খালেদাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়-টিপাইমুখ ইস্যুতে কেন দিল্লির অঙ্গীকার আদায় করেননি

সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কেন ভারতের কাছ থেকে বাধ্যবাধকতাপূর্ণ অঙ্গীকার আদায় করেননি, তা ব্যাখ্যা করতে বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। গতকাল শুক্রবার রাত ৮টার পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বহিঃপ্রচার অনুবিভাগ থেকে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় পাঠানো 'পয়েন্টস অব টিপাইমুুখ' (টিপাইমুখ বাঁধসংক্রান্ত বিষয়াদি) শীর্ষক এক ব্যাখ্যায় এ আহ্বান জানানো হয়।


১০ অনুচ্ছেদের ওই ব্যাখ্যার শেষ দুটি অনুচ্ছেদে বিরোধী দল বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে টিপাইমুখ ইস্যুর অবস্থা ও উদ্যোগ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে।
নবম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'বিরোধীদলীয় নেত্রী ১৯৯২ ও ২০০৬ সালে দুই বার ভারত সফর করলেও ২৮ মে ১৯৯২ তারিখে ইস্যু করা যৌথ ইশতেহারে বা ২৩ মার্চ ২০০৬ তারিখে ইস্যু করা যৌথ সংবাদ বিবরণীর কোথাও টিপাইমুখ প্রকল্পের বিষয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগের কথা প্রতিফলিত হয়নি। এতে প্রতীয়মান হয়, যে ইস্যুটি বাংলাদেশের জন্য এতটা গুরুত্বপূর্ণ, বিরোধীদলীয় নেত্রীর দুই বার ভারত সফর সত্ত্বেও বাংলাদেশের উদ্বেগের বিষয়টি সে সময় আদৌ আলোচিত হয়নি।'
দশম ও শেষ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'বিরোধীদলীয় নেত্রীর নিজের ভারত সফরকালে টিপাইমুখ ইস্যুতে বাংলাদেশের উদ্বেগের বিষয়টি ভারতীয় নেতাদের কাছে ব্যক্ত করার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি তা একেবারেই উত্থাপন করেননি কেন এবং তাঁর মতে, টিপাইমুখ বাঁধের ফলে বাংলাদেশ যদি এতই ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তাহলে এটি নির্মাণ করা থেকে ভারত বিরত থাকবে_মর্মে ভারতের কাছ থেকে বাধ্যবাধকতাপূর্ণর্ একটি অঙ্গীকার তিনি সে সময় আদায় করেননি কেন_বিষয়গুলো অনুগ্রহপূর্বক একটু স্পষ্টভাবে তিনি ব্যাখ্যা করবেন কি?'
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যার অন্য আট অনুচ্ছেদে সরকারের উদ্যোগ ও ভারতের আশ্বাসের বিষয়টি স্থান পেয়েছে। প্রথম অনুচ্ছেদে বলা হয়, 'ভারতের মণিপুর রাজ্যে বরাক নদের ওপর প্রস্তাবিত টিপাইমুখ বাঁধ ইস্যুতে বর্তমান সরকারের অবস্থান/নীতি ছিল বরাবরই অত্যন্ত দায়িত্বশীল, সচেতন, সংবেদনশীল ও দ্ব্যর্থহীন। সরকার বাংলাদেশের স্বার্থ সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে সরকার প্রস্তাবিত এ প্রকল্পের সম্ভাব্য বিরূপ প্রভাবের বিষয়টি ভারত সরকারের কাছে বারবার উত্থাপন করে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে।'
দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, 'ইতিপূর্বে টিপাইমুখ বাঁধ এলাকা প্রত্যক্ষভাবে সরেজমিনে পরিদর্শনপূর্বক প্রকল্প-সংক্রান্ত সব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার উদ্দেশ্যে মাননীয় সংসদ সদস্য আবদুর রাজ্জাক এমপির নেতৃত্বে একটি সর্বদলীয় সংসদীয় প্রতিনিধিদল প্রেরণের উদ্যোগ গ্রহণ করে সরকার। প্রতিনিধিদলে আরো অন্তর্ভুক্ত ছিলেন পানি বিশেষজ্ঞবৃন্দ ও প্রযুক্তিবিদগণ। ভারতীয় কারিগরি বিশেজ্ঞগণ প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে পাওয়ার পয়েন্টে একটি বিস্তারিত ব্রিফিং উপস্থাপন করেন। টিপাইমুখ প্রকল্পের কোনো অংশেই নদীর পানি প্রত্যাহার বা স্বাভাবিক জলপ্রবাহ পরিবর্তন করা হবে না_উপস্থাপনায় এ বিষয়টিতে গুরুত্বসহকারে আলোকপাত করা হয়। ভারতীয় পক্ষ আরো উল্লেখ করে, কৃষিকাজে সেচের জন্য এ প্রকল্পে কোনো উপাংশ ব্যবহৃত হবে না; বরং এর একমাত্র লক্ষ্য জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ও যথাযথ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পানিপ্রবাহ নিশ্চিতকরণ।'
তৃতীয় অনুচ্ছেদে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, 'এ প্রকল্পে পানিপ্রবাহের দিক পরিবর্তন বা প্রত্যাহারসংক্রান্ত কোনো উপকরণ/উপাদান থাকছে না মর্মে ভারতীয় পক্ষ কর্তৃক একটি লিখিত নিশ্চয়তাপত্র ইস্যু করা হয়। এতদসত্ত্বেও, এ ইস্যুতে বাংলাদেশ সরকারের সৃদৃঢ় অবস্থান হলো : টিপাইমুখ বাঁধের প্রভাব ক্ষতিকরই হোক আর এটি বাংলাদেশের জন্য হিতকর সুফলই বয়ে আনুক, যেমনটি ভারতীয় পক্ষ বলে থাকে_সম্ভাব্য ফলাফল যা-ই হোক না কেন, এ প্রকল্পের বিষয়ে একটি ব্যাপকভিত্তিক ও বস্তুনিষ্ঠ সমীক্ষা পরিচালনা করা আবশ্যক।'
চতুর্থ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'প্রত্যাবর্তনের পর প্রতিনিধিদলটি জাতীয় সংসদে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন উপস্থাপন করে। বাংলাদেশের ওপর টিপাইমুখ প্রকল্পের সম্ভাব্য প্রভাব/প্রতিক্রিয়া নিরূপণের জন্য সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সুপারিশক্রমে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি এ বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছে।'
পঞ্চম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, '৭-১০ সেপ্টেম্বর ২০০৯ তারিখে ভারতে সরকারি সফরকালে মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী টিপাইমুখ ইস্যুটি ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে দৃঢ়তার সঙ্গে উত্থাপন করেন। সফর শেষে যৌথ সংবাদ বিবৃতিতে ব্যক্ত করা হয়েছে : প্রস্তাবিত টিপাইমুখ বাঁধ এলাকা পরিদর্শনকালে বাংলাদেশের সংসদীয় প্রতিনিধিদলকে উষ্ণ আতিথেয়তা ও সহযোগিতা প্রদানের জন্য ভারতীয় পক্ষকে ধন্যবাদ জানায় বাংলাদেশ পক্ষ। এ পরিপ্রেক্ষিতে, বাংলাদেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে_এমন কোনো পদক্ষেপ ভারত সরকার নেবে না মর্মে আশ্বাস পুনর্ব্যক্ত করে ভারতীয় পক্ষ।'
ষষ্ঠ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ২০১০-এর জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরকালেও বিষয়টি উত্থাপন করা হয়। সফরের পর ইস্যুকৃত যৌথ ইশতেহারে উল্লেখ করা হয় : 'টিপাইমুখ প্রকল্পের ফলে বাংলাদেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে_এমন কোনো পদক্ষেপ ভারত নেবে না মর্মে নিশ্চয়তা পুনর্ব্যক্ত করেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী।'
সপ্তম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'সাড়ে চার বছর বিরতির পর, দুই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় গত ১৭ মার্চ ২০১০-এ নতুন দিল্লিতে যৌথ নদী কমিশনের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বাংলাদেশ পক্ষ ভারতীয় পক্ষের কাছে টিপাইমুখ ইস্যুটি জোরদারভাবে পুনরায় উত্থাপন করে। বিষয়টি যৌথ নদী কমিশন কর্তৃক আলোচিত লিপিবদ্ধ বিবরণীতে (জবপড়ৎফ ড়ভ উরংপঁংংরড়হ) এভাবে ব্যক্ত করা হয় : 'স্বচ্ছতার স্বার্থে, টিপাইমুখ বাঁধ এলাকা পরিদর্শনের জন্য বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানায় ভারতীয় পক্ষ। পরিদর্শনকালে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের কাছে প্রকল্পসংক্রান্ত বিষয়াদি বিস্তারিতভাবে উপস্থাপন করা হয়। ভারতীয় পক্ষ পুনর্ব্যক্ত করে যে এ প্রকল্পে পানির গতিপ্রবাহ পরিবর্তনের কোনো বিষয় থাকবে না। প্রকল্পের একমাত্র লক্ষ্য হলো জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ। বন্যার প্রকোপ হ্রাস ও শুষ্ক মৌসুমে পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি পাবে বিধায়, এ প্রকল্পের মাধ্যমে উপরন্তু বাংলাদেশ উপকৃত হবে। বাংলাদেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে_এমন কোনো পদক্ষেপ এ প্রকল্পে নেওয়া হবে না বলে পুনরায় নিশ্চয়তা প্রদান করে ভারত সরকার।'
অষ্টম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'পরবর্তীতে, ৬-৭ সেপ্টম্বরে ২০১১ তারিখে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশে সফরকালে প্রকাশিত যৌথ বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে_টিপাইমুখ প্রকল্পে এমন কোনো পদক্ষেপ ভারত নেবে না মর্মে নিশ্চয়তা পুনর্ব্যক্ত করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী।'
উল্লেখ্য, গত মাসের মাঝামাঝি টিপাইমুখ প্রকল্প নিয়ে ভারতে বিনিয়োগ চুক্তির খবর গণমাধ্যমে ফাঁস হলে বাংলাদেশে তা ব্যাপক সমালোচিত হয়। বিভিন্ন মহলে অব্যাহত উদ্বেগের মুখে সরকার ওই চুক্তির ব্যাপারে দিল্লির কাছে ব্যাখ্যা চায়। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অর্থনৈতিকবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান ও আন্তর্জাতিকবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী গত ২ ডিসেম্বর দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন। ওই বৈঠকেও ভারতের পক্ষ থেকে টিপাইমুখ প্রকল্পের কারণে বাংলাদেশের ক্ষতি হবে না বলে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। দুই উপদেষ্টা সফর শেষে ঢাকায় ফিরে বলেছেন, টিপাইমুখ প্রকল্প ইস্যুতে তাঁরা আশ্বস্ত। ভারত যৌথ সমীক্ষা ও প্রতিনিধিদলের সফরকে স্বাগত জানিয়েছে। কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, ভারত বাংলাদেশি প্রতিনিধিদলকে সফরের জন্য স্বাগত জানানোর কথা আনুষ্ঠানিকভাবে জানালেও যৌথ সমীক্ষার বিষয়টিতে আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা বলেছে।

No comments

Powered by Blogger.