শেওড়াপাড়ার বাসিন্দা হাসর আলীর একটি নাগরিকত্ব সনদপত্র প্রয়োজন ব্যাংক হিসাব খোলার জন্য। গত বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার দিকে তিনি ১৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়ে গিয়ে দেখেন তা বন্ধ। খুঁজে খুঁজে সদ্য বিদায়ী কাউন্সিলর হাজি আবদুল কাদেরের বাড়িতে যান হাসর আলী। অনেক অনুরোধ করে তাঁকে অফিসে নিয়ে আসেন। পরে কাউন্সিলর হাজি আবদুল কাদের পেছনের তারিখে স্বাক্ষর করে হাসর আলীকে


একটি সনদপত্র দেন।\'মেয়রের সঙ্গে সঙ্গে কাউন্সিলরদেরও আর কোনো ক্ষমতা নেই। আইন অনুযায়ী আমরা এখন কাউকে সনদপত্র দিতে পারছি না। কিন্তু কেউ একান্ত অনুরোধ করলে প্রয়োজন বুঝে ২৯ বা ৩০ নভেম্বরের তারিখ বসিয়ে এটি দিয়ে দিচ্ছি', কালের কণ্ঠকে বলেন হাজি আবদুল কাদের।
হাজি আবদুল কাদের জানান, 'এক মহিলা এসেছিলেন বাচ্চার সনদ নিতে। সনদ ছাড়া স্কুলে ভর্তি পরীক্ষাই দেওয়া যাবে না। বাধ্য হয়ে ব্যাকডেট দিয়ে সনদ দিই।' তিনি কথায় কথায় বলেন, 'একজন কাউন্সিলরের কাছে মানুষের নানা ধরনের কাজ থাকে। ক্ষমতা না থাকায় এখন আর কাউকে সেবা দিতে পারছি না। আপনারা পত্রিকায় লিখলে জনগণের এ ভোগান্তির সমাধানের একটা পথ বের হতে পারে।'
ঢাকা সিটি করপোরেশনের (ডিসিসি) সচিব মো. শামসুজ্জামানের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল, ডিসিসি বিভাজনের পর নাগরিক সেবাদানের ক্ষেত্রে যে শূন্যতা সৃষ্টি হবে, তা সামাল দেওয়ার প্রস্তুতি তাঁদের নেই। তিনি এক প্রশ্নের জবাবে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'কাউন্সিলররা না থাকলে তাঁদের কাজগুলো কে করবে_এটা তো আমারও প্রশ্ন। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমরা এ ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা পাইনি। আপনি মনে করিয়ে দিয়ে ভালো করেছেন। দু-এক দিনের মধ্যেই মন্ত্রণালয়ে কথা বলব। কারণ জনগণকে তো কষ্টে ফেলানো যাবে না।'
কেবল সনদপত্রই নয়, জন্মনিবন্ধন সনদ, ওয়ারিশের সনদ, পাসপোর্টের ফরম, ছবি সত্যায়নসহ নগরবাসীকে নানা সমস্যায় যেতে হয় স্থানীয় জনপ্রতিনিধির কাছে। ৯০টি ওয়ার্ডই এখন কাউন্সিলরশূন্য। নগর ভবনে গিয়েও মানুষ সমাধান পাচ্ছে না। আর সাধারণ জনগণ তো প্রশাসকের কাছে যেতে পারছে না।
সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, প্রতিদিন অন্তত অর্ধশতাধিক ব্যক্তি একেকটি কাউন্সিলর কার্যালয়ে গিয়ে সেবা না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন। বিশেষ করে বিভিন্ন স্কুলে ভর্তির কার্যক্রম চলায় জন্মনিবন্ধন সনদ সংগ্রহ করতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলছেন অভিভাবকরা।
সেই সুযোগে কাউন্সিলর কার্যালয়গুলোতে নাগরিক সনদ ও জন্ম সনদ দেওয়ার নামে একটি চক্র বাণিজ্য শুরু করেছে। ৫০০ থেকে তিন হাজার টাকা করে নিয়ে দেওয়া হচ্ছে একটি সনদ।
বিলুপ্ত ডিসিসির ডজনখানেক কার্যালয়ে গত বৃহস্পতিবার ঘুরে ১৪ নম্বর ওয়ার্ড ছাড়া কোনোটিতেই কাউন্সিলরের দেখা পাওয়া যায়নি। সেবাগ্রহীতারা সেবা না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন কিংবা কার্যালয় ঘিরে গড়ে ওঠা চক্রের খপ্পরে পড়ছেন। অসাধু ব্যক্তিরা কাউন্সিলরদের স্বাক্ষর জাল করে তারাই সনদ দিয়ে দিচ্ছে। আবার কোনো কোনো কার্যালয়ের স্টাফরা কাউন্সিলরকে দিয়ে আগেই অনেক সনদ স্বাক্ষর করিয়ে রেখেছেন। সেগুলোতে নাম-ঠিকানা বসিয়ে নিজেরা আখের গোছাচ্ছেন।
গত বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১১টায় শাহবাগের পরীবাগে ৫৭ নম্বর ওয়ার্ড কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায় কয়েকজন লোক বসে আছেন। সেখানে ঢুকতেই মধ্যবয়সী একজন বলেন, 'কী লাগবে? নাগরিক সনদ বা জন্ম সনদ।' তাঁর কাছে পরিচয় জানতে চাইলে তিনি পরিচয় লুকান। একপর্যায়ে কেটে পড়েন। কার্যালয়ের সচিব সেকান্দার আলীকেও পাওয়া যায়নি। স্টাফ পরিচয় দিয়ে রিয়াজ নামের একজন বলেন, 'সচিব হয়তো নগর ভবনে গেছেন কোনো কাজে। আর ডিসিসি দুই ভাগ হওয়ার অনেক আগে থেকেই কার্যালয়ে আসা বন্ধ করে দিয়েছেন কাউন্সিলর।' এ ব্যাপারে কাউন্সিলর খাজা হাবিবের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাঁকে পাওয়া যায়নি।
