রাজনীতির মহীরুহ by এমআর মাহবুব

পমহাদেশের প্রখ্যাত রাজনীতিক, দার্শনিক ও ভাষাসংগ্রামী আবুল হাশিম ১৯০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার কাশিয়াড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মৌলভী আবুল কাশেম ছিলেন বঙ্গীয় প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচিত সদস্য। মায়ের নাম মোকাররমা খাতুন। আবুল হাশিম ১৯২৩ সালে ম্যাট্রিক, ১৯২৫ সালে বর্ধমান রাজ কলেজ থেকে আইএ, ১৯২৮ সালে একই কলেজ থেকে বিএ এবং ১৯৩২ সালে কলকাতা


বিশ্ববিদ্যালয়ের ল' কলেজ থেকে আইনশাস্ত্রে ডিগ্রি লাভ করেন। পরে আইন পেশায় নিযুক্ত হন। ১৯৩৬ সালে আইন পেশা থেকে অবসর নিয়ে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন এবং ১৯৩৭ সালে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য ও বর্ধমান জেলা মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৩৯ সালে পুনরায় বর্ধমান জেলা মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগের সর্বভারতীয় সম্মেলনে যোগদান করেন। ১৯৪৯ সালে তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য, ১৯৪৩ সালের ৭ নভেম্বর বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন এবং ১৯৪৭ সালে আবুল হাশিম শরৎচন্দ্র বসু, কিরণ শংকর রায় ও সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে স্বাধীন বাংলা গঠনের প্রয়াস চালান। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হওয়ার পর তিনি কলকাতায় অবস্থান করেন এবং পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় বিরোধী দলের নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫০ সালের এপ্রিলে তিনি ঢাকায় আসেন। ১৯৬০ সালে ইসলামিক একাডেমীর প্রথম পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬২ সালে পাকিস্তান ইসলামিক আইডিওলজি কাউন্সিলের সদস্য মনোনীত হন। ১৯৬৭ সালে তৎকালীন সরকার কর্তৃক রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ করার বিরুদ্ধে আন্দোলনের পূর্বভাগে তিনি অংশ নেন। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে তিনি ঢাকায় অবস্থান করেন। সে সময় সামরিক সরকার শত চেষ্টা করেও তার কাছ থেকে কোনো বিবৃতিতে স্বাক্ষর গ্রহণ করাতে পারেনি। তিনি তখন রেডিও টেলিভিশনের ইসলাম ধর্মবিষয়ক অনুষ্ঠান বয়কট করেন।
আবুল হাশিম বাঙালি জাতির অহঙ্কার। জ্ঞানে, প্রত্যয়ে, পাণ্ডিত্যে, মেধা ও মননে তিনি ছিলেন সমকালীন সমাজের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মানুষ। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে আবুল হাশিমের অবদান খুবই স্মরণীয়। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার লিখিত প্রস্তাব পাওয়া যায় ১৯৪৬ সালে প্রণীত মুসলিম লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিম কর্তৃক পেশকৃত খসড়া ম্যানিফেস্টোতে। সেখানে তিনি বাংলাকে পূর্ব বাংলার রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেন।
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের উত্তাল সময়ে তিনি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রামে পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন (৩১ জানুয়ারি, ১৯৫২) রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আহূত হরতাল কর্মসূচির ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সরকার ঘোষিত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ হবে কি-না সে ব্যাপারে ৯৪নং নবাবপুর রোডে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের যে বৈঠক হয় তাতে তিনি সভাপতিত্ব করেন। ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি রক্তাক্ত ঘটনার পর পরবর্তী করণীয় বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে সংগ্রাম পরিষদের যে বৈঠক হয় তাতে তিনি সভাপতিত্ব করেন। ১৯৫২ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের কারণে তিনি গ্রেফতার হন এবং এক বছর পর মুক্তি লাভ করেন। ভাষা আন্দোলনের চেতনায় যুক্তফ্রন্ট গঠন করে মুসলিম লীগের পতন ঘটানোর জন্য তিনিই প্রথম আহ্বান জানান এবং তা বাস্তবায়নের নানা চেষ্টার পর যুক্তফ্রন্ট গঠনের পথ প্রশস্ত হয়। তিনি পরবর্তীকালে ভাষা আন্দোলনের চেতনা বাস্তবায়নে নানা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেন। ১৯৭৪ সালের ৫ অক্টোবর তিনি মারা যান।
 

No comments

Powered by Blogger.