ফ্লাইওভার :বিশাল কর্মযজ্ঞ by রাশেদ মেহেদী

দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে রাজধানীর তিনটি ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজ। রাজধানীর যানজট নিরসনের জন্য গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী এলাকায় মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার, কুড়িল-বিশ্বরোড এলাকায় কুড়িল ফ্লাইওভার, সেনানিবাসের স্টাফ রোড এলাকায় মিরপুর-এয়ারপোর্ট রোড ফ্লাইওভার এবং বনানী রেলক্রসিং ওভারপাস নির্মাণ প্রকল্পের কাজ চলছে একই সঙ্গে। এরই মধ্যে যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান এলাকায় মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের ৬০ শতাংশ কাজ


শেষ হয়েছে। খিলক্ষেত এলাকায় কুড়িল ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজের অগ্রগতিও ভালো। বনানী-মিরপুর ফ্লাইওভার এবং বনানী রেলক্রসিং ওভারপাস নির্মাণ কাজ কিছুটা পিছিয়ে আছে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা এ তথ্য দিয়েছেন। যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান ফ্লাইওভারের কাজ সবচেয়ে আগে শেষ হতে পারে।
মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার : রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থেকে গুলিস্তানের গোলাপ শাহ মাজার হয়ে পলাশী পর্যন্ত প্রায় ১০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের ৬০ শতাংশ নির্মাণ কাজ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে ১ হাজার ২৫০টি পাইল এবং ১২০টি পাইল ক্যাপ। এরই মধ্যে গার্ডারগুলো পিলারের ওপর উঠতে শুরু করেছে। সরেজমিন পরিদর্শনে গেলে নির্মাণ সংশ্লিষ্টরা জানান, বিভিন্ন সেবা সংস্থা যেমন তিতাস গ্যাস, ডিপিডিসি, ঢাকা ওয়াসা এবং বিটিটিবির ভূগর্ভস্থ লাইনগুলো দ্রুত স্থানান্তর হলে কাজে নতুন গতি আসবে। ফ্লাইওভার নির্মাণ প্রকল্প এলাকায় বিভিন্ন সেবা সংস্থার ভূগর্ভস্থ স্থাপনা সংক্রান্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ফ্লাইওভার নির্মাণ এলাকায় ঢাকা ওয়াসার ২৫ থেকে ১ হাজার ২০০ মিলিমিটার ব্যাসের আট ধরনের পানি সরবরাহ লাইন, বিভিন্ন সাইজের স্যুয়ারেজ লাইন, ডিপিডিসির ১১, ৩৩ ও ১৩২ কেভিএ ভূগর্ভস্থ লাইন এবং ওভারহেড ৪৪২টি পোল (কেবলসহ) এবং তিতাস গ্যাসের ৫০ মিলিমিটার পর্যন্ত চার ধরনের ভূগর্ভস্থ লাইন রয়েছে। ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজ চলাকালে ৭১টির মধ্যে ৬২টি পিলার অর্থাৎ ৮৭ শতাংশ পিলার ইউটিলিটির

বিভিন্ন লাইনের কারণে প্রভাবিত হয়েছে। নির্মাণে ব্যবহৃত পাইলিং রিগ, ক্রেনসহ ভারী যন্ত্রপাতি ব্যবহারের সময় বড় দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য ওভারহেড বৈদ্যুতিক কেবল এবং টেলিফোন পোল ও কেবল স্থানান্তর খুবই জরুরি। ডিসিসি সূত্র জানায়, এসব ভূগর্ভস্থ লাইন সরানোর কাজে কী পরিমাণ অর্থ প্রকৃত অর্থে প্রয়োজন তা নির্ধারণ করা নিয়ে জটিলতা চলছে। ব্যয়ের পরিমাণ নির্ধারণ না হওয়ায় স্থানান্তরের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থও পাওয়া যাচ্ছে না। সেবা সংস্থার লাইনগুলো না সরানোর কারণে ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজের প্রতিটি অংশে দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য অনেক বেশি সময় নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে বলেও ডিসিসির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এর আগে রাজধানীর মহাখালী ফ্লাইওভার নির্মাণসহ বিভিন্ন স্থানে ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণেও বিভিন্ন সেবা সংস্থার ভূগর্ভস্থ লাইন স্থানান্তর করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে তথ্য দেওয়া হয়।
সম্প্রতি ১৬৮ উত্তর যাত্রাবাড়ীতে মূল নকশা অনুযায়ী ফ্লাইওভার নির্মাণের জন্য অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে গেলে বাধার মুখে পড়েন ডিসিসি কর্মকর্তারা। উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ থাকায় এখন পর্যন্ত এ অংশের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ সম্ভব হয়নি। এখানে সরকারি জমি দখল করে প্রায় ৪৪টি দোকানঘর নির্মাণ করে ভাড়া দিয়েছেন প্রভাবশালীরা। ডিসিসির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট খলিল আহমেদ সাংবাদিকদের জানান, এ জায়গাটি দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ দখলে রয়েছে। প্রায় ৩৮ শতাংশ এ জায়গা থেকে অবৈধ দোকান উচ্ছেদ না করা হলে ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজ ব্যাহত হবে। ফ্লাইওভার নির্মাণের জন্য এ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের বিকল্প নেই বলে তিনি জানান।
প্রকল্প পরিচালক আশিকুর রহমান জানান, ২০১২ সালের মধ্যে শেষ করার লক্ষ্য নিয়েই প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলেছে। নির্ধারিত সময়ের আগেই নির্মাণ কাজ শেষ হবে বলে তারা আশাবাদী। সেবা খাতের ভূগর্ভস্থ লাইন স্থানান্তর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তারা আশা করছেন রাজধানীর দক্ষিণাংশে যানজট নিরসনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং দেশের বৃহত্তম এ ফ্লাইওভার নির্মাণে সবাই সহযোগিতা করবেন। তিনি জানান, জনভোগান্তি লাঘবের জন্য এ ফ্লাইওভারের উপরিভাগের বক্স গার্ডারগুলো ধূপখোলা মাঠে নির্মাণ করে রাতে এগুলো ফ্লাইওভারের মূল কাঠামোয় সর্বাধুনিক ও স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে সংযুক্ত করা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ওরিয়ন গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সালমান ওবায়দুল করিম সমকালকে জানান, নির্ধারিত সময়ের আগেই ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজ শেষ করার ব্যাপারে তারা আশাবাদী। এ জন্য সর্বাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজ দ্রুত এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। 'পিপিপি' ভিত্তিতে নির্মিত এ ফ্লাইওভার নির্মাণে পুরো অর্থের জোগান দিচ্ছে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ওরিয়ন গ্রুপ। প্রথমে ৭ দশমিক ৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের জন্য ৬৭০ কোটি টাকা ব্যয় করা হলেও বর্তমানে এর দৈর্ঘ্য ১০ কিলোমিটার বাড়ানোর পর ব্যয় দাঁড়ায় প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে নির্মাণ কাজের দায়িত্ব পালন করছে ভারতের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান 'সিমপ্রেক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার'।
কুড়িল ফ্লাইওভার : রাজউকের নতুন স্যাটেলাইট শহর পূর্বাচলে যাওয়ার নতুন ৩০০ ফুট রাস্তাকে এয়ারপোর্ট রোড এবং প্রগতি সরণিতে সংযুক্ত করে রাজধানীর কুড়িল-বিশ্বরোড এলাকায় নির্মিত হচ্ছে কুড়িল ফ্লাইওভার। সরেজমিন দেখা যায়, এরই মধ্যে এ ফ্লাইওভারের তিনদিকে সড়কের ওপর গার্ডার উঠে গেছে। তিনটি সংযোগ সড়কেই পিলারগুলোর নির্মাণ কাজ শেষ। এখন চলছে এয়ারপোর্ট রোড, রেললাইন এবং প্রগতি সরণি যাওয়ার মধ্যভাগে পিলার ও গার্ডার নির্মাণের কাজ। ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজ চলার কারণে তিন পাশেই মূল সড়কের বেশ কিছু অংশ টিন দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। এতে যানবাহন চলাচলে বড় ধরনের সমস্যা হচ্ছে না। কুড়িল রেলক্রসিংয়ের উল্টোদিকে নির্মাণাধীন কিছু অংশ টিন দিয়ে ঘেরা নেই। সেখানে নির্মাণাধীন অংশের নিচেই ঝুঁকি নিয়ে বাসের জন্য যাত্রীরা দাঁড়িয়ে থাকেন। যাত্রীদের অভিযোগ, ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজ চলায় বিশ্বরোড স্টপেজে যাত্রীবাহী বাসগুলোর বেশিরভাগই দাঁড়াতে চায় না।
নির্মাণ কাজের অগ্রগতির ব্যাপারে নির্মাণ প্রতিষ্ঠান প্রজেক্ট বিল্ডার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী আমিনুল ইসলাম সমকালকে বলেন, এরই মধ্যে পুরো প্রকল্পের ৭০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। তার বিশ্বাস নির্ধারিত সময়ে ফ্লাইওভারের কাজ শেষ হবে।
৩ দশমিক ১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ ফ্লাইওভার নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ৩০৬ কোটি টাকা। প্রকল্প তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে আছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। ২০১০ সালের জুনে এ ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ফ্লাইওভারটি একই সঙ্গে এয়ারপোর্ট রোড, প্রগতি সরণি এবং পূর্বাচল নতুন সড়কের সঙ্গে চলাচলের সুবিধা রেখে নির্মিত হচ্ছে। ফ্লাইওভারের নিচেও তিনদিকে সড়ক নেটওয়ার্ক তৈরি হচ্ছে। ফলে ফ্লাইওভারের পাশাপাশি এর নিচ দিয়েও যানবাহন চলাচল মসৃণ হবে।
মিরপুর-এয়ারপোর্ট রোড ফ্লাইওভার : মিরপুরের মাটিকাটা থেকে সেনানিবাস হয়ে এয়ারপোর্ট রোড পর্যন্ত ১ দশমিক ৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ফ্লাইওভার এবং স্টাফ রোডে বনানী রেলক্রসিং ওভারপাস নির্মাণ প্রকল্পের প্রায় ৩৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। সরেজমিন দেখা যায়, পুরোদমে কাজ চলছে। এরই মধ্যে পাইল ও পাইল ক্যাপ নির্মাণ শেষে গার্ডার উঠতে শুরু করেছে। পাশাপাশি বনানী রেলক্রসিং ওভারপাস নির্মাণের জন্য রেললাইনের দু'পাশের রাস্তায় পিলার উঠছে। অত্যাধুনিক রিগসহ শতাধিক শ্রমিক কাজ করছেন। ফ্লাইওভার এবং ওভারপাস নির্মাণের স্বার্থে মূল সড়কের বাইরে দু'পাশ দিয়ে বিকল্প সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। এর ফলে এ এলাকায় মাঝে মধ্যেই ব্যাপক যানজট হচ্ছে।
যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীন এ প্রকল্পটির সার্বিক নির্মাণ কাজ তত্ত্বাবধান করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর স্পেশাল ওয়ার্কস অর্গানাইজেশনের ১৬ ইঞ্জিনিয়ার্স কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়ন। নির্মাণ কাজের দায়িত্বে রয়েছে নির্মাণ প্রতিষ্ঠান আবদুল মোনেম লিমিটেড ও মীর আক্তার লিমিটেড। প্রকল্প পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবু সাঈদ মোঃ মাসুদ সমকালকে জানান, 'এরই মধ্যে ৩৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। আমরা আশাবাদী, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে।'

No comments

Powered by Blogger.