অন্যদিকে মগবাজারের নয়াটোলায় ৫৫ নম্বর ওয়ার্ড কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, কার্যালয়ে কেউ নেই। অফিসের একজন কর্মী বলেন, 'কাউন্সিলর সাহেব এখানে আসা বন্ধ করে দিয়েছেন। আর সচিব সাহেব আজ আসেননি।' সচিব মো. সোলাইমানের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, 'আমি এখন অনেক দূরে আছি। আসতে দেরি হবে।' কিন্তু কখন পৌঁছাবেন তা তিনি বলতে পারছেন না।
অন্যদিকে সকাল সাড়ে ১০টায় উত্তরায় ১ নম্বর ওয়ার্ড কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, ৪ নম্বর সেক্টরের বাসিন্দা কলেজপড়ুয়া তানভীর ও সানোয়ার কাউন্সিলরের কাছে নাগরিকত্ব সনদ নিতে এসেছেন। ওয়ার্ড কার্যালয়ের সচিব নুরুল ইসলাম অপারগতা জানিয়ে বলেন, 'কাউন্সিলর সাহেবের মেয়াদ শেষ।' পীড়াপীড়ির একপর্যায়ে তাঁদের সাবেক কাউন্সিলরের বাসায় যাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। নুরুল ইসলাম বলেন, 'অনুনয়-বিনয় করলে কাউন্সিলর নাগরিকত্বের সনদ দিচ্ছেন। এ জন্যই তাঁদের কাউন্সিলরের বাসায় যেতে বলেছি।'
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিদায়ী কাউন্সিলর হযরত আলী বলেন, 'এলাকার লোকজন বাসায় এসে জ্বালাতন করছে। আমার ক্ষমতা যে শেষ হয়ে গেছে, এটা এলাকাবাসীকে বোঝাতে পারছি না। আর ক্ষমতা শেষ হলে তো আর সনদ দেওয়া যায় না।'
গত বৃহস্পতিবার সরেজমিন ৬০, ৬২ ও ৫২ নম্বর ওয়ার্ড কার্যালয় ঘুরে জানা গেছে, প্রতিদিন নানা প্রয়োজনে কাউন্সিলর কার্যালয়ে যাচ্ছে নগরবাসী। কাউন্সিলর অফিসের সচিবরা কোনো সমাধান দিতে পারছেন না। কেউ কেউ আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোতে গিয়ে আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তার কাছ থেকে সনদ নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। সেখান থেকেও সনদ না পেয়ে ফিরে যাচ্ছে লোকজন। নগর ভবনে গিয়েও তারা কোনো নির্দেশনা পাচ্ছে না।
এ ব্যাপারে অঞ্চল ৫-এর নির্বাহী কর্মকর্তা ফারুক আহমেদ বলেন, 'নাগরিকত্বের সনদের জন্য লোকজন ওয়ার্ড অফিসগুলোতে ভিড় করছে। কাউন্সিলর কার্যালয়ের সচিবরাও আমাদের কাছে সমাধান জানতে চাইছেন। কিন্তু আমরা সমাধান দিতে পারছি না। কারণ আমরা সে রকম কোনো নির্দেশনা এখনো পাইনি। আশা করছি, মন্ত্রণালয় শিগগিরই এ ব্যাপারে নির্দেশনা দেবে।'
গত বৃহস্পতিবার দুপুরে শহীদনগর লালবাগ থানাসংলগ্ন ৬০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ে গিয়েও কাউকে পাওয়া যায়নি। ফোনে চেষ্টা করেও কার্যালয়ের সচিবকে পাওয়া যায়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক লালবাগ থানার এক পুলিশ সদস্য বলেন, এ ওয়ার্ডের লোকজন খেয়াল-খুশিমতো আসা-যাওয়া করে। সকাল সাড়ে ১১টায় লালবাগ মাজারসংলগ্ন ৬২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ে গিয়েও সচিবকে পাওয়া যায়নি। ওই কার্যালয়ের কয়েকজন কর্মচারী বলেন, 'কাজকর্ম না থাকায় সচিব সাহেব দেরি করে অফিসে আসেন।'
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সুলতানুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, কাউন্সিলরদের দায়িত্ব পালন করবেন আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তারা। আগামী রবিবার এ ব্যাপারে একটি অফিস আদেশ জারি করার প্রস্তুতি চলছে। এ ছাড়া বিভক্তি হলে কিছু সমস্যা সৃষ্টি হবে_এটাই তো স্বাভাবিক নিয়ম। কিন্তু সবাইকে বলে দেওয়া হয়েছে, সব রকম নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
গত ২৯ নভেম্বর ডিসিসি ভাগে স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন সংশোধন বিল সংসদে পাস হয়। এর মধ্যে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে বিলটি আইনে পরিণত হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.