চরাচর-অন্ধজনে দেহ আলো

তিন দিন পর এইচএসসি পরীক্ষা। শিক্ষাজীবনের গুরুত্বপূর্ণ এই পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের ভয় ও আনন্দ মনে দোলা দেয়। কিন্তু আনন্দের চেয়ে শঙ্কা অনেক বেশি। এতটাই বেশি যে কান্নায় বুক ভেঙে যায়, কিন্তু চোখে জল আসে না। আর আসবেই বা কিভাবে? যার চোখ নেই, তার চোখে জল আসবে কোথা থেকে। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সাহিদা সুলতানার হৃদয়ের রক্তক্ষরণ ছড়িয়ে পড়ে তার পরিবারের অন্যদের হৃদয়ে। তাঁরা হন্যে হয়ে খোঁজেন একজন 'সহায়ক ব্যক্তি'।


যে সাহিদার পরীক্ষার হলে তার 'রাইটার' হিসেবে অংশগ্রহণ করবে। চেনা-অচেনা মানুষদের কাছে তাঁরা ছুটে বেড়ান। কিন্তু যারা 'সহায়ক' ব্যক্তি বা রাইটার হিসেবে সাহিদার পরীক্ষায় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবে, তাদেরও যে একই সময়ে স্কুলের টার্মিনাল পরীক্ষা। টার্মিনাল পরীক্ষা না দিলে ফাইনাল পরীক্ষায় পিছিয়ে পড়বে। তাই কোনো শিক্ষার্থী বা শিক্ষার্থীর অভিভাবক সাহিদার সাহায্যে এগিয়ে আসে না। অনিশ্চিত হয়ে পড়ে সাহিদার পরীক্ষায় অংশগ্রহণ। অসহায় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সাহিদার জীবনে অন্ধকার আরো ঘনীভূত হয়। এমন কঠিন সময়ে সাহিদার বোনের পরিচয় ঘটে সামিয়া নওশীন নামের নবম শ্রেণীর এক শিক্ষার্থীর মায়ের সঙ্গে। পুরো ঘটনা শুনে তিনি বিচলিত হয়ে পড়েন। একজন শিক্ষিকা ও একজন মা হিসেবে তিনি সাহিদার কষ্ট অনুভব করেন। কিন্তু সাহিদাকে সাহায্য করলে যে তাঁর মেয়ের টার্মিনাল পরীক্ষা দেওয়া হবে না। অবশেষে মহানুভবতার কাছে হার মানে সব শঙ্কার। একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীর সাহায্যে এগিয়ে আসা অত্যন্ত মহৎ ও মানবিক একটি কাজ_এ ভাবনায় নবম শ্রেণীর ছাত্রী সামিয়া সম্মত হয় সাহিদার 'সহায়ক ব্যক্তি' হিসেবে পরীক্ষা দিতে। ২০১১ সালে অনুষ্ঠিত এইচএসসি পরীক্ষায় সাহিদা সুলতানা গাজীপুর সরকারি মহিলা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। এবং যথারীতি ভালো ফলও করে। এখন সে স্থানীয় আজিমুদ্দিন কলেজে অনার্সে অধ্যয়নরত। যদিও তার খুব ইচ্ছে ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। কিন্তু দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের নানাবিধ সমস্যার কথা চিন্তা করে সে ভর্তি হয়েছে স্থানীয় কলেজে। এতেই সে আনন্দিত। তবুও শঙ্কা, পরবর্তী সময়ে আবার 'সহায়ক ব্যক্তির' কারণে তার পরীক্ষা দেওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়ে কি না। শুধু সাহিদার ক্ষেত্রেই এমনটি ঘটে না, বরং প্রতিটি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর জীবনে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। জাতিসংঘের হিসাব অনুসারে, দেশের প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে প্রতিবন্ধী। এর মধ্যে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীর সংখ্যা কত, তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। দেশের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের শিক্ষার ব্যাপারে কার্যক্রম পরিচালনা করে এমন একটি প্রতিষ্ঠানের নাম এবিসি (অ্যাসিস্ট্যান্স ফর ব্লাইন্ড চিলড্রেন)। নরওয়ের আর্থিক সহায়তায় পরিচালিত এ প্রতিষ্ঠানে মাত্র ১৫ জন মেয়ে ও ৬০ জন ছেলে ব্রেইল পদ্ধতিতে লেখাপড়া করার সুযোগ পায়। ব্রেইল পদ্ধতিতে লেখাপড়া অত্যন্ত ব্যয়বহুল, তদুপরি তাদের থাকা-খাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে সংস্থাটিকে প্রায়ই হিমশিম খেতে হয়। এ ছাড়া সরকারিভাবে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বেশ কিছু শিক্ষাকেন্দ্র থাকলেও সেগুলোর অবস্থা তথৈবচ। পাহাড় সমান প্রতিবন্ধকতা জয় করে যেসব দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী এসএসসি, এইচএসসি বা উচ্চশিক্ষাক্ষেত্রে প্রবেশ করে, জীবনসংগ্রামে তারা মহৎ মানুষ। এতটা সংগ্রাম করে যারা শিক্ষালাভ করতে চায়, শুধু 'সহায়ক ব্যক্তির' অভাবে তাদের স্বপ্ন যেন ভেঙে না যায়, এ ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সঠিক ও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। একই সঙ্গে, মানবিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত হয়ে সামিয়া নওশীনরা এই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের শিক্ষা গ্রহণে এগিয়ে আসবে_এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
সাইফুল ইসলাম খান

No comments

Powered by Blogger.