চট্টগ্রামে বাড়িভাড়া নিয়ে নৈরাজ্য-আন্দোলনে ২০ হাজার শ্রমিক সাত ঘণ্টা অবরুদ্ধ ইপিজেড

ফায় দফায় অস্বাভাবিক হারে বাড়িভাড়া বাড়ানোর প্রতিবাদে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা ইপিজেড এলাকায় সড়ক অবরোধ করে ২০ হাজার শ্রমিক। শ্রমিক-জনতার ব্যানারে গতকাল শুক্রবার দুপুর আড়াইটায় এ অবরোধ শুরু হয়। ফলে বন্দর থেকে সিমেন্ট ক্রসিং পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার সড়কে হাজারো গাড়ি আটকা পড়ে এবং যাত্রীরা অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হয়। সন্ধ্যায় এ প্রতিবেদন লেখার সময় পুলিশ-শ্রমিক উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে মুখোমুখি অবস্থানে ছিল।


বিক্ষোভকারী শ্রমিকদের ভাষ্য, পুলিশ লেবার কলোনি মাঠে তাদের সমাবেশ করতে দেয়নি। তাই তারা সড়ক অবরোধ করতে বাধ্য হয়ে। অবশ্য রাত সোয়া ৯টায় অবরোধ প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। অবসান হয় সাত ঘণ্টার অচলাবস্থার। এরপর যানবাহন চলাচলও ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসে।
বন্দর থানার ওসি নূরুল আবছার ভুঁইয়া বলেন, অস্বাভাবিক হারে বাড়িভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে শ্রমিকরা সমাবেশের ডাক দিলেও কোনো সংগঠন বা কোনো নেতা লেবার কলোনি মাঠে সমাবেশ করার জন্য অনুমতি চেয়ে আবেদন করেননি। এই কারণে ওই মাঠে সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হয়নি। বন্দর থানার ডিউটি অফিসার এএসআই আরিফুর রহমান বলেন, মাঠে সমাবেশ করতে না পেরে কিছু শ্রমিক সড়কের পাশে সমাবেশ করে। এ কারণে সড়কে যানজটের সৃষ্টি হয়।
সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, অনেক দলে বিভক্ত হয়ে বিচ্ছিন্নভাবে জটলা তৈরি করে শ্রমিকরা নিজেদের ইচ্ছামতো বক্তব্য দিচ্ছে। নেতৃত্বে কেউ না থাকায় যে যার মতো কর্মসূচি ঘোষণা করছে। কেউ বলছে, দাবি মানা না হলে কাল থেকে ইপিজেড বন্ধ করে দেওয়া হবে। কেউ আবার বলছে, এ আন্দোলন বাড়িওয়ালাদের বিরুদ্ধে। তাই ইপিজেড স্বাভাবিক থাকবে।
দুপুর থেকেই অবরোধ চলে। এর পরও পুলিশ নির্বিকার কেন, জানতে চাইলে শিল্প পুলিশের সহকারী পরিচালক রেজাউল মাসুদ সন্ধ্যায় কালের কণ্ঠকে বলেন, শ্রমিকদের জোর করে সড়ক থেকে সরানো হলে এর প্রভাব গার্মেন্ট কারখানায় পড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়বে। এ কারণে পুলিশ তাৎক্ষণিক কোনো অ্যাকশনে যাচ্ছে না। এ ছাড়া শ্রমিকরা ক্লান্ত হয়ে চলে গেলে সড়কে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়ে আসবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শ্রমিকদের দাবির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য জনপ্রতিনিধিদের দ্রুত সময়ের মধ্যে উদ্যোগ নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে। তিনি আরো বলেন, চট্টগ্রামের মেয়র মঞ্জুর আলম, স্থানীয় সংসদ সদস্য এম এ লতিফ, বাড়িওয়ালা, শ্রমিক ও পুলিশের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে একটি সমঝোতামূলক সভা হবে। এ সভায় বাড়িভাড়া নির্ধারণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।
একাধিক শ্রমিক জানিয়েছে, অস্বাভাবিক হারে বাড়িভাড়া বৃদ্ধি বন্ধসহ সাত দফা দাবিতে সমাবেশের ডাক দেওয়া হয়। দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে, আগামী জানুয়ারি মাস থেকে বাড়িভাড়ার রসিদ প্রদান, সরকারি নিয়মনীতি অনুসরণ করে রুম ভাড়া নির্ধারণ, বার্ষিক ভাড়া বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও সরকারি নীতি অনুসরণ, প্রয়োজনমতো গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ করা, বছরে তিন-চার দফায় ভাড়া বৃদ্ধি বন্ধ, বাড়িওয়ালার তত্ত্বাবধায়ক কর্তৃক ভাড়াটিয়াদের গালাগাল করা বন্ধ, বাসা ছাড়ার জন্য ৯০ দিন আগে নোটিশ প্রদান ইত্যাদি।
অস্বাভাবিক হারে বাড়িভাড়া বৃদ্ধিতে ক্ষুব্ধ ইউপিজেডের শ্রমিক শাকিল আহমদ বলেন, গার্মেন্ট মালিকরা বছরে বেতন বৃদ্ধি করছে ১০ শতাংশ। কিন্তু বাড়িওয়ালারা বছরে তিন দফায় বাড়ি ভাড়া বাড়াচ্ছে নূ্যনতম ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর গোলাম মোহাম্মদ চৌধুরীর ভাড়াটিয়া শ্রমিক মিন্টু হাওলাদার অভিযোগ করে বলেন, গত ডিসেম্বর মাসে এক রুমের একটি বাসার ভাড়া ছিল এক হাজার ৮০০ টাকা। গত জানুয়ারিতে প্রথম দফায় বাড়িভাড়া ৪০০ টাকা বাড়িয়ে দুই হাজার ২০০ টাকা করা হয়। আবার অক্টোবর মাসে দ্বিতীয় দফায় আরো ২০০ টাকা বাড়ানো হয়। এখন আগামী জানুয়ারি মাসে আরো ৬০০ টাকা বাড়ানো হবে বলে মৌখিকভাবে জানিয়েছেন। জানুয়ারিতে ভাড়া বাড়ানো হলে এক রুমের এই বাসার ভাড়া হবে তিন হাজার টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ভাড়া বৃদ্ধি পাচ্ছে এক হাজার ২০০ টাকা।
শ্রমিকরা জানায়, ইপিজেড এলাকায় তাদের জন্য তৈরি করা এসব বাড়ির মালিকরা এতই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যে ভাড়া বাসায় তারা কোনো প্রসূতিকে থাকতে দেয় না। অতিথি এলে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করে। এমনকি চিকিৎসার জন্য কোনো আত্মীয় বাসায় আসতে পারে না। এ ছাড়া গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংকট তো আছেই।
তারা আরো জানায়, এখন সড়কে অবস্থান নিয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। এতে কাজ না হলে ভবিষ্যতে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। সমাবেশকারীরা বাসাভাড়া বৃদ্ধি বন্ধের দাবিতে প্রধানমন্ত্রী এবং চট্টগ্রামের মেয়রের হস্তক্ষেপ কামনা করে।
গত বছরের ১১ ডিসেম্বর সিইপিজেডে বেতন-ভাতা বাড়ানোর দাবিতে শ্রমিক আন্দোলন হয়েছিল। গোয়েন্দা পুলিশের কাছে তথ্য আছে, শ্রমিক আন্দোলনের এক বছর পূর্তিতে একটি চক্র আবার নাশকতার চেষ্টা চালাতে পারে। তাই বাড়িভাড়া বৃদ্ধির অজুহাতে মহাসমাবেশ ডেকে কেউ যাতে ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে না পারে, সে বিষয়টিকে সামনে রেখে পুলিশ প্রশাসন সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.