চাঞ্চল্যকর মামলার রায়-মিরসরাই ট্র্যাজেডিই বটে!

ত ১১ জুলাই চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে ফুটবল খেলা দেখে খোলা ট্রাকে বাড়ি ফেরা ৪৫ জন শিশু-কিশোরের মর্মান্তিক মৃত্যু এক ট্র্যাজেডির জন্ম দিয়েছিল। এর প্রায় পাঁচ মাস পর ৮ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম জেলার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিমের আদালত যেন আরেক ট্র্যাজেডির সাক্ষ্য হয়েই থাকল। অগণিত মানুষের অনিঃশেষ যন্ত্রণা-শোকের কারণ হয়ে ওঠা এ মামলায় ট্রাকের চালক মফিজুর রহমানের তিন বছর কারাদণ্ড ও বিশ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন আদালত।


জরিমানা অনাদায়ে আরও নয় মাস কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়েছে। রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, 'এই দুর্ভাগা শিশু-কিশোরদের মৃত্যুর কোনো উপমা আছে বলে মনে হয় না। তারা কীভাবে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে, তা তাদের কাছের মানুষরা কেউই দেখেনি। এই মৃত্যু একটি স্বাভাবিক শোকাতুর দৃশ্যের অবতারণা করে।' বিচারকের আরও পর্যবেক্ষণ ছিল : 'সাম্প্রতিককালে সড়ক দুর্ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। চালকদের মধ্যে ট্রাফিক আইন না মানার প্রবণতা ও চালকদের ব্যক্তিগত চারিত্রিক স্খলনের কারণে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে' এবং এ কারণে আদালতের বিবেচনায় 'আসামি দৃষ্টান্ত হিসেবে সর্বোচ্চ শাস্তি পাওয়ার উপযুক্ত'। এটা ঠিক, কোনো চালকই ইচ্ছাকৃতভাবে সড়কপথে দুর্ঘটনা ঘটায় না। চালকের দক্ষতায় ঘাটতি থাকতে পারে কিংবা গাড়ি আনফিট হতে পারে। ক্ষতিগ্রস্ত বা অনুপযুক্ত সড়কপথও দুর্ঘটনার কারণ হয়। দুই গাড়ির সংঘর্ষের ঘটনায় উভয় চালক সমভাবে দায়ী নাও হতে পারে। এসব কারণে চালককে শাস্তি প্রদানই দুর্ঘটনা রোধের নিশ্চয়তা দেয় না। তবে চালকের দায় অবশ্যই থাকে এবং মিরসরাই ট্র্যাজেডির ক্ষেত্রে গুরুতর অপরাধ ছিল_ চালক মফিজুর রহমানের কোনো লাইসেন্স ছিল না। গাড়ি চালানোর সময় চালক মোবাইল ফোনে কথা বলছিল বলেও অভিযোগ ছিল। কিন্তু তাকে গাড়ি চালকের সুযোগ প্রদানের জন্য কাউকেই কেন অভিযুক্ত করা হলো না, সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। রায়ের পর রাষ্ট্রপক্ষের কেঁৗসুলি অভিযোগ করেছেন, বাংলাদেশ দণ্ডবিধির যথাযথ ধারায় মামলার এফআইআর পূরণ করলে ঘাতক চালককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা যেত। তদন্ত কর্মকর্তা সাক্ষ্য স্মারক মেমোরেন্ডাম অব এভিডেন্সে রাষ্ট্রপক্ষের কেঁৗসুলির অভিমতও গ্রহণ করেননি। রায়ের পর একাধিক বিশিষ্ট আইনজীবী এবং নিহতদের পরিবারের অনেক সদস্য মফিজুর রহমানের শাস্তি অপ্রতুল বলে অভিমত দিয়েছেন এবং এ জন্য দায়ী করেছেন আইনি সীমাবদ্ধতাকে। আমরা আশা করব যে, সরকার বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে এবং সংশ্লিষ্ট আইনের সংশোধনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। মাননীয় বিচারক তার রায়ে লাস্ট ডেজ অব পম্পেই উপন্যাস থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, 'উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত হয়ে উঠছে চারপাশ। একটু পরেই নিভে যাচ্ছে শিখা। আবার অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে পৃথিবী।' এ উদ্ধৃতি প্রতীকী বলেই ধরে নেওয়া যায়। মিরসরাই ট্র্যাজেডি আমাদের সবাইকে কাঁদিয়েছে এবং মামলার রায়ের পরও বাদী মায়ানী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান কবির আহমদ নিজামীর মন্তব্য : 'রায়ে আমি সন্তুষ্ট নই। সরকারের কাছে আবেদন, প্রয়োজনে আইন সংশোধন করে চালকের সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া হোক।' এ বক্তব্যে অনেক মানুষেরই আকুতির প্রতিফলন ঘটেছে এবং তা নিশ্চয়ই বিবেচিত হবে।

No comments

Powered by Blogger.