শহর-গ্রামে বৈষম্য by বদরুদ্দোজা সুমন

স্বাস্থ্যসেবা খাতে শহর ও গ্রামে ব্যাপক বৈষম্য এবং অসমতার কারণে দরিদ্র মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বছরের পর বছর এ বৈষম্য চলছে সারাদেশে। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, প্রায় এক যুগ ধরে ঢাকা বিভাগে সর্বোচ্চ এবং বরিশাল বিভাগে সর্বনিম্ন বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। অন্যান্য বিভাগেও স্বাস্থ্যের উন্নয়নে প্রদত্ত বরাদ্দ ঢাকার তুলনায় অনেক কম। দেশের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ শহর চট্টগ্রামে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ঢাকার অর্ধেক।


অর্থ বরাদ্দ ও বণ্টন, অবকাঠামো নির্মাণ এবং সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে চলমান বৈষম্য ও অসমতা কাটানোর উদ্যোগ নেই। বিশেষজ্ঞদের মতে, এভাবে চলতে থাকলে গ্রামীণ জনস্বাস্থ্য সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব হবে না।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, সম্পদ বণ্টনে ভৌগোলিক বৈষম্য বিরাজমান। নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদীসহ দেশের আরও কয়েকটি জেলায় সরকারি খাতে একাধিক স্বাস্থ্য স্থাপনা গড়ে উঠেছে। অন্যদিকে পার্বত্য তিন জেলায় ১০০ শয্যার জেলা সদর হাসপাতাল ছাড়া সরকারিভাবে অন্য কোনো স্বাস্থ্য স্থাপনা নেই। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ, বিভিন্ন সরকারের আমলে শীর্ষ পর্যায়ের নীতিনির্ধারকরা সংকীর্ণতার ঊধর্ে্ব উঠতে পারেননি। তারা সারাদেশের কথা না ভেবে শুধু নিজেদের সংসদীয় এলাকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নে কাজ করার কারণেই বৈষম্য ও অসমতা বেড়েছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত 'বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টসের (বিএনএইচএ)' সর্বশেষ প্রতিবেদনে (২০১০ সাল) বিভিন্ন বিভাগে
স্বাস্থ্য বাজেট প্রদান, মাথাপিছু ব্যয় বরাদ্দ ও কর্মসূচি বাস্তবায়নে বিস্তর পার্থক্যের চিত্র ফুটে উঠেছে। ১৯৯৭ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত ১০ বছরের স্বাস্থ্য বাজেট ও বরাদ্দের তথ্য-উপাত্ত সেখানে উপস্থাপন করা হয়।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০০৭ সালে ঢাকা বিভাগে মোট স্বাস্থ্য বাজেটের ৩৩ শতাংশ ব্যয় বরাদ্দের বিপরীতে বরিশালের বরাদ্দ ছিল মাত্র ৫ শতাংশ। চট্টগ্রামে ১৭, রাজশাহীতে ১৬, খুলনায় ৯ এবং সিলেটে ৬ শতাংশ অর্থ ব্যয় করা হয়। অবশিষ্ট ১৪ শতাংশ অর্থ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদফতর কেন্দ্রীয়ভাবে ব্যয় করেছে। তথ্য-উপাত্ত বলছে, ১০ বছর আগেও
(১৯৯৭ সালে) বরিশাল বিভাগে স্বাস্থ্য বরাদ্দ ছিল সবচেয়ে কম। ঢাকায় সবসময়ই বেশি ছিল। ওই বছর ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের পার্থক্য ছিল ৩ শতাংশ। এখন পার্থক্য দ্বিগুণ হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক পপুলেশন কাউন্সিলের এদেশীয় প্রতিনিধি ড. ওবায়দুর রব সমকালকে বলেন, স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ প্রদানে বিভাগভিত্তিক পরিকল্পনার অভাব রয়েছে। স্বাস্থ্য অবকাঠামো তৈরি ও জনবল প্রেরণে বরিশাল, খুলনা ও সিলেট বিভাগ কখনও গুরুত্ব পায়নি। বিশেষায়িত হাসপাতালসহ প্রায় সব ধরনের স্বাস্থ্য স্থাপনা ও জনবল ঢাকায় কেন্দ্রীভূত করার আত্মঘাতী মানসিকতা বৈষম্য ও অসমতা বাড়িয়ে তুলছে।
বিএনএইচএর মতে, ১৯৯৭ সালে ঢাকার স্বাস্থ্য ব্যয় ছিল ২২ শতাংশ। ১০ বছরে ১১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে এখন তা ৩৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ওই বছর চট্টগ্রামের বরাদ্দ ছিল ১৯ শতাংশ। এখন অবিশ্বাস্যভাবে ১ শতাংশ কমেছে। অন্যান্য বিভাগের উপাত্তে দেখা যায়, খুলনা, সিলেট ও বরিশাল_ এ তিন বিভাগের প্রতিটিতে ১০ বছরে বরাদ্দ বেড়েছে মাত্র ১ শতাংশ হারে। রাজশাহী বিভাগের বরাদ্দ বেড়েছে ২ শতাংশ।
মাথাপিছু বরাদ্দে ঢাকা ও বরিশালে অসমতা : সরকারের সর্বশেষ হিসাব বলছে, বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে মাথাপিছু বার্ষিক ব্যয় ১ হাজার ১১৮ টাকা। ২০০৭ সালে ঢাকা বিভাগে স্বাস্থ্য খাতে মাথাপিছু ব্যয় ছিল সর্বোচ্চ ১ হাজার ৩৩৭ টাকা। অন্যদিকে বরিশালে ছিল মাত্র ৪৪৬ টাকা। এটি জাতীয়ভাবে মাথাপিছু ব্যয়ের এক-তৃতীয়াংশ। বিএনএইচএ তাদের প্রতিবেদনের প্রায় পুরোটাতেই বরিশাল বিভাগকে সবচেয়ে বঞ্চিত হিসেবে উল্লেখ করেছে। মাথাপিছু ব্যয়ের ক্ষেত্রে চট্টগ্রামে ১ হাজার ৩৮, রাজশাহীতে ৭৬০, খুলনায় ৮৫১ এবং সিলেটে ১ হাজার ৪২ টাকা হারে বরাদ্দ হয়েছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দের ক্ষেত্রেও বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরেছে বিএনএইচএ। প্রসঙ্গত, স্বাস্থ্য ব্যয়ের বৃহৎ অংশই মানুষ নিজের পকেট থেকে ব্যয় করে। ২০০৭ সালে মন্ত্রণালয় মাথাপিছু সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ দিয়েছে খুলনা বিভাগে, ১৬৪ টাকা। এরপরই রাজশাহী বিভাগে মাথাপিছু ১৬১ টাকা। সবচেয়ে কম পেয়েছে যথারীতি বরিশাল বিভাগ, ৮৮ টাকা।
মোট স্বাস্থ্য বরাদ্দে ভৌগোলিক বৈষম্য : স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের সর্বশেষ হিসাবমতে, ঢাকা বিভাগে ২০০৭ সালে মোট স্বাস্থ্য ব্যয় ছিল ৫৪ হাজার ৩৬৫ মিলিয়ন টাকা। চট্টগ্রামে প্রায় অর্ধেক, ২৭ হাজার ৫৪০ মিলিয়ন টাকা ব্যয় করা হয়। সর্বনিম্ন ব্যয় হয়েছে বরিশালে, ৮ হাজার ৪১৩ মিলিয়ন টাকা। এখানেও ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীর তুলনায় অন্য তিন বিভাগ অনেক পিছিয়ে। তথ্য-উপাত্ত বলছে, ঢাকা বিভাগে ১০ বছরে স্বাস্থ্য খাতে মোট বরাদ্দ বেড়েছে ১২ শতাংশ। খুলনা, সিলেট ও বরিশালে একই সময়ে বেড়েছে মাত্র ১ শতাংশ।
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ অবহেলার শিকার : পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের কার্যক্রম মাঠপর্যায়ে গতিহীন। এ খাতে অর্থ বরাদ্দ ক্রমেই কমেছে। অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলেন, মন্ত্রণালয়ের ওপর স্বাস্থ্য অধিদফতরের দাপটে পরিবার পরিকল্পনা অবহেলিত। চলতি অর্থবছরে প্রচার ও চাহিদা সৃষ্টির দায়িত্বে নিয়োজিত অধিদফতরের আইইএম ইউনিট মাত্র ১৮ কোটি টাকা পেয়েছে। বিএনএইচএ প্রতিবেদনে বলা হয়, মোট স্বাস্থ্য বাজেটের যে অংশটুকু সচেতনতা সৃষ্টিতে ব্যয় হয় তার মধ্যে ১৯৯৭ সালে জন্মনিয়ন্ত্রণ খাতে ব্যয় হয়েছে ৫ হাজার ১৮৭ মিলিয়ন টাকা, যা বরাদ্দের ৬৯ দশমিক ৭ শতাংশ। ২০০১ সালে এ হার ৬২, ২০০৪ সালে ৫৪ এবং ২০০৭ সালে ৪০ শতাংশে নামানো হয়েছে। অন্যদিকে মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ব্যয় পর্যায়ক্রমে বাড়ানোয় এ খাতে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে পুরস্কৃত হয়েছে। পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের মহাপরিচালক এমএম নিয়াজ উদ্দিন বলেন, আমরা গা ঝাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি।
বেসরকারি বিনিয়োগ ঢাকামুখী : সরকারি বিনিয়োগের মতোই বেসরকারি বিনিয়োগের প্রায় পুরোটাই ঢাকায় হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ বুলেটিন ২০১০-এর মতে, ১৯৯৭ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়ের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৬৪, ৬৬, ৬৯, ৭০, ৭২ এবং ৭৪ শতাংশ। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, জনসাধারণের বৃহত্তর অংশ বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার ওপর নির্ভরশীল। বিএনএইচএর প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, ২০০৭ সালে স্বাস্থ্য খাতের মোট ব্যয়ের ২৫ দশমিক ৮ শতাংশ সরকারি এবং অবশিষ্ট প্রায় ৭৫ শতাংশ বেসরকারি খাত থেকে করা হয়েছে। দেশের বড় করপোরেট হাসপাতালগুলো সবই ঢাকায়। এ কারণে অধিকাংশ জটিল চিকিৎসায় মানুষকে ঢাকায় ছুটতে হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের সভাপতি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক রাশিদ-ই-মাহবুব সমকালকে বলেন, গ্রামীণ সেবাকে জোরদার না করলে এ অবস্থার পরিবর্তন হবে না। কমিউনিটি ক্লিনিক চালু করাসহ সরকার কিছু পদক্ষেপ নিলেও সামগ্রিক বৈষম্য কমাতে আরও অনেক কিছু করার আছে।
অভিযোগ রয়েছে, স্বাস্থ্য স্থাপনা তৈরিতে নীতিনির্ধারকরা নিজ নিজ এলাকাকেই অগ্রাধিকার দেন। রাজনৈতিক বিবেচনাও এ ক্ষেত্রে কাজ করে। এসব কারণে বৈষম্য বেড়েছে। যেমন নরসিংদীতে ১০০ ও ৫০ শয্যার দুটি হাসপাতাল এবং নারায়ণগঞ্জে ২০০ ও ১০০ শয্যার দুটি হাসপাতাল রয়েছে। অন্য অনেক জেলায় সেটা হয়নি। সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কক্সবাজার ও নোয়াখালীতে দুটি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল চালু করা হয়। এখন দুটি কলেজেরই দুরবস্থা। সূত্র বলছে, ওই সময়ে প্রভাবশালীরা এ দুটি কলেজ অনুমোদন করিয়ে নিয়েছিলেন।

No comments

Powered by Blogger